মৌলবাদীরা অবস্থান জানিয়েছে, এবার আপনার পালা
২৬ আগস্ট ২০২২ ১৯:০৪
ঢাকা: দেশীয় মূল্যবোধবিরোধী পোশাকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ায় বাংলাদেশ উচ্চ আদালতকে অভিবাদন ও স্যালুট জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। গতকাল ২৫ আগস্ট রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী” ব্যানারে এক মানববন্ধনে তারা এই অভিবাদন জানায়। তাদের এই মানববন্ধনের ব্যানারে স্লোগানের মতো যে লাইনগুলো লেখা ছিল, সেগুলো এমন—
“ছোট পোশাক নারীকে বিজ্ঞানী বানায় না, পণ্য বানায়”
“ছোট পোশাক পরে বিপরীত লিঙ্গকে সিডিউস করা বন্ধ করুন”
“ছোট পোশাক = নারী উন্নয়ন (এটাই সাইন্স)”
“পোশাকের স্বাধীনতার নামে পাবলিক ন্যুইসেন্স বন্ধ হোক”
“দেশীয় মূল্যবোধবিরোধী সংস্কৃতি গ্রহণযোগ্য নয়”
“দেশীয় সংস্কৃতি ধ্বংস করে পশ্চিমা সংস্কৃতি আমদানীকারকেরা Cultural Terrorist”
লাইনগুলো দেখে সবার প্রথমেই যে প্রশ্নটা মাথায় আসে, ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণের হুমকি দেওয়া, নারীবিদ্বেষী এই নোংরা কথাগুলো কিভাবে একটি মানববন্ধনে প্রকাশ্যে প্রদর্শিত হতে পারে? দেশের আইন কী বলে এ ব্যাপারে? তারপরেই যে প্রশ্নটা আমাদের প্রবল ধাক্কা মারে সেটা হচ্ছে, এই মানববন্ধন হয়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আঁতুরঘর খ্যাত প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম ব্যস্ত জায়গা রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তরের এক বিদ্যাপীঠে এমন ভয়াবহ উগ্র মৌলবাদী আলাপ দিয়ে রীতিমতো শোডাউন করে গেল কিছু ‘উনমানুষ’ আর এতো এতো প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা কেউই ন্যুনতম প্রতিবাদ করার প্রয়োজনবোধ করল না? বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিভাবে পোশাক নিয়ে এই ভয়ংকর তালেবানি মানববন্ধন ঘটতে দিলেন? নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারীর পোশাকের স্বাধীনতা হরণ করতে চাওয়া উগ্রমৌলবাদের উত্থানের বিপক্ষে সোচ্চার হওয়ার মতো আর কোনো প্রগতিশীল শিক্ষার্থী কিংবা ছাত্রসংগঠন নেই?
একজন বোরখা পরা নারী একটা প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন যেখানে লেখা— ছোট পোশাক নারীকে বিজ্ঞানী বানায় না, পণ্য বানায়। কী হাস্যকর অযৌক্তিক আলাপ, কিন্তু একইসঙ্গে কী ভয়াবহ হুমকি! সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা প্রায়ই দেখি পর্দার সবক দেওয়ার নামে নারীকে ‘ছেলা কলা’, ‘খোলা মিষ্টি’ ইত্যাদির সঙ্গে তুলনা করে বলা হয়, নারী যদি বোরখা পরে তাহলে তাকে কেউ টিজ করবে না, ধর্ষণ করবে না, কিন্তু বোরখা ছাড়া অন্য যে কোনো পোশাকে থাকলেই তার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। অথচ বাস্তবতার দিকে যখন আমরা তাকাই, তখন দেখি সারাদেশে প্রতিদিন নানা বয়সের অসংখ্য নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন, ধর্ষক তাদের পোশাক দেখে ধর্ষণ করছে না, বোরখা পরা কিংবা বোরখা ছাড়া শিশু থেকে বৃদ্ধ নারী কেউই রক্ষা পাচ্ছেন না। কিন্তু এই উগ্র ধর্মান্ধের দল নারীর স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার প্রথম ধাপ হিসেবে তার পোশাক পরার স্বাধীনতা দখলের চেষ্টা করছে, বোঝাতে চাচ্ছে তারা যে পোশাক ঠিক করে দেবে, সেটাই নারীকে পরতে হবে। সেটা তারা করছে ধর্মের পর্দাপ্রথাকে ব্যবহার করে, খুব সূক্ষ্মভাবে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ভারতে মুসকানের বোরখা পরার দাবির পক্ষে আমাদের দেশে রীতিমত বিপ্লব ঘটে গিয়েছিল যে—নারী কোন পোশাক পরবে সেটা তার স্বাধীনতা। মুসকানের বেছে নেওয়া পোশাকের স্বাধীনতা রক্ষায় পাশে আছি, দরকারে জীবন দেবো। পৃথিবীর সকল দেশে সকল স্থানে নারী কী পরবে সেটা তার ঠিক করার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সকলের দায়িত্ব ও কর্তব্য। কিন্তু সেই একই গোষ্ঠী নিজের দেশের নারীদের স্বাধীনভাবে পোশাক পরতে দিতে রাজি নয়। নরসিংদীর জনাকীর্ণ রেলস্টেশনে একজন নারী টপস এবং জিন্স পরে যাওয়ায় তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি ও একজন নারীর তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার কাপড়চোপড় ছিঁড়ে ফেলে শ্লীলতাহানির মতো অকল্পনীয় জঘন্য অপরাধে এই মুসকানের পোশাকের স্বাধীনতা চাওয়া গোষ্ঠী দাঁড়িয়েছিল আরেক নারীর শ্লীলতাহানি করা সেই মারজিয়া শিলার পক্ষেই। তাদের কাছে বোরখা ব্যাতিত আর সকল পোশাকই ছোট পোশাক, বেশরিয়তি পোশাক এবং পাবলিক ন্যুইসেন্স তৈরি করা সিডিউস করা পোশাক। সুতরাং, তারা মুসকানের পোশাকের স্বাধীনতা চায় কারণ মুসকান বোরখা পরতে চেয়েছিল, কিন্তু নিজেদের দেশে নারীদের বোরখা ছাড়া অন্য কিছু পরতে দিতে চায় না।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এরা দাবী করে আগে নাকি নারীরা শালীন পোশাক পরতেন, এখন পশ্চিমা সংস্কৃতির আধুনিক পোশাক পরে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি নাকি নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। অথচ আমাদের একান্ত দেশীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী আবহমানকাল ধরে আমাদের গ্রামাঞ্চলে নারীদের, মা-দাদী-নানী-তাদের মা-দাদী-নানীদের পোশাক ছিল স্রেফ এক প্যাচের শাড়ি। ব্লাউজ-পেটিকোট এগুলা তো প্রচলন হলো বহু পরে। স্রেফ এক প্যাচের শাড়ির ছোট পোশাক পরার সেই সময়ে কেউ পোশাক নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি, কারণ তখন কেউ পোশাক নিয়ে ভাবত না। কিন্তু এখন এরা নারীকে পশ্চিমা সংস্কৃতির জুজু দেখিয়ে বাধ্য করতে চাইছে আরবের পোশাকে, কেড়ে নিতে চাইছে নারীর স্বাধীনতা।
আমরা যদি তাদের স্লোগানগুলো ভালোভাবে খেয়াল করি, তাহলে কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারব এরা কোনো সাধারণ খেলো চিন্তাভাবনায় হুট করে রাস্তায় নেমে যাওয়া নির্বোধের দল নয়। অনেকদিন ধরেই গুছিয়ে পরিকল্পনা করেই তারা নেমেছে এবং তাদের লক্ষ্য শুধু নারীদের পোশাকের স্বাধীনতা হরণ করাই নয়, বরং আরো অনেক সুদূরপ্রসারী ও বিস্তৃত।
“ছোট পোশাক নারীকে বিজ্ঞানী বানায় না, পণ্য বানায়”
এখানে প্রশ্নটা হচ্ছে, এই স্লোগানে বিজ্ঞানী কেন লেখা হলো? কেন শিক্ষাবিদ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার, কৃষিবিদসহ অন্যান্য পেশাজীবী নয়? আমাদের দেশে তো এই পেশাগুলোতেই আশি থেকে নব্বই ভাগ ছেলেমেয়ে শিক্ষা শেষে যোগ দেয়। শতকরা একজনও বিজ্ঞানী হয় না। তাহলে বিজ্ঞানী কেন আসলো?
আসলো এর কারণ হচ্ছে, কয়েক বছর ধরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব কৌশলে ধর্ম ও বিজ্ঞানকে মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে। ধর্ম বিশ্বাসের বিষয়, বিজ্ঞান যুক্তি ও তথ্য প্রমাণ নির্ভর। এই দুটো একেবারেই ভিন্নপথের ফিল্ডকে একসঙ্গে মেশাতে চাওয়া বা বিজ্ঞান দিয়ে ধর্মকে ব্যাখ্যা করা বা বিজ্ঞানের মধ্যে ধর্মের রেফারেন্স খুঁজে বের করার মতো নোংরা কাজ চালিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে একদল উগ্র ধর্মান্ধ। তাদের লক্ষ্য একটাই, বিজ্ঞানকে ধর্মের একটা বাইপ্রডাক্ট হিসেবে দেখিয়ে, ধর্মবিশ্বাসের শ্রেষ্ঠত্ব ব্যবহার করে এই দেশে বিজ্ঞানচর্চা, বিজ্ঞানমনস্কতাকে ধীরে ধীরে অপ্রাসঙ্গিক করে তোলা, নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের জ্ঞানের নতুন নতুন মত ও পথ সম্পর্কে জানার আগ্রহকে নষ্ট করে দেওয়া, আধুনিক বিজ্ঞানের সকল সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করাকে ‘টেকেন ফর গ্র্যান্টেড’ হিসেবে দেখাতে শেখানো কিন্তু এর পেছনে বিজ্ঞানী ও গবেষকদের অবদানকে তুচ্ছ করতে শেখানো, ধর্মগ্রন্থেই এসব আবিষ্কারের সূত্র দেওয়া আছে ধরনের মিথ্যার প্রচার।
এই স্লোগানের মাধ্যমেই চেনা গেছে, এরা আসলে কারা। এরা তারাই যারা ধর্ম আর বিজ্ঞানকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে সুকৌশলে ধর্মীয় বিশ্বাস দিয়ে বিজ্ঞানের অবদানকে অস্বীকার ও বিজ্ঞানচর্চাকে তুচ্ছ করার সংস্কৃতি গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এদের এই মানববন্ধন যতটা না হাইকোর্টের অবজার্ভেশনকে সমর্থন করা, তারচেয়ে বেশি নিজেদের অবস্থানকে জানান দেওয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক তারা এভাবেই নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছে। গতকালের এই মানববন্ধন ছিল আরো প্রকাশ্য এক ঘোষণা, তারা সরাসরি জানিয়ে দিচ্ছে, মেয়েরা কোন পোশাক পরবে এটা তারাই ঠিক করে দেবে। সার্বিক ধর্মান্ধ সমাজ কায়েমের অনেকগুলো ফ্রন্টের এটা একটি অন্যতম প্রধান ফ্রন্ট। সোজাসাপ্টা সংস্কৃতির লড়াই। এরা সরাসরি জানিয়ে দিয়েছে তারা শুধু নিজেদের অধিকারই চায় না, একইসঙ্গে সেই অধিকার কায়েম করতে চায় অন্যদের অধিকার হরণ করে, নিজেদের পছন্দ বাকি সবাইকে মানতে বাধ্য করে।
আফগানিস্তানে তালেবান বা মধ্যপ্রাচ্যে জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) ঠিক এভাবেই বর্বর ধর্মান্ধ সমাজ কায়েম করেছিল। তাদেরই অনুসারী এরা এখন রাস্তায় নেমে আসছে, রাজু ভাস্কর্যের সামনে ব্যানার প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে তাদের সক্রিয়তা এবং হুমকির জানান দিচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, প্রগতিশীল সংগঠনগুলো, ছাত্র সংগঠনগুলো বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীরা কি এই উগ্র মৌলবাদীদের দাবি মেনে নিয়ে তাদের পছন্দমতো পোশাক পরতে রাজি? রাজি হলে কিছু বলার নেই। আর যদি মনে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনই উগ্র ধর্মান্ধ তালেবানি শাসন কায়েম হতে দেওয়া যাবে না, তাহলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নামার সময় সমাগত। উগ্র মৌলবাদীদের বক্তব্য কিন্তু স্পষ্ট, আপনাদের অবস্থান আর বক্তব্য জানিয়ে দেবে আমাদের ভবিষ্যতের ঠিকানা।
এদের যদি ক্যাম্পাসে রাজপথে এখনই সরাসরি জবাব না দেওয়া যায়, মোকাবেলা করা না হয়, তবে আপনি কী পরবেন না পরবেন, সেটা বেছে নেওয়ার অধিকার আর খুব বেশিদিন নিজের কাছে ধরে রাখতে পারবেন না। যাদের দাবি সক্রিয়, স্পষ্ট এবং প্রভাববিস্তারকারী, তাদের পক্ষেই জনমত বাড়ে। আপনারা যদি সক্রিয় না হন, সামনের দিনে এই ক্রমেই বাড়তে থাকা জনমত আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনাদেরই বোরখা না পরে অন্য পোশাক পরার অপরাধে স্লাট শেমিং করবে, শারীরিকভাবে আক্রমণ করবে। সেদিন পর্যন্ত অপেক্ষা না করাই মঙ্গল।
লেখক: একটিভিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/আইই