সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদ ও বর্তমান প্রেক্ষাপট
২৭ আগস্ট ২০২২ ১৫:৪৫
পৃথিবীর বুকে বহু রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক, আইনজীবী ও সাংবাদিক রয়েছেন যারা তাদের কৃতকর্মের দ্বারা আমাদের মাঝে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। কিন্তু এই পৃথিবীতে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হয়ে নিজের কৃতিত্ব অর্জন করতে কয়জন পেরেছিলেন তা বলা দুষ্কর। ঠিক তেমনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বাংলার বুকে জন্ম নেওয়া আবুল মনসুর আহমদ। যিনি ছিলেন এক মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ। সর্বদা ছিলেন সমাজ সংস্কার ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের নিবেদিত এক প্রাণ। বলতে গেলে, সকল ক্ষেত্রে তার কর্মের মাধ্যমে অগ্রণী ভূমিকা রেখে গেছেন। আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতা, রাজনৈতিকতা ও সাহিত্য সম্পর্কে জানতে হলে অবশ্যই তার রচিত আত্মকথা গ্রন্থটি পড়তে হবে। যেখানে তিনি তার রাজনৈতিক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকতা জীবন সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। আর সেই আলোচনার প্রেক্ষাপট ধরে আমরা সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদের ২৭ বছরের সাংবাদিক জীবন সম্পর্কে জানতে পারব। যে জানার ফলে, বর্তমান বা আজকের সাংবাদিকতার মাপকাঠি নির্ণয় করতে সক্ষম হব।
সময়টা তখন ১৯২৩ সাল। আবুল মনসুর আহমদের বয়স ২৫। তিনি কলকাতার প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামবাদীর ‘ছোলতান’ পত্রিকায় সহ-সম্পাদক হিসেবে ৩০ টাকার বেতনে সাংবাদিকতা শুরু করেন। এখানে প্রায় দেড় বছর কাজ করছেন। এরপর আবুল মনসুর আহমদ যোগদান করেন সাপ্তাহিক মোহাম্মদীতে। এই পত্রিকাতেই আবুল মনসুর আহমদ পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেন কঠোর পরিশ্রম, প্রচুর লেখালেখি, সহ-সম্পাদনা সহ নানা রকম দায়িত্বের মাধ্যমে। তখন তিনি মোহাম্মদীতে দক্ষতার সহিত রক্তচক্ষু, বর্জ্রমুষ্টি, সিংহ নিনাদ ইত্যাদি প্রতীকী শব্দ ব্যবহার করে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী উদ্দীপক শিরোনাম দিয়ে বহু সম্পাদকীয় লিখেছিলেন। এসব লেখায় ছিল যুক্তিপূর্ণ কথামালার সমাহার। এমন যুক্তিপূর্ণ লেখার ফলে সাংবাদিক মহলে এবং মওলানা আকরাম খাঁ এর প্রশংসা অর্জন করলেন। প্রাসঙ্গিকতায় বলতে হয়, তৎকালীন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির রিডিং রুমে একজন পাঠক তার যুক্তিপূর্ণ লেখাগুলো জোরে জোরে শব্দ করে শ্রোতাদের জন্য পড়তেন। ফলে, তারা আবুল মনসুর আহমদের লেখার তাৎপর্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হতেন। পরবর্তীতে মৌলভী মুজিবুর রহমানের ‘দি মুসলমান’ পত্রিকায় যোগদানের মাধ্যমে তার সাংবাদিকতার আরো একটি অধ্যায় শুরু হয়। এখানে নিযুক্ত হওয়ার কালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং অতি সুখে শান্তিতে মর্যাদার সাথে সাংবাদিকতা করতে লাগলেন। ‘দি মুসলমান’ থেকে বের হয়ে সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা ‘খাদেমে’ যোগদান করেন। সম্পাদনা থেকে শুরু করে সবকিছু তার উপর ন্যস্ত ছিল। আর এখানে থাকাকালীন অর্থাৎ ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর মাসে তার সাংবাদিকতার জীবনের প্রথম পর্যায় শেষ হয়।
সাংবাদিকতার জীবনের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়েছিল ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘দৈনিক কৃষক’ পত্রিকায় প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে। এই পত্রিকাটি নিখিল বঙ্গ কৃষক প্রজা সমিতির উদ্যোগে কৃষক প্রজা আন্দোলনের মুখপত্র রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল। ‘দৈনিক কৃষক’ পত্রিকাটি আবু মনসুর আহমদের তীক্ষ্ণ দক্ষতায় অল্প দিনেই সাংবাদিক মহলে ও জনগণের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করল। সত্যতা, আদর্শতায় , স্বাধীন মত-প্রকাশ এবং পক্ষপাতত্বহীন বা নিরপেক্ষ সমালোচনায় এটি বেশ সুনাম অর্জন করেছিল। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, পত্রিকাটি তার অস্তিত্ব সুনাম-খ্যাতি বেশিদিন ধরে রাখতে পারিনি অর্থভাবের জন্য। পরবর্তীতে একপর্যায়ে এসে, ফজলুল হক মন্ত্রিসভার প্রস্তাবিত মাধ্যমিক শিক্ষা বিল নিয়ে মি. দত্তের সাথে তার মত বিরোধ হলে, নীতির প্রশ্নে আপোসহীন আবুল মনসুর আহমদ কৃষক পত্রিকার দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন।
আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতা জীবনের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় ‘নবযুগ’ পত্রিকার মাধ্যমে। সময়টা তখন ১৯৪১ সালের অক্টোবর মাস। পত্রিকাটি ফজলুল হকের। তিনি চেয়েছেন আবুল মনসুর আহমদ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কিন্তু আবুল মনসুর আহমদ চাননি তার নামে সম্পাদক দিয়ে প্রকাশ হোক। তবে তিনি সম্পাদনার দায়িত্বের ভার গ্রহণ করেন। আর সম্পাদক হিসেবে ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তার সাংবাদিকতার জীবনের শেষ বা ৪র্থ পর্যায় শেষ হলো ‘ইত্তেহাদ’ পত্রিকার মাধ্যমে। সময়টা তখন ১৯৪৭ সালের জানুয়ারি মাস। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাকে সম্পাদক হিসেবে গ্রহণ করে পত্রিকাটি বের করেন। আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতা জীবনে আগে যেমন কষ্ট, নানান সংকট ও জটিলতার মধ্যে দিয়ে পার করতে হয়েছিল কিন্তু এখানে এসে এমন কিছুর সম্মুখীন হতে হয়নি বরং তার সাংবাদিকতার জীবনে চরম সুখ ও মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। এখানে ছিল সাংবাদিকতার পূর্ণ স্বাধীনতা, ছিল না অর্থের অভাব। অর্থাৎ, নিজের মতো করে সবকিছু করতে পারতেন স্বাচ্ছন্দ্যে। বলাবাহুল্য যে, এই পত্রিকার মাধ্যমে তিনি সাংবাদিকতায় অনন্য সফলতা অর্জন করেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’ পত্রিকাটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে তার সাংবাদিক চেতনার মাধ্যমে। এছাড়া তিনিই প্রথম পত্রিকায় ‘পাঠকের মজলিস’ নামের একটি ফিচার বিভাগ চালু করেন। যেখানে পাঠকরা সম্পাদকের দায়িত্ব, কর্তব্য এবং তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে পারতেন। এখানে ছিল না মত-প্রকাশের কোন ধরনের বাধা-বিপত্তি। আর সেজন্যই পাঠকরা স্বাচ্ছন্দ্যে সম্পাদকের লেখার ও মতের সমালোচনা করতে পারতেন। ১৯৫০ সালে নানান জটিলতার কারণে ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’ পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেলে তিনিও তার সাংবাদিকতার জীবনের ইতি ঘটান। পরবর্তী সময়ে তিনি ১৯৫০ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ইংরেজি-বাংলা দৈনিকে কলামিস্ট হিসেবে লেখালেখি করে গিয়েছেন। যার লেখায় ছিল যুক্তিপূর্ণ কথামালার সমাহার আর প্রতিবাদের ঝড়।
আবুল মনসুর রহমান যখন সাংবাদিকতা করেছিলেন তখন মুসলমানদের পক্ষে সাংবাদিকতা করা বেশ দুরূহ ব্যাপার ছিল। সেই সময় মুসলমান যুবকদের হিন্দু সংবাদপত্রে কাজ পাওয়া অসম্ভব ছিল। তবুও তিনি হাল ছাড়েননি; কাজ করে গেছেন। সেই কাজ করতে গিয়ে নানান প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন। অর্থাভাবের জন্য বহু দৈনিক বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পত্রিকা বন্ধ হওয়ার পেছনে আবুল মনসুর আহমদ তার সাংবাদিকতার জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে তার ‘আত্মকথা’ বইয়ে আরো একটি বিষয় নিয়ে লিখেছিলেন যে, ‘আমি জানিতাম নবযুগ বেশি দিন টিকিবে না। কারণ আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এই যে, রাজনৈতিক নেতাদের স্থাপিত কাগজ স্থায়ী হয় না। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, মি. জে এম সেন গুপ্ত, শ্রীযুক্ত শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী, পণ্ডিত জওয়াহরলাল নেহরু প্রভৃতি বড়-বড় নেতা নিজস্ব দৈনিক কাগজ বাহির করিয়াছেন। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ধুমধামের মধ্যে কাগজ চলিয়াছে কিছুদিন। তারপর সব ঠাণ্ডা।’ উদাহরণ হিসেবে বলা যায় দৈনিক কৃষকের কথা। এটি বন্ধ হওয়ার পেছনে মুখ্য কারণ ছিল হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব। কারণ হিন্দুরা বিজ্ঞাপন দেয় না মুসলমান বলিয়া, আর মুসলমান দেয় না কৃষক পত্রিকা হিন্দু কংগ্রেস ঘেষা বলে। কাজেই আবুল মনসুর আহমদ সাংবাদিকতা করতে গিয়ে অনেক বাধা বিপত্তির মুখে পড়ে যে সংকট তৈরি হয়েছিল, সেই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছিল।
উপরোক্ত আলোচনা এবং আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতা জগতের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, তার সাংবাদিকতার জীবনের সাফল্যের বিভিন্ন দিক। তাঁর সাংবাদিকতার জীবনের প্রেক্ষাপট ছিল উপমহাদেশের রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ও সংকটময়কালে। সেই সময়টাতে সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে লেখাগুলো ছিল বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকার দাবিদার। এসব লেখা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হতো মুসলিম তরুণ-যুবাদের সভা-সমিতিতে। মুসলিম সমাজের এই জাগরণের প্রেক্ষাপট জায়গা করে নিয়েছিল তার লেখনীতে। তৎকালীন সময়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, উপমহাদেশের বিভক্ত হওয়া, পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসসহ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাথে তার সাংবাদিকতা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তিনি যখন সাংবাদিকতায় নিযুক্ত হন তখন মুসলমানদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল চরম শোচনীয়। চারিদিকে যখন শুধু সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের ছড়াছড়ি। ঠিক তখনই তিনি এসব কিছুর বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ গড়ে তুলেছিলেন। শুধু তাই নয় বরং যেখানেই তিনি কোন অনিয়ম, দুর্নীতির সন্ধান পেয়েছেন সেখানেই তার লেখনীর মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছেন।
তাঁর সাংবাদিকতার জীবনে বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। তিনি যখন খাদেম পত্রিকায় কাজ করেন তখন তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ করেছিলেন। তাই বলা যায় যে, আবুল মনসুর আহমদ সমাজ, জনগণের ও রাজনৈতিক সচেতনতার একজন অভিভাবক। কৃষক প্রজা আন্দোলনের মুখপত্র দৈনিক কৃষক পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব পালনে তিনি স্বাধীন মতবাদ এবং নিরপেক্ষ সমলোচনা করতে দ্বিধাবোধ করেননি। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে বিন্দু মাত্র কার্পণ্য করেননি। ফলশ্রুতিতে, এটি কলকাতার হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বেশ সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হয়। যখন একের পর এক পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তখন তিনি ‘নবযুগ’ পত্রিকায় যোগদান করেন। এখানে থাকাবস্থায় অনেকাংশেই রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন এবং ‘কবি ও কাদা’ নামে একটি দস্তখতী সম্পাদকীয় লিখেছিলেন যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও যুক্তিপূর্ণ কথামালার সমাহার ছিল। ফলে, তিনি তরুণ, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক মহলে প্রশংসিত হয়েছিলেন।
আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতার সময়ে সংবাদপত্রে হিন্দু সাংবাদিকদের সংখ্যা বেশি ছিল। অবশ্য মুসলিম সাংবাদিকদের সংখ্যা কম হওয়ার পিছনে যথাযথ কারণ ছিল। একদিকে যেমন মুসলিম বাংলা দৈনিক সংবাদপত্রের অভাব ; অন্যদিকে সাংবাদিকতার পেশায় মুসলিম যুবকদের অনীহা। এই বিষয়টি তিনি তীব্রভাবে অনুভব করতেন। আর এই অনুভব ও সাংবাদিকতার চেতনা থেকে তিনি যখনই সুযোগ পেয়েছেন, তখনই মুসলমান যুবকদের সাংবাদিকতা পেশায় নিযুক্ত করেছেন। অধিকতর যোগ্য হিন্দু বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত অযোগ্য মুসলমানকে চাকুরি দিয়েছেন। এতে আবুল মনসুর আহমদের হিন্দুর প্রতি কোনো ধরনের হিংসা-বিদ্বেষ ছিল না। তিনি শুধুমাত্র মুসলমান যুবকদের সাংবাদিকতায় উদ্বুদ্ধ করার জন্যই এ কাজটি করতে বাধ্য হয়েছেন। কাজেই আবুল মনসুর আহমদ মুসলিম যুবকদের মধ্যে সাংবাদিকতার দ্বার উন্মোচন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন ;যা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। বরং বলা যায় যে, তিনি ছিলেন বাঙালি মুসলমান সমাজে সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচিত।
আবুল মনসুর আহমদ কতটা উদার মনের অধিকারী এবং বিশ্বস্ত মানুষ ছিলেন তার একটি ঘটনা থেকেই বুঝা যায়। পুরো কলকাতা সংবাদপত্রের জগতে কম্পোজ সেকশনে কোন ধরনের ফ্যানের ব্যবস্থা ছিল না। অনেক প্রতিকূল অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করতে হতো। আবুল মনসুর আহমদ তাদের এই কষ্ট দূর করার চেষ্টা করেছিলেন। তার একান্ত প্রচেষ্টায় এই কাজটি করতে সফল হয়েছেন। তিনিই প্রথম কম্পোজ সেকশনে ফ্যানের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। একজন মানুষ কতটা উদার মনের অধিকারী হলে এমন ইতিবাচক চিন্তা ভাবনা করতে পারেন যা সত্যিই ভাবনার বিষয়। যখন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করতে চেয়েছিল তখন তিনি পাকিস্তানের ভাষা বাংলার পক্ষে ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকায় ‘পূর্ব বাংলার জবান’ শিরোনাম দিয়ে প্রবন্ধ লেখেন। এই প্রবন্ধই তৎকালীন সময়ে ভাষা আন্দোলনের প্রথম লিখিত প্রতিবাদ হিসেবেই বিবেচিত হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে তমুদ্দুন মজলিস ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না ঊর্দু’ শিরোনাম দিয়ে তিনটি প্রবন্ধ নিয়ে একটি পুস্তিকা বের করে। এই প্রবন্ধ সংকলনে তিনজন হলেন কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল কাশেম ও আবুল মনসুর আহমদ। সংকলনে আবুল মনসুর আহমদ ‘বাংলা ভাষাই হইবে আমাদের রাষ্ট্রভাষা’ শিরোনামে প্রবন্ধ লিখে কঠোরভাবে ঊর্দুর বিরোধিতা করেন। ফলে, পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের উপর চাপ প্রয়োগ করলে ভাষা আন্দোলন জোরালো হতে থাকে। আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে এটিও একটি বিষয়।
আবুল মনসুর আহমদের এই দীর্ঘ পথ চলা মোটেও মসৃণ ছিল না। নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে নীতি আদর্শে আপোসহীন থেকে কাজ করে গিয়েছেন। আর সেজন্যই নীতির প্রশ্নে আপোসহীন থেকে চাকরি ত্যাগ করতে দ্বিধাবোধ করেননি। তিনি এমন একজন মানুষ যে কিনা অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা বলে জাতীয় ঐক্য তৈরিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। তৎকালীন সময়ে মুসলমানদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক যে দুরবস্থা ছিল। সেসব নিয়ে কথা বলেছেন। লিখেছেন পিছিয়ে পড়ার কারণ। দেশবিরোধী হতে যেকোনো ধরনের অন্যায় অপরাধ দেখলে সর্বদা সোচ্চার প্রতিবাদ গড়ে তুলেছেন তার লেখনীর মাধ্যমে। তিনি সমাজের বিভিন্ন গোঁড়ামির বিরুদ্ধে এক নিবেদিত প্রতিবাদী প্রাণ ছিলেন। গোড়াঁ হিন্দুদের হাতে যখন মহাত্মা গান্ধী নিহত হন তখন তিনি এর তীব্র সমালোচনা করেছিলেন।
আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতার জীবনের সাথে প্রাসঙ্গিকতা রেখে যদি বর্তমান সাংবাদিকতার কথা বলি তাহলে দেখা যাবে দুটোর মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। আবুল মনসুর আহমদ তার সাংবাদিকতার জীবনে কোন ধরনের প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার মতো কাজ করেননি। বরং সবসময় নীতি আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। সেই অনুযায়ী কাজ করে গিয়েছেন। কিন্তু বর্তমান সাংবাদিকতায় প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার মতো অনেক কিছু ঘটছে। আজকের সাংবাদিকতায় যারা সাংবাদিকতা করেন তাদের অধিকাংশই যথেষ্ট যোগ্য এবং দক্ষ সম্পন্ন সাংবাদিক। কিন্তু কিছু কিছু সাংবাদিক রয়েছেন যারা সাংবাদিকতার সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা রাখেন না। সাংবাদিকতা করতে যেসব বৈশিষ্ট্য দরকার সেগুলো তাদের মধ্যে নেই বললেই চলে। এদের অনেকেরই সংবাদ পরিবেশন বা উপস্থাপনে যথেষ্ট ভুলভ্রান্তি রয়েছে। বিশেষত প্রুফ রিডিং এর ক্ষেত্রে। কারণ সব লেখক বা সাংবাদিকদের প্রুফ রিডিং সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গরূপে জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বরং বলা যায়, সাংবাদিকতা করার জন্য প্রথম যে জিনিসটা প্রয়োজন তা এই প্রুফ রিডিং। আর এজন্যই বোধ হয় আবুল মনসুর আহমদ তাঁর সাংবাদিকতার জীবনে এই বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে রপ্ত করেছেন। এ বিষয়টি তার নেশার মত ছিল; আর এই নেশা জাগ্রত হয় যখন তিনি ‘ছোলতান ও মোহাম্মদীতে’ কাজ করেছিলেন তখন ওয়াজেদ আলী সাহেবের কাছ থেকে এ বিষয়টি অর্থাৎ প্রুফ রিডিং ভালোভাবে রপ্ত করেছেন। আর সেজন্যই আবুল মনসুর আহমদ ওয়াজেদ আলী সাহেবকে তাঁর মডেল বা আদর্শ হিসেবে গণ্য করেছেন। কাজেই বর্তমানে যারা সাংবাদিকতা পেশায় নিযুক্ত রয়েছেন বা হবেন তাদের উচিত হবে আবুল মনসুর আহমদের মতো গুরুত্ব সহকারে এই বিষয়টি রপ্ত বা আয়ত্ত করা। তাহলেই সংবাদ পরিবেশন বা উপস্থাপনে যে ভুল গুলো হয়ে থাকে তা থেকে নিশ্চিন্তে থাকা যাবে।
বর্তমান সময়ে যারা সাংবাদিকতা পেশায় কাজ করেন তাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা সাংবাদিকতা করতে যেসব বৈশিষ্ট্য দরকার সেসব বৈশিষ্ট্য গুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন না। ফলে তারা কাজ করতে গিয়ে অনেক বাধা বিপত্তির মুখে পড়তে হয় বা হচ্ছে। এরকম পিছিয়ে পড়া সাংবাদিকদের নিয়ে আবুল মনসুর আহমদ ভেবেছেন, তাদের নিয়ে কাজ করেছেন। তৎকালীন সময়ে আবুল মনসুর আহমদ যখন ইত্তেহাদ পত্রিকার সকল দায়িত্ব পেলেন তখন তিনি ইত্তেহাদ পত্রিকাতে মুসলমান সাংবাদিক নিয়োগ দিলেন। বলতে গেলে একটা মুসলিম গোষ্ঠী তৈরি করলেন। আর তারা তুলনামূলকভাবে হিন্দু সাংবাদিকদের থেকে দুর্বল ছিল। এখন অনেকের প্রশ্ন জাগতে পারে যে, তিনি কেন এই কাজটি করলেন। এমন কাজ করার পিছনে রয়েছে মুসলিম যুবকদের সাংবাদিকতা পেশায় নিযুক্ত হওয়ার যে অনীহা সেটি দূর করে উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করা। আর তারা তুলনামূলকভাবে হিন্দু সাংবাদিকদের থেকে দুর্বল ছিল। তাদেরকে যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আবুল মনসুর আহমদ ট্রেনিং বা প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য নানান পরিকল্পনা গ্রহণ করে অনেকগুলো বই সংগ্রহ করলেন। তার মধ্যে পিটম্যানের প্রকাশিত ‘ম্যানস ফিল্ডের কমপ্লিট জার্নালিজম এন্ড সাব- এডিটিং; চার্লস রিগবির দি স্টাফ জার্নালিস্ট; মি. এস. কারের মডার্ন জার্নালিজম; টি. এ. বিডের রিপোর্টার্স গাইড, উই লিকাম স্টিডের দি প্রেস’ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি তাদেরকে এসব বই পড়ার মাধ্যমে অল্পদিনেই যোগ্য সাংবাদিক হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। ফলে তারা হেডলাইন, ডিসপ্লে, মেক আপ, গেট-আপ, টাইপ বিতরণসহ প্রুফ রিডিংয়ে পারদর্শী হয়ে উঠলো। কাজেই আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতার জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আমাদের দেশে বাস্তবায়ন করতে হবে। সাংবাদিকতা বিষয়ক বিভিন্ন বই পড়ার অভ্যাসের মাধ্যমে জড়তা কাটিয়ে তুলতে হবে। পিছিয়ে পড়া সাংবাদিকদের নিয়ে ট্রেনিং বা প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যারা সাংবাদিকতা করেন তাদের জন্য ট্রেনিং বা প্রশিক্ষণ কর্মশালা আয়োজন করা বাধ্যতামূলক। কারণ তুলনামূলকভাবে ওরা অনেক পিছিয়ে। ফলশ্রুতিতে, এদেশে যোগ্য সাংবাদিক হিসেবে গড়ে উঠবে আর সর্বক্ষেত্রে আলোকিত হয়ে উঠবে।
আজকের বা বর্তমান সময়ে সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে আরো একটি সংকট দেখা যায় সেটি হচ্ছে, সংবাদ পরিবেশনে বা উপস্থাপনে পক্ষপাতিত্ব হীন বা নিরপেক্ষতার বড়ই অভাব। দেশের সাংবাদিকদের মধ্যে অনেক সাংবাদিক আছেন যারা সুষ্ঠু ধারার সংবাদ প্রকাশ করেন না বরং পক্ষপাতিত্ব নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেন। যেখানে থাকেনা কোন সুনির্দিষ্ট সত্য তথ্য বা গ্রহণযোগ্যতা সম্পন্ন যুক্তি। বলতে গেলে সবকিছু নিজের মতো করে পরিবেশন করছে। ফলশ্রুতিতে, রাষ্ট্রের মধ্যে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা বা অরাজকতা সৃষ্টি হয়, গণ মাধ্যমের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। গণমাধ্যম বা সংবাদপত্রের প্রতি জনগণের যে আস্থা সেটি ধীরে ধীরে বিলোপ পায়। অথচ আবুল মনসুর আহমদ তার সাংবাদিকতার জীবনে কখনো সংবাদ প্রকাশে বা পরিবেশন করতে প্রশ্নবিদ্ধ হতে দেননি। তিনি বলেছিলেন, সাংবাদিকতা নিছক কোন সংবাদ সরবরাহ নয়; বরং সংবাদের সুষ্ঠু ব্যাখ্যাও বটে। আসলেই তাই। কারণ একটি সংবাদ পরিবেশন করতে সুনির্দিষ্ট গ্রহণযোগ্য যুক্তি থাকবে; যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ করার মতো কিছুই থাকবে না। প্রত্যেক নাগরিকের পছন্দ অনুযায়ী বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের অধিকারী হতে পারে। এটা তার নাগরিক অধিকার। এখানে কোন ধরনের হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই। করলে সেটি মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হবে বলে গণ্য করা হবে। সে প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতাদর্শে বিশ্বাসী হতে পারে কিন্তু তাই বলে এই না যে পক্ষপাতিত্ব করতে হবে। আর সেজন্যই আবুল মনসুর আহমদ তার সাংবাদিকতার জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন যে, সাংবাদিকতার সাথে রাজনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রাজনীতিতে পার্টিগত বা শ্রেণীগত মতভেদ অপরিহার্য, এটা থাকবেই। কিন্তু এই মতভেদ থাকা সত্ত্বেও সাধু সাংবাদিকতা করা সম্ভব। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে আমাদের দেশের সাধু সাংবাদিকদের বড়ই অভাব। তাঁরা নিজেদের রাজনীতি দল বিবেচনা পূর্বক সংবাদ সরবরাহ বা পরিবেশন করে থাকেন। অথচ আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতার জীবন থেকে শিক্ষা নেন না। ভুলে যান সাংবাদিকতা করতে হলে নিরপেক্ষতা থাকা জরুরি এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি। কাজেই নিরপেক্ষতা থেকে সুষ্ঠু ধারার সংবাদ পরিবেশন করা অতীব জরুরি।
সাংবাদিকতা করার জন্য যেসব বৈশিষ্ট্য দরকার সেগুলোর মধ্যে অনুসন্ধিৎসা যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন সৎ সাহসিকতা। প্রবল জলোচ্ছ্বাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে টিকে থাকাই সাহসিকতার পরিচয় দেওয়া। কিংবা আগুনের খুব কাছে গিয়ে কিংবা ডুবন্ত জনপদের মধ্যে দাঁড়িয়ে ভয়াবহ দৃশ্যের সারকথা তুলে আনার কাজটি বড়ই সাহসিকতার পরিচয়। তদ্রুপ বর্তমান সময়ে সাংবাদিকদের মধ্যে এমন কিছু সৎ সাহসী সাংবাদিক রয়েছেন যারা রাষ্ট্রের যেকোন সমস্যা কিংবা অসঙ্গতি দেখা দিলে সেই অসঙ্গতির কারণ খুঁজতে বের হয়ে পড়েন, সমাধানের পথ খুঁজে তুলে ধরতে চান জনগণের কাছে। কেননা সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরাই সাংবাদিকদের প্রধান কাজ। যখনই বিভিন্ন সমস্যা বা অসঙ্গতি বের করতে যাচ্ছেন তখনই বিভিন্ন বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হচ্ছেন। বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কিছু প্রভাবশালী মানুষ আছে যারা অঢেল সম্পদের মালিক হতে চায়। সেই সম্পদ অর্জনের পথটি কখনো ভালো উপায়ে হয় আবার কখনো অসৎ উপায়ে হয়ে থাকে। আর তাদের অসৎ উপায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেই সাংবাদিকদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে প্রভাবশালী মহল। কখনো হত্যা করার হুমকি আবার কখনো গুম করে দেওয়ার হুমকি। আবার কখনো কখনো থানায় মামলা ঠুকে দেওয়ার মতো হুমকির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বর্তমান সরকার ২০১৮ সালে ডিজিটাল আইন চালু করার পর প্রভাবশালীর এই মহলটি সাংবাদিকদের হেনস্থা করার বেশ সুযোগ পাচ্ছে। সাংবাদিক হেনস্থার পরিসংখ্যান খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য মতে, গত ১০ বছরে দুই হাজার ৩১২ জন সাংবাদিক লাঞ্ছনা, হয়রানির শিকার এবং গুম ও প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছেন। এর মধ্যে ২০১২ সালে ৪৪২ জন, ২০১৩ সালে ৩৪২, ২০১৪ সালে ২৩৯, ২০১৫ সালে ২৪৪, ২০১৬ সালে ১১৭, ২০১৭ সালে ১২২, ২০১৮ সালে ২০৭, ২০১৯ সালে ১৪২, ২০২০ সালে ২৪৭ এবং ২০২১ সালে ২১০ জন এমন পরিস্থিতির মুখে পড়েছেন। অনিয়ম, দুর্নীতি ও নানা অপকর্ম প্রকাশের কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের জালে ফেলেও হয়রানি বা কারাবাস করানো হচ্ছে সাংবাদিকদের। (সূত্র: জাগো নিউজ- ০৪ মার্চ, ২০২২ )
আর সেজন্যই বর্তমান সময়ে সাংবাদিকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে যে নির্ভীক সাংবাদিক হওয়া উচিত কিংবা দরকার সেটি ধীরে ধীরে বিলোপ পাচ্ছে। ফলে, দেশে বিভিন্ন অনিয়ম আর দুর্নীতি জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কাজেই নিরপেক্ষ, নির্মোহ সাংবাদিকতা বাংলাদেশের জন্য খুবই জরুরি।
বর্তমান সাংবাদিকদের মধ্যে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে কিছু সাংবাদিক আছেন যাদের মধ্যে নৈতিকতার ভিত্তি নেই বললেই চলে। তাদের নৈতিক দায়িত্ব পালনের চরম শোচনীয় অবস্থা। টাকার বিনিময়ে সংবাদ পরিবেশন কিংবা প্রতিহিংসার ছলনায় সংবাদ পরিবেশন করে অরাজকতা সৃষ্টি করছে। এছাড়াও অন্যের লেখা কিংবা অন্যের সংবাদ নিজের নামে প্রকাশ করে কুম্ভিলকবৃত্তির পরিচয় দিচ্ছে। ফলে তারা নিজেরাই নিজেদের আত্মসম্মানবোধ নষ্ট করছে। সেই সাথে প্রতিনিয়ত এই মহান পেশার গৌরবময় ঐতিহ্য বা ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। অথচ সাংবাদিকদের নৈতিকতার ভিত্তি থাকবে শক্তিশালী; থাকবেন নীতির বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার। যেকোন নীতির প্রশ্নে আপোসহীন থেকে কাজ করে যাওয়া। কিন্তু সাংবাদিকতার এসব বৈশিষ্ট্য ভুলে গিয়ে বিভিন্ন অপকর্মে, দুর্নীতিতে জড়িয়ে সাংবাদিকতার মহান পেশাকে কলুষিত করছে। জনগণের মুখে হলুদ সাংবাদিকতা নামক নেতিবাচক শব্দ শুনতে হচ্ছে। তাদের এমন কর্মকান্ডের কারণে প্রকৃত সাংবাদিকরা লজ্জিত হচ্ছে। যা সত্যি বেদনার।
পরিশেষে উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে একমত হতে হবে যে, সাংবাদিক হিসেবে আবুল মনসুর আহমদ ছিলেন নির্ভীক, নিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী। সেই সাথে তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদী নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। তার সাংবাদিকতার জীবনের দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে বর্তমান সময়ে যারা সাংবাদিকতা করেন তাদের শিক্ষা নিতে হবে। যে শিক্ষার মাধ্যমে নৈতিক ভিত্তি আরো বেশি শক্তিশালী করতে হবে। ত্যাগী ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতার চেতনায় বিশ্বাসী হতে হবে। সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে যেসব বৈশিষ্ট্য দরকার সেগুলো সম্পর্কে জেনে নিজেকে যোগ্য সাংবাদিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ফলশ্রুতিতে, বর্তমানে সাংবাদিকতা পেশা নিয়ে সাধারণ জনগণ যেসব নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে সেটি দূরীভূত হবে। ডিজিটাল আইন মামলার হুমকি না দিয়ে দেশের সাংবাদিকদের নীতি আদর্শে দায়িত্ব পালনের সুযোগ করে দিতে হবে। ফলে, এই দেশ এই সমাজ আলোকিত হয়ে উঠবে, দূর হবে নানা অনিয়ম আর দুর্নীতি। গড়ে উঠবে আবুল মনসুর আহমদের মতো ত্যাগী সাংবাদিক।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
মু সায়েম আহমাদ মুক্তমত সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদ ও বর্তমান প্রেক্ষাপট