রোহিঙ্গা সংকট: পর্যটন নগরীতে এইডস আতংক
২৭ আগস্ট ২০২২ ১৭:৫৩
দেশে রোহিঙ্গা সংকট ক্রমেই জটিল হচ্ছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যাচ্ছে না। রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টিতে মিয়ানমার প্রকৃতপক্ষে কোনো কাজ করছে না। রোহিঙ্গাদের ফেরার পরিবেশ তৈরি করতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য বাংলাদেশ প্রকাশ্যেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও মিয়ানমারের ওপর জোরালো কোনো চাপ সৃষ্টি করতে পারছে না। ভারত, চীন, জাপানসহ এশিয়ার দেশগুলোরও সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ। চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে নিয়ে কয়েক দফা ত্রিপক্ষীয় বৈঠকও হয়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিধনযজ্ঞ থেকে রেহাই পেতে ২০১৭ সালে নতুন করে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে এবং মূলত কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়। ফলে কক্সবাজারের প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় জনজীবনে নেমে এসেছে এক দুর্বিষহ অবস্থা। কঠিন প্রহরা সত্ত্বেও তাদের ক্যাম্পে রাখা যাচ্ছে না। রোহিঙ্গারা মাদক, অস্ত্র চোরাচালানসহ নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের নিজেদের মধ্যেও হানাহানি, খুনাখুনির ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাঝেমধ্যেই সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটে। কোনোটাই বাংলাদেশের জন্য ভালো সংবাদ নয়। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনই হচ্ছে একমাত্র সমাধান।
বিশ্বব্যাপী সংকট বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) বলছে, অদূর ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। রোহিঙ্গারা যদি অনির্দিষ্টকালের জন্য বাংলাদেশে অবস্থান করে, তাহলে বাংলাদেশের জন্য কী কী নিরাপত্তার সংকট সৃষ্টি হতে পারে, তার স্বরূপ ও বিস্তৃতি কেমন হবে এবং তার পেছনে দেশি-বিদেশি কোনো পক্ষ ও শক্তির কোনো হাত থাকতে পারে কি না ইত্যাদি বিষয় এখন বিশদভাবে বিবেচনা করতে হবে। বিবেচনা করতে হবে, গত পাঁচ বছরে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কেন যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করা গেল না। মিয়ানমার ও বাংলাদেশকে ঘিরে বৈশ্বিক, আঞ্চলিক এবং অন্যান্য কট্টরবাদী গোষ্ঠীর কোনো বৃহৎ স্বার্থ রয়েছে কি না প্রশ্নটাও এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। ১৯৭৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত রোহিঙ্গা ইস্যু বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের বিষফোড়া হয়ে আছে।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার বৃদ্ধির জন্য সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে। বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলো রোহিঙ্গাদের শিক্ষা, জীবিকা ও চলাফেরার সুযোগ বৃদ্ধির বিষয়টি সরকারের সঙ্গে আলোচনায় তুলছে। আবার এ দেশে রোহিঙ্গা শিবিরে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখাও সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষা করতে হলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কোনো বিকল্প নেই। কক্সবাজার বাংলাদেশের অত্যন্ত সংবেদনশীল ভূখ-। এই এলাকায় রোহিঙ্গাসহ অন্য সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং স্থানীয় জননিরাপত্তা ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন জরুরি।
কক্সবাজার ক্রমেই পর্যটন নগরী এইডসের নগরীতে পরিণত হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কক্সবাজারকে আধুনিক, পরিকল্পিত ও পর্যটকবান্ধব নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে নেয়া হয়েছে মহাপরিকল্পনা ছিল। উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার। কিন্তু যে আতংক এখন আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার প্রতিকারে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেই। এটি বড় উদ্বেগের। কক্সবাজারে সদর, উঁখিয়া, রামু এবং টেকনাফ এলাকার প্রতিটি হোটেলেই এখন রোহিঙ্গা পতিতা পাওয়া যায়। প্রচুর এইডস রোগীও এসব অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। প্রতিবছর বাড়ছে এইডস রোগীর সংখ্যা। কক্সবাজারের প্রায় সব হোটেল-মোটেলে এখন টাকা হলেই মিলছে পতিতা, যার বেশির ভাগই রোহিঙ্গা। এ ছাড়াও পর্যটন শহর হওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে টাকা আয়ের উদ্দেশ্যে যৌনকর্মীদের ব্যাপকহারে কক্সবাজার আগমন এইডস বিস্তারের আরেকটি কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। আক্রান্তের তালিকায় শুধু যুবক-যুবতী নয়, আছে শিশুরাও। রোহিঙ্গারা এসবে পারিশ্রমিক কম নেয় এবং তাদেরকে সহজে পাওয়াও যায়।
চলতি বছরের জুন মাসেও এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছে ১১ জন। কক্সবাজার জেলায় ২০১৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত ৭১০ জনের মধ্যে কক্সবাজার সদর হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করছে ৫০৫ জন। উঁখিয়া হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিচ্ছে ২০৫ জন। এদের মধ্যে ৬১২ জন রোহিঙ্গা ও ৯৮ জন স্থানীয়। এপর্যন্ত মারা যাওয়া ১১৮ জনের মধ্যে ৬১ রোহিঙ্গা এবং ৫৭ জন স্থানীয়। এমনকি যৌন সম্পর্কেও জড়াচ্ছে অনেকে। এ ছাড়াও কক্সবাজার হোটেল-মোটেল জোন এলাকায় রোহিঙ্গা নারী ছাড়াও যৌন কর্মীরদের রয়েছে অবাধ বিচরণ। ইউএনএইডসের তথ্যমতে, প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে ৩২ শতাংশ যৌনকর্মী এইডস রোগে আক্রান্ত। কক্সবাজারেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। কক্সবাজার সদর হাসপাতালের বর্তমান যে পরিসংখ্যানটি দেখানো হচ্ছে, যেহেতু এইডস দীর্ঘদিন পর্যন্ত শরীরে সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে, তাই প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি। আবার অনেকে আক্রান্ত হওয়ার পরও চিকিৎসা নিতে আসছে না। সবমিলে হিসাব করলে কয়েকগুণ রোগী এখনও চিকিৎসার বাইরেই রয়েছে বলা যায়। রোহিঙ্গারা আসার আগে এই রোগের প্রাদুর্ভাব তেমন ছিল না। তাদের কাছে এইচআইভি রোগের জীবাণু থাকার কারণে ও তাদের অবাধ মেলামেশা এবং এক জায়গায় বেশি সংখ্যক জনবল হওয়ার কারণে এইচআইভি ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এই রোগটি দীর্ঘমেয়াদি হওয়ার কারণে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয়দের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ছে। যারা আক্রান্ত হয়েছে, তাদের আলাদা না করার কারণে এই রোগ আরো ব্যাপকভাবে ছড়ানোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এইচআইভি নিয়ে কাজ করা একজন এনজিও কর্মীরা সাথে কথা বলে জানা গেছে, কক্সবাজারের বিভিন্ন হোটেল, মোটেল ও গেস্ট হাউসে ৫ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা তরুণীর যাতায়াত। তারা অনিরাপদভাবেই দেশি-বিদেশি পর্যটক ও স্থানীয়দের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করছে। তারা আরো জানিয়েছেন, বর্তমানে জেলায় রোহিঙ্গা ছাড়াও স্থানীয় ২ হাজারের মতো যৌনকর্মী রয়েছে, যাদের বেশিরভাগের এইচআইভি সম্পর্কে যথাযথ কোনো ধারণা নেই।
২০১৫ সাল থেকেই কক্সবাজার সদর হাসপাতালে এইচআইভি বা এইডস স্ক্যানিংয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। যেখানে এইডস নির্ণয়, কাউন্সিলিং ও চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের বাইরে যারা আছে, তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসার আওতায় আনার বিষয়ে কাজ করা হচ্ছে। তবে মারা যাওয়া ছাড়া এইডস আক্রান্ত জীবিতরা কে, কোথায়, কোন অবস্থায় আছে তার কোনো হিসাব সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে নেই। হাসপাতালে ন্যাশনাল এইডস বা এসটিডি কর্মসূচি নামে একটি প্রকল্প চালু আছে। ইউনিসেফের সহযোগিতায় হাসপাতালে এইচআইভি আক্রান্ত গর্ভবতী মায়েদের জন্য প্রিভেনশন মাদার টু চাইল্ড ট্রান্সমিশন (পিএমসিটি) নামে একটি প্রোগ্রাম চালু হয়েছিল। এ প্রোগ্রামে এইচআইভি পজিটিভ নারীর গর্ভের সন্তানটি যাতে সুস্থ থাকে সে লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে।
রোহিঙ্গারা যে হারে এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, সে তুলনায় শনাক্ত করা হচ্ছে কমই। প্রকৃত অর্থে আক্রান্তের সংখ্যা আরো অনেক বেশি। জেলা সদর হাসপাতালে নানা উদ্যোগ ছাড়াও মাঠপর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে উখিয়া ও টেকনাফে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার ১২টি টিম কাজ করছে। আমারা কক্সবাজার ও এর আশ পাশের এলাকায় এইডসের ভয়াবহতা কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারছি। এখন বাংলাদেশ সরকারের উচিত সংশ্লিষ্ট জায়গাগুলোতে আরো নিবিড়ভাবে কাজ করা এবং সতর্ক হওয়া।
লেখক : কবি, সাংবাদিক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি