সাম্য আর অসাম্প্রদায়িক চেতনার নজরুলের অভাব রয়েই যাবে
২৭ আগস্ট ২০২২ ১৯:০৪
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলা সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব এ কবি পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ- দুই স্থানেই সমানভাবে সমাদৃত। তার কবিতায় বিদ্রোহী মনোভাবের কারণে তাকে বিদ্রোহী কবি বলে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি ছিলেন চির বিদ্রোহী। দ্রোহ আর মানবতার জয়গানে উঁচুশির। বাঙালির জীবনে যিনি উজ্জ্বল নক্ষত্রের আলো ছড়ান। তার ক্ষুরধার লেখনী আজও বাঙালি জাতিকে প্রেরণা জোগায়। সাম্য আর অসাম্প্রদায়িক চেতনার মর্মবাণী উগ্র সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধের শক্তি জোগায়। যিনি অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে ধূমকেতুর মতো জ্বলে উঠে লিখেছিলেন ‘আমি মানি নাকো কোনো আইন, আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!’ কিংবা ‘গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান..’। তিনি বাংলাসাহিত্য ও সংগীতে দিয়েছেন নতুন মাত্রা। সেই চির বিদ্রোহী জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের আজ ৪৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৬ সালের এই দিনে (১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র) তিনি ঢাকায় তৎকালীন পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আজ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় জাতি স্মরণ করছে তাকে।
কাজী নজরুল ইসলাম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ (১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মে) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা কাজী ফকির আহমেদ, মা জাহেদা খাতুন। সীমাহীন দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হয়েও নজরুল কখনো অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। মাথা নত করেননি লোভ-লালসা বিত্ত-বৈভবের কাছে। আজীবন লড়ে গেছেন শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য। মানবতার মুক্তির পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কারের বিরুদ্ধেও ছিলেন তিনি উচ্চকণ্ঠ। মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার পক্ষে তিনি কলম ধরেছেন নির্ভীক চিত্তে। বাংলাসাহিত্যকে করে গেছেন সমৃদ্ধ। শুধু কবিতাতেই নয়, গান রচনায় নজরুল অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি প্রায় তিন হাজার গান রচনা ও সুর করেছেন। নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন।
১৯০৮ সালে তার পিতার মৃত্যু হয়, তখন তার বয়স মাত্র নয় বছর। পিতার মৃত্যুর পর পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে তার শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্থ হয় এবং মাত্র দশ বছর বয়সে জীবিকা অর্জনের জন্য কাজে নামতে হয় তাকে। এসময় নজরুল মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীায় উত্তীর্ণ হয়ে উক্ত মক্তবেই শিক্ষকতা শুরু করেন। একই সাথে হাজি পালোয়ানের কবরের সেবক এবং মসজিদের মুয়াযযিন হিসেবে কাজ শুরু করেন। এইসব কাজের মাধ্যমে তিনি অল্প বয়সেই ইসলামের মৌলিক আচার-অনুষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পান যা পরবর্তীকালে তার সাহিত্যকর্মে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। তিনিই বাংলা সাহিত্যে ইসলামী চেতনার চর্চা শুরু করেছেন বলা যায়।
একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক এবং অভিনেতাও ছিলেন নজরুল। তার কবিতা ও গান শোষণ-বঞ্চনা-পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছে। তাই বাজেয়াপ্ত হয় তার লেখা, কারাবরণ করেন নজরুল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও তার কবিতা ও গান ছিল বাঙালির অন্যতম প্রেরণার উৎস।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ১৯৭২ সালের ২৪ মে ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। তাকে দেয়া হয় জাতীয় কবির মর্যাদা। বাংলাসাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাজী নজরুলকে ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি তাকে দেয়া হয় একুশে পদক।
কাজী নজরুল ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অনন্য রূপকার। কবিতার দীপ্ত উচ্চারণে তিনি দ্রোহের আগুন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। পাশাপাশি সঙ্গীতেও তিনি সৃষ্টি করেছিলেন অনন্যতা। কবিতায় দ্রোহের আগুন জ্বেলেছিলেন, ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন শাসক-শোষকের। আবার প্রেমের মায়াজালে অমর সব শব্দকে গেঁথেছেন পরম মমতায়। তিনি ঝাঁকড়া চুলের কাজী নজরুল। স্বাধীন বাংলাদেশে তাকে জাতীয় কবির সম্মান দেওয়া হয়েছে। তার কবিতা ও গান মানুষকে যুগে যুগে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস।
মুক্তিযুদ্ধে তার সাহিত্যকর্ম যেমন যুদ্ধে সাহস যুগিয়েছিল ঠিক তেমনি বর্তমানে চলমান অসাম্প্রদায়িকতার যুদ্ধে তাঁর লেখনি অগ্রণী ভ’মিকা রাখত বলে মনে হচ্ছে। তাইতো তাঁর অভাব অনুভব করি এখনও। নজরুল আর আসবে না তবে আমাদের থাকতে হবে সাম্য ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে। কিন্তু সেই বাণীটি কে প্রচার করবে তা নিয়ে থাকবে হতাশা। এভাবেই সাম্য আর অসাম্প্রদায়িক চেতনার নজরুলের অভাব রয়েই যাবে প্রতিটি স্তরে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
গোপাল অধিকারী মুক্তমত সাম্য আর অসাম্প্রদায়িক চেতনার নজরুলের অভাব রয়েই যাবে