শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুইদিন ছুটি: একটু ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখি
২৮ আগস্ট ২০২২ ২০:৪৬
আগামী বছর থেকে শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। পাঠ্যপুস্তক, পরীক্ষা সবকিছুতেই পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসতেই এই উদ্যোগ। শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়নে পরিবর্তন জরুরি। উন্নত বিশ্বের সাথে মিল রেখে সবদিক থেকেই আমাদের প্রস্তুত হতে হবে। আগামী বছর থেকে পর্যায়ক্রমে এ ব্যবস্থা কার্যকর হতে যাচ্ছে।
এই পরিবর্তনের অংশ হিসেবে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সপ্তাহে দুই দিন ছুটি থাকবে। যা জ্বালানি সংকটের কারণে চলতি বছর থেকেই শুরু হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে অনেকেই সমালোচনা করছেন, তথ্যগত কিছু ভুলও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছি। অনেকেই এর ক্ষতিকর দিক নিয়ে উদ্বিগ্ন। উদ্বিগ্ন হতেই পারেন কিন্তু বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। ছুটির বা প্রতিদিনের কাজের ক্লান্তি থেকে মুক্তি মানুষকে কতটা কর্মদীপ্ত করে তুলতে পারে তা বুঝতে হবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরেও যেমন সপ্তাহে দুই দিন ছুটির প্রয়োজন রয়েছে তেমনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও রয়েছে। একঘেঁয়েমিত্ব দূর করতেই ছুটির দরকার। এখন যে ছুটি হয়েছে সেটা জ্বালানি সাশ্রয়ের কারণে। আর আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে তা বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। এই দুই দিন ছুটির বিষয়ে অনেকেই যা বলছেন তা সবক্ষেত্রেই সঠিক নয় বলেই আমার ধারণা। কারণ, যুগোপযোগী শিক্ষার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই দিন ছুটি প্রয়োজন। আর বিশ্বের সাথে অন্য সব বিষয়ে তাল মেলাতে হলে শিক্ষার ক্ষেত্রেও তাল মেলাতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি দুই দিন। এতে তাদের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। এদিকে শিক্ষা খাত গেল বলে এক শ্রেণি সমালোচনা করছেন। সমালোচনা করার আগে দুই দিন ছুটির ফলে ঠিক কি কি সুবিধা হবে বা এর পজিটিভ দিক কোনগুলো তা বিশ্লেষণ করে দেখা দরকার। বহু বছর ধরেই পরীক্ষা নির্ভর পড়ালেখার কারণে শিক্ষার্থীরা চাপে থাকে। তারা বাবা-মা’র সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হয়। স্কুল, কোচিং, প্রাইভেট তারপর বাড়িতে বিনোদন হিসেবে মোবাইল, ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তাদের ঘিরে ধরে একাকিত্ব। আর একদিন যে ছুটি এতদিন ছিল সেই শুক্রবারে নানা কাজে পরিবারকে সময় দেওয়া হয়ে ওঠে না। সন্তানকে পরিপূর্ণভাবে সময় দেওয়ার জন্য একটি দুই দিন ছুটি প্রয়োজন ছিল। অযথা বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর আগে একটি সময় দেওয়া দরকার এবং এর যে ভালো দিকগুলো রয়েছে তা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। তাছাড়া বিশ্বের অনেক দেশেই যদি এটা কার্যকর হয় তাহলে আমাদের দেশে তা সফলভাবেই বাস্তবায়ন হবে। এর ফলে শিক্ষকরা যেমন পরবর্তী দিনগুলিতে আরও বেশি কর্মক্ষম হবে এবং তারা বেশি উদ্যমে শেখাতে সক্ষম হবে তেমনি শিক্ষার্থীরাও এই বিরতির ফলে মনোযোগী হবে বলেই আমার বিশ্বাস। তাছাড়া আগে যেমন বৃহস্পতিবার অর্ধেক বেলা (প্রাথমিকে) ছিল এখন তো তা হচ্ছে না। পূর্ণ দিন ক্লাস করছে। তাহলে খুব বেশি ক্লাস মিস হওয়ার কথা না। সবচেয়ে বড় কথা, শিক্ষা পদ্ধতিতে একটি পরিবর্তন আসতে চলেছে। সেই পরিবর্তনকে গ্রহণ করতে হবে। সেই পরিবর্তন অনুসারে আমাদের নিজেকে এবং সন্তানকে প্রস্তুত করতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে পরিবর্তন আসবেই এবং তা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, স্বাধীনতার পর থেকে একটি শিক্ষাক্রম চলে আসছিল। এরপর ১৯৯৫ সালে ও ২০১৩ সালে আরও দুটি শিক্ষাক্রম প্রবর্তন করা হয়। এরমাঝে আবার ১৯৯২ সালে মূল্যায়নে এমসিকিউ যোগ করা, ২০০৮ সালে গতানুগতিক মুখস্থ বিদ্যা নির্ভর প্রশ্ন পদ্ধতির পরিবর্তে সৃজনশীল পদ্ধতির প্রয়োগ এবং ২০০১ সালে গতানুগতিক নম্বরের পরিবর্তে গ্রেডিং পদ্ধতির ফল তৈরি চালু হয়। একটি নতুন পদ্ধতি বা পরিকল্পনা প্রথমে চ্যালেঞ্জিং হয়। সেই চ্যালেঞ্জ নিতে হয়। তা না হলে পরিবর্তন আসে না।
বহুদিন ধরেই শিক্ষায় পরিবর্তনের কথা চলে আসছিল। প্রণয়ন করা হয়েছে নতুন কারিকুলাম যেখানে প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ধর্মশিক্ষাসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং শিল্পকলা বিষয় থাকবে। আর মাধ্যমিকে বাংলা, ইংরেজী, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞানের পাশাপাশি জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়েও শিক্ষার্থীরা শিখবে। আর যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি তা হলো পরীক্ষার চাপ কমে যাওয়া। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য নতুন কিছু শেখা। এই নতুন কিছু শিখতে গিয়ে তাদের ঘনঘন পরীক্ষায় বসতে হবে এবং তা করতে গিয়ে প্রচন্ড মানসিক চাপ নিতে হবে- শিক্ষার উদ্দেশ্য এটা হতে পারে না। তবে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই গতানুগতিক পরীক্ষা পদ্ধতিতে মূল্যায়নে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক দুপক্ষই অভ্যস্থ হয়ে গেছে। এখন সেটা যদি সেভাবে না হয়ে একটু ভিন্ন পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করা হয় তাহলে প্রথমে একটু ভিন্ন অনুভূতি আসা স্বাভাবিক।
যাই হোক, সত্যিকার অর্থে পরীক্ষা নিয়ে ছাত্রছাত্রীর মধ্যে এক ধরনের ভীতি কাজ করে এবং সেই সাথে উদ্বিগ্ন। আমরা যারা লেখাপড়া শিখেছি তারা সবাই এই অনুভূতির কথা জানি। কিন্তু স্কুলের সাময়িক পরীক্ষার পাশাপাশি একজন ছাত্রছাত্রীকে আমাদের দেশে শিক্ষাজীবনের একেবারে শুরু থেকেই পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়েছে। যার নাম ছিল পিইসি এবং জেএসসি পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষা আগেও ছিল পরে এই দুটো পাবলিক পরীক্ষা যোগ হয়। যেহেতু চলতি বছরও এই দুটি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে না সেহেতু ছাত্রছাত্রীরা আর কোনোদিন এই পরীক্ষার সম্মুখীন হবে না। কারণ নতুন শিক্ষাক্রমে যে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো এই দুই পাবলিক পরীক্ষা বাতিল, তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা না থাকা, দশম শ্রেণির পাঠ্যক্রমের ওপর ভিত্তি করে এসএসসি পরীক্ষা এবং উচ্চ মাধ্যমিকে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটো পাবলিক পরীক্ষা। প্রতিবর্ষ শেষে বোর্ডের অধীনে এই পরীক্ষা হবে। এরপর এইদুই পরীক্ষার ফলের সমন্বয়ে এইচএসসির চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হবে। তবে মূল্যায়ন থাকছে। ধারাবাহিকভাবে মূল্যায়ন করা হবে। যার বেশিরভাগই থাকছে শিক্ষকদের হাতে।
নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে মূল্যায়নের বিষয়টি একটু ভিন্ন যা নির্ভর করবে শিক্ষকের দক্ষতার ওপর। এখানেই প্রাথমিকভাবে একটু সতর্ক থাকতে হবে। যদিও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। কিন্তু এই যে সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হয় সেখানে বহু বছর পার হলেও এখনও কি সব শিক্ষককে সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়নে দক্ষ করা গেছে? যায়নি। সেখানেই ভয়। আরও একটি ভয় আছে। তা হলো শিক্ষকদের হাতে নম্বর থাকায় প্রাইভেট নির্ভরতা বাড়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, মার্কস পেতে আজও অনেক ছাত্রছাত্রী না চাইলেও প্রাইভেট পড়তে যায়। হয়তো বেশিরভাগই। ফলে সে পাঠ অগ্রগতির সাথে সাথে নিজেকে কতটুকু শৃঙ্খলায় আনতে পারছে তার মূল্যায়ন করা যাচ্ছে না। আমাদের দেশে শেখার মূল বিষয়টা পাঠ্য বই এবং পরীক্ষায় ভাল ফলাফলেই আটকে আছে। একটা মেয়ে যদি গণিতে ভাল করে কিন্তু ইংরেজীতে ভাল না করে সেক্ষেত্রে সে ঐ বিশেষ বিষয়ে দুর্বল কিন্তু কোনক্রমেই সে সার্বিকভাবে খারাপ নয়। সব বিষয়েই দক্ষ হয়ে গড়ে উঠতে হবে এমন ধারণা ঠিক নয়। কেউ ভালো দৌড়ায়, কেউ ভাল গান করে, কেউ আবৃত্তি করে, কেউ বা নাচে আবার কারও একাডেমিক দিক শক্তিশালী।
শিক্ষা হলো আনন্দের বিষয়। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষা আর আনন্দের বিষয় নেই। দিনরাত স্কুল, কোচিং আর প্রাইভেটের পর বাড়িতেও পড়ার চাপ থাকে কারণ তাকে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতে হবে। একশর মধ্যে একশ মার্কসই পেতে হবে এমন চাপ থাকে। বাবা-মা নিজেরাই সন্তানকে চাপে রাখে। এই চাপ থেকে তার শিখন প্রক্রিয়া হয়তো চলছে কিন্তু মানসিক যে বিপর্যয় ঘটছে তার খোঁজ কেউ রাখছে না। এতদিন যখন একদিন ছুটি ছিল তখন সেই শুক্রবারেও অনেক ছাত্রছাত্রীকে প্রাইভেট পড়তে যেতে হয়, অতিরিক্ত পড়তে হয়। তাই দুই দিন ছুটিতে সে একটু হলেও মানসিক প্রশান্তি পাবে। অভিভাবকরা তাদের সন্তানকে কাছে টানার সুযোগ পাবে। বাবা না হলেও মায়ের আদরে থাকার সুযোগ পাবে। তাকে পড়তে হবে ঠিকই কিন্তু সেই রীতিবদ্ধ ক্লাসের পড়া তৈরির যে চাপ সেটি থাকবে না। এটাই বা মানসিক শান্তির জন্য কম কিসে? সুতরাং পড়ালেখার গতি ঠিকই বাড়বে। আর আমাদের মূল উদ্দেশ্য হলো পড়ালেখা করানো। দুই দিন ছুটি নিয়ে তাই এত অসত্ত্বির কারণ দেখছি না।
লেখক: শিক্ষক ও মুক্ত গদ্য লেখক
সারাবাংলা/এজেডএস