করোনা মহামারী এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বৈশ্বিক মন্দায় সম্প্রতি দেশে জ্বালানী তেল ও সারের দাম বাড়িয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে জ্বালানী তেলে লিটারপ্রতি আবার পাঁচটাকা কমেছে। এতোকিছুর মধ্যে আমন ধানচাষের ভরা মৌসুমে একপ্রকার অনিশ্চয়তায় দিনানিপাত করছে এদেশের প্রান্তিক পর্যায়ের ধানচাষীরা। যেহেতু আমি নিজেই ধানচাষের সাথে জড়িত, সেহেতু বিষয়টা খানিকটা হলেও বুঝতে পারি। ধানচাষে উৎপাদন খরচ বেড়েছে বহুগুনে কিন্তু সেই অনুপাতে ধানের দাম কেমন বাড়ে সেটাই আপাতত দেখার বিষয়।
এদেশের কৃষকরা চাষের জন্য রাসায়নিক সারের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। কারণ আমাদের দেশে অর্গানিক চাষে বানিজ্যিকভাবে এখনো আগাতে পারেনি। বর্তমানে দেশে রাসায়নিক সার নিয়ে একপ্রকার অস্থিরতা কাজ করছে। দামবৃদ্ধির সাথে সাথে অবৈধ মজুদদাররা উঠেপড়ে লেগেছে দেশে সারের কৃত্তিম সংকট তৈরীর জন্য। অবশ্য এখানে রাজনৈতিক ফাঁয়দাও থাকতে পারে। এদেশে সারের দাবিতে আন্দোলনরত কৃষককে গুলি করে হত্যার ইতিহাসও আছে। অথচ আমাদের পুরো অর্থনৈতিক ভিত্তির বড় অংশ জুড়েই আছে কৃষক এবং কৃষি।
বর্তমানে প্রশাসন সারের অবৈধ মজুদদার, অব্যবস্থাপনা কিংবা অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষনা করেছে। পত্রিকায় পাতায় চোখ বুলালে প্রতিদিন সার নিয়ে অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান, জরিমানা কিংবা কারাদন্ডের মত শাস্তি চোখে পড়ছে। বিশেষ করে আমাদের যশোরের বিভিন্ন উপজেলায় এইসব অভিযান উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এইসব কর্মকান্ডে অবশ্য যশোরের জেলা প্রশাসক জনাব তমিজুল ইসলাম খান’কে অবশ্যই ধন্যবাদ দেয়া যেতে পারে। কারণ তিনি পুরো বিষয়টা আন্তরিকতার সাথে মনিটরিং করছেন।
কৃষি অফিসের তথ্যমতে দেশে সারের কোন সংকট নেই। কৃষক পর্যায়ে যাতে ন্যায্যমূল্যে সার পৌঁছায় সেজন্য এই দপ্তরের সকলে আন্তরিকতার সাথে কাজ করছেন। উপজেলায় কর্মরত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা এখন সকাল-সন্ধ্যা সারের ডিলাররদের দোকান-গুদামে ডিউটি করছেন। এই বাড়তি পরিশ্রমের কারণ যাতে কৃষক ন্যায্যমূল্যে সার পায়। ডিলাররা সার ব্যবস্থাপনায় যাতে কোন কারসাজি না করতে পারে যেজন্য তারা তৎপর।
এতকিছুর পরেও কি আসলে কৃষক ন্যায্যমূল্যে তাদের চাহিদা অনুযায়ী সার পাচ্ছে? কৃষক আসলে ঠিক কি সমস্যার সম্মুখিন হচ্ছে, কারণ এবং উত্তরণের উপায় সম্পর্কে আমার আজকের এই লেখা।
উপজেলা পর্যায়ে কারা বিএডিসি ডিলার, কারা বিসিআইসি ডিলার এবং কারা খুচরা পর্যায়ের বিক্রেতা তাদের সম্পর্কে কৃষক পুরোপুরি অবগত নয়। সার বিক্রির জন্য এই তিন শ্রেণির ব্যবসায়ী ছাড়া আর কারো অনুমতি নেই। অথচ কৃষক কিন্তু গ্রামের বাজারের বিভিন্ন দোকান থেকে সার কিনে অভ্যস্ত। অবশ্য এইসব বিক্রেতার অধিকাংশেরই সার বিক্রির অনুমতি নেই। কৃষক এদের কাছ থেকে সার কেনার বড় একটা কারণ হচ্ছে ‘বাকিতে ক্রয়’। প্রান্তিক চাষীদের নগদ টাকায় সার কেনার মত পুঁজি অধিকাংশ সময় থাকেনা এজন্য এরা গ্রামের এইসব দোকান থেকে বেশি দাম হলেও বাকিতে কিনতে অভ্যস্ত।
এই সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য কিছু পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। নির্দিষ্ট ডিলারপয়েন্ট থেকে কৃষককে সার কিনতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালানো যেতে পারে। এক্ষেত্রে উপজেলাভিত্তিক কৃষি অফিসের ওয়েবসাইটে ডিলারদের বিস্তারিত তথ্য দিয়ে দেয়াটা প্রথম পদক্ষেপ। দ্বিতীয়ত ব্যাপকভাবে মাইকিং এবং মসজিদের ইমাম, ইউপি মেম্বররদের অবগত করার করার মাধ্যমে কৃষকের কাছে ডিলারদের তথ্য পৌঁছাতে হবে এবং তারা যেন সেখান থেকেই সার কেনে সেজন্য তাদের সচেতন করতে হবে।
ওয়ার্ড পর্যায়ে খুচরা বিক্রেতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। ইউনিয়নে বিসিআইসি ডিলারের আন্ডারে যদি সর্বোচ্চসংখ্যক খুচরা বিক্রেতা সৃষ্টি করা যায় তাহলে কৃষকের সার পেতে আর কোন ঝামেলা পোহাতে হবেনা এবং তারা ন্যায্যমূল্যে সার কিনতে পারবে।
একজন কৃষক সবসময় বস্তা ধরে সার কিনতে পারেন না। প্রয়োজনে তাদের পাঁচ কেজি, দশ কেজি খুচরা সার কিনতে হয়। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় বিসিআইসি ডিলাররা এসব খুচরা সার বিক্রি করছেন না। এজন্য খুচরা বিক্রেতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। সামান্য পরিমান সার কিনতে একজন কৃষকের যদি দীর্ঘ সময় ব্যয় করে পাঁচ/দশ কিলোমিটার দূরে যেতে হয় তাহলে বিষয়টা অবশ্যই দুঃখজনক।
দেশে কৃত্তিম সার সংকট ও অকারণে দাম বৃদ্ধির সবথেকে বড় কারণ বিভিন্ন স্তরের ডিলার। খোঁজ নিলে দেখা যাবে উপজেলা পর্যায়ে এমন ডিলার পাওয়া যাবে যাদের অস্তিত্ব শুধু খাতা কলমেই সীমাবদ্ধ। এদের কোন দোকান-গোডাউন নেই কিংবা সারের ব্যবসাও নেই৷ তাদের নামে অন্যরা ব্যবসা করেন। এদের চিহ্নিত করে লাইসেন্স বাতিল করে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের দিলে কৃষক উপকৃত হবে।
কৃষক পর্যায়ে ন্যায্যমূল্যে সার পৌঁছাতে তদারকির বিকল্প কিছু নেই। এজন্য প্রশাসনকে আরো তৎপর হতে হবে। বেশি বেশি ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করতে হবে। সর্বোপরি কৃষি দপ্তরকে এইসব মজুদদার ডিলারদের রুঁখতে কঠোর হতে হবে।
সর্বশেষে কিছু প্রস্তাবনা আছে, এগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে আশা করা যায় সার নিয়ে আর কারো কারসাজি কোন কৃত্তিম কংকট তৈরী করতে পারবেনা। কৃষক পর্যায়ে ন্যায্যমূল্যে চাহিদা অনুযায়ী সার পৌছাবে।
ডিলার ও সাব ডিলারদের নাম, মোবাইল নম্বর, ঠিকানাসহ বিস্তারিত তথ্য সংশ্লিষ্ট কৃষি অফিসের ওয়েবসাইট ও অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজে প্রকাশ করতে হবে। এবং কৃষক পর্যায়ে যাতে এইসব তথ্য পৌছায় সেজন্য মাইকিংসহ অন্যান্য মাধ্যমে প্রচার বাড়াতে হবে। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা যেহেতু কৃষকদের সাথে সরাসরি যুক্ত থাকেন, কৃষক সচেতনতায় তাদের কাজে লাগানো যেতে পারে।
কোন ডিলার কবে কত বস্তা কী সার পেয়েছে তার সঠিক তদারকি করতে হবে। একজন বিসিআইসি ডিলার প্রতিদিন সাব ডিলারের কাছে এবং কৃষকের কাছে কত বস্তা সার বিক্রয় করেছে, তাদের নাম ও মোবাইল নম্বরসহ ওয়েবসাইট কিংবা ফেসবুকে হালনাগাদ করতে হবে। নিয়ম অনুযায়ী একজন ডিলার তার প্রাপ্ত ৫০ ভাগ সাব ডিলার ও ৫০ ভাগ সার সরাসরি কৃষকের কাছে বিক্রয় করতে পারবে।
কোন সাব ডিলার কবে কত বস্তা সার কোন ডিলারের কাছ থেকে কিনেছে এবং প্রতিদিন কোন ব্যক্তির কাছে কতটুকু বিক্রয় করেছে তাদের নাম ও মোবাইল নম্বরসহ একটা খসড়া তৈরী করতে হবে এবং প্রকাশ করতে হবে।
এসব তথ্য রিপোর্ট আকারে প্রতিদিন উপজেলা কৃষি অফিস তাদের ওয়েবসাইটে আপলোড দিলে এবং তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে প্রকাশ করলে অনিয়ম ধরাটা একেবারেই সহজ হয়ে যাবে।
করোনাকালীন সময়ে সময় সাস্থ্য বিভাগ করোনা পজেটিভ, নেগেটিভ, সুস্থ, মৃত্যু ইত্যাদি তথ্যসহ প্রতিদিন তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতো এবং হাসপাতালে একটি বোর্ডেও লিখে দিতো সাধারণ মানুষের সুবিধার্থে। স্বাস্থ্য বিভাগ পারলে কৃষি বিভাগও পারবে কারণ তাদের যথেষ্ঠ জনবল আছে। এই কাজগুলো আন্তরিকতার সাথে করতে পারলে সার নিয়ে সৃষ্ট সমস্যাগুলো অনেকটাই সমাধান সম্ভব। অন্তত ১মাসও যদি এই রিপোর্টিং প্রক্রিয়া জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয় এবং সংবাদকর্মীদের জন্য তথ্য উন্মুক্ত করা হয় তাহলে সার সংকটের সমস্যা অনেকটাই কমে যাবে। পাইলটিং হিসেবে একটি উপজেলায়ও এটা চালু করা যেতে পারে।
লেখক: সংবাদকর্মী ও কৃষক