বাংলাদেশে কি অসাম্প্রদায়িক কথাটা চর্চা হচ্ছে?
৩০ আগস্ট ২০২২ ১৬:৫১
ছোটবেলা থেকেই সবচেয়ে বড় যে বিশেষ অভ্যাসটা আমাদের সাথে করা হয়েছে তা হচ্ছে, আমাদের বিশ্বাস করানো হয়েছে বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। এই দেশে একসাথে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ মিলেমিশে থাকে, প্রত্যেক মানুষ অন্য মানুষের ধর্মকে শ্রদ্ধা করে—এরকম কথা শুধু আমাদের পাঠ্যপুস্তকেই না, পত্র পত্রিকা, টেলিভিশন আলোচনা সহ সব জায়গাতেই করা হয়। এবং আমার মনে হয় যে বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র-এমন ক্লিশেটাই হচ্ছে এই দেশের সাম্প্রদায়িক মানুষগুলার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। ধরুণ, কোন লেখক বা বুদ্ধজীবী কোন আলোচনায় দাবি করলেন যে বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র নয়-তার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে? দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘটে যাওয়া সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারকে বিচ্ছিন্ন ও গুটিকয়েক মানুষের কার্যাবলি দাবি করে সবাই তৃপ্তির ঢেকুর তুলবে, বলবে এই ছোটখাটো ঘটনা দিয়ে আমাদের অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তিকে খাটো করা উচিত নয়। সাম্প্রদায়িকতার বীজ যে আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সেইটাকে অস্বীকার করাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় ট্রিক আমাদের! আমি নিজেও দেখেছি যে ফেসবুকে পুজা মন্ডপ ভাঙ্গার নিউজ শেয়ার দিলে তখন অনেক সুশীল চিন্তাধারার মানুষই বলার চেষ্টা করে যে এগুলা আসলে গুটিকয়েক মানুষ করেছে, ঐ গুটি কয়েক মানুষের কর্মকান্ডের জন্য বাংলাদেশের আপামর জনতাকে দোষী সাব্যাস্ত করা ঠিক হবে না, বাংলাদেশে এখনও বিশ্বের ‘অনেক দেশের চেয়ে’ অসাম্পদায়িক, কাজেই এতো হতাশ হওয়ার কিছু নেই, ঐতিহাসিকভাবে আমরা অসাম্প্রদায়িক, কাজেই এই ঘটনা দিয়ে পুরো জাতিকে বিচার করা ঠিক হবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। এই ধরণের আর্গুমেন্টে কয়েকটি সমস্যা আছে।
১)মূল সমস্যা, এই আর্গুমেন্ট হচ্ছে ডেনায়াল আর্গুমেন্ট, প্রথমত গুটিকয়েক মানুষের কর্মকান্ড বলে ঘটনার গুরুত্ব আপনি কমিয়ে দিলেন, আর এই ডেনায়াল আর্গুমেন্টের মূল বেজলাইন হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত একটি মিথ-বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র।
২) বাংলাদেশে এখনও বিশ্বের ‘অনেক দেশের চেয়ে’ অসাম্প্রদায়িক—এই কথার মাধ্যমে আপনি বুঝালেন অন্যান্য রাষ্ট্রেও যখন এরকম হয় তখন বাংলাদেশে এরকম ১-২ টা ঘটনা ঘটতেই পারে। বরং বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রয়িক রাষ্ট্র বলে এখানে এই ধরণের ঘটনা কম হচ্ছে। সুতরাং এতো প্রতিক্রিয়া দেখানোর কিছু নেই।
অর্থাৎ বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র, এই কথাটা বলে আসলে আপনি কিন্তু একটা বড় অন্যায়ের গুরুত্ব নিমেষের মধ্যে অনেকখানি কমিয়ে ফেললেন। অন্যভাবে বলা যায়, দেশে বিরাজমান সাম্প্রদায়িকতার অত্যন্ত দৃশ্যমান রূপকে আপনি ভুলিয়ে দিতে পারলেন একটা সুন্দর বাক্যের আড়ালে। আর এভাবেই বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ এই সুন্দর কথায় সবাইকে খুশি রাখতে রাখতে সাম্প্রদায়িকতা কিন্তু অগোচরে ঠিকই বিস্তার লাভ করে বসে আছে!
মোরশেদ শফিউল হাসান ভাষ মতে, “পাকিস্তান আমলেও হিন্দু প্রতিবেশীর ওপর হামলা ঠেকাতে গিয়ে আমীর হোসেন চৌধুরীসহ কয়েকজন প্রাণ দিয়েছিলেন। আজ স্বাধীন, ‘অসাম্প্রদায়িক’ বাংলাদেশে স্থানীয় পর্যায়ে কোনো জনপ্রতিনিধি, সরকারি দলের ক্যাডার, ‘প্রগতিশীল’ রাজনৈতিক দল বা সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীকে ঘটনার সময় আক্রান্ত মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে দেখা যায় না কেন? চেষ্টা করতে গিয়ে কেউ আহত হয়েছেন এমন একটা নজিরও কি আছে? ঘটনা ঘটে যাবার পর রাজধানীতে বসে বক্তৃতা-বিবৃতি-মানববন্ধন আর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এসে সাংবাদিক সম্মেলনে ঘটনার ‘সুষ্ঠু’ তদন্ত ও বিচার এবং দোষীদের শাস্তি দাবির মধ্যে আমাদের সক্রিয়তা আর কতদিন সীমাবদ্ধ থাকবে?
দেশের নানা স্থানে অর্বাচীন কাউকে না কাউকে দিয়ে কিংবা তাদের নাম ব্যবহার করে এভাবে বারবার সামাজিক মাধ্যমে আপত্তিকর কটূক্তি আপলোড করে উস্কানি বা উত্তেজনা সৃষ্টি কোনো বৃহত্তর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বা পরিকল্পনার অংশ কিনা, এর পেছনে দেশি-বিদেশি কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের চক্রান্ত বা যোগসাজশ কাজ করছে কিনা, আর সে-সম্পর্কে জেনেবুঝেই আমরা সীমিত বা রুটিন প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়ার নীতিকৌশল অনুসরণ করছি কি না, এটাও এ প্রসঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার বিষয়।”
তাছাড়া এই সাম্প্রদায়িক হামলা বেড়েই চলেছে যেমন আইন ও শালিস কেন্দ্রের হিসেব মতে, ২০১৩ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২১ পর্যন্ত মোট ৩৬৭৯টি সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, অর্থাৎ বছরে গড়ে প্রায় ৪৬০টি ঘটনা ঘটেছে গত আট বছরে। অন্য অর্থে, গড়ে ১.২৬টি ঘটনা ঘটেছে প্রতিদিন। এসব ঘটনায় ১১ জন খুন হয়েছেন এবং ৮৬২ জন আহত হয়েছেন। অর্থাৎ মোট ঘটনার সাপেক্ষে শারীরিক ক্ষতির (যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণ ছাড়া) হার ২৪%। এ ছাড়া ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন, মন্দিরে হামলা এবং লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। রিপোর্টটিতে এসব ঘটনার নির্দিষ্ট সংখ্যা উল্লেখ করা আছে। ২০১৪ সালের নির্বাচন পরবর্তী সময়ে ৭৬১টি বাড়ি, ১৯৩টি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান এবং ২৪৭টি মন্দির আক্রান্ত হয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো, এই এতগুলো ঘটনার পরও একটিও মামলা হয়নি বা বিচার হয়নি কোনো ঘটনার। ভাবা যায় এমন অবস্থা কোনো সভ্য দেশে? যদি কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হতো তাহলে ২০২২ এ এসে কোনো সাম্প্রদায়িক হামলা হতো না।
এবার দেশের বাইরের রিপোর্টগুলোর কথা একটু বলা যাক। বিশ্বব্যাংকের ‘ফ্রিডম অব রিলিজিয়ন’ নামের রিপোর্টে উদ্বেগজনক তথ্য পাওয়া যায়। দেখা যাচ্ছে ১৯৭৫ সালে ধর্মীয় স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ১০০ তে ৭৮ যেটি মোটামুটি ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত কম-বেশি একই রকম ছিল; ১৯৯৬ সালে এ স্কোরটি বেড়ে ৮৮-তে উন্নীত হয়; ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত সময়ে এটি ছিল ৮৬। লক্ষণীয় এই যে, ১৯৭৫ থেকে ২০০১ পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশের এই স্কোর আঞ্চলিক এবং বিশ্বের মিডিয়ান স্কোরের ওপরে ছিল যদিও ১৯৮৮ এবং ১৯৯১ সালে দুটি দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের বছর (২০০১) এটি কমে গিয়ে ৭৯ হয়ে গিয়েছিল। এরপর থেকেই বাংলাদেশের পিছু হটা শুরু হয়। এবং বর্তমানে একের পর এক সাম্প্রদায়িক হামলা আঘাত হানছে। অসাম্প্রদায়িক কথাটার অপব্যবহার হচ্ছে।
লেখক: শিক্ষার্থী
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
কবিতা রাণী মৃধা বাংলাদেশে কি অসাম্প্রদায়িক কথাটা চর্চা হচ্ছে? মুক্তমত