ঠগবাজি থেকে কীভাবে বাঁচবে বিএনপি?
৩১ আগস্ট ২০২২ ১৩:১৭
‘বিএনপি আগামীতে মুসলিম লীগ হয়ে যাবে’, ‘দলটির মরা গাঙে আর জোয়ার আসবে না’, ‘এ বছর না সেই বছর বিএনপির আন্দোলন কোন বছর’- ক্ষমতাসীন দল থেকে এ ধরনের তাচ্ছিল্যের মন্তব্যের সঙ্গে অবিরাম ইঙ্গিতবহ প্রশ্নও ছোঁড়া হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল থেকে। সর্বশেষ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানতে চেয়েছেন, বিএনপির ইমাম কে? বিএনপি কে সরকার হটানোর? আগামীতে কে হবেন বিএনপির প্রধানমন্ত্রী? বিএনপির দিক থেকে এ ধরনের প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতার মাঝেই মুখ খুলেছেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি জবাব দিয়েছেন একবাক্যে। জানিয়েছেন, তাদের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। মির্জা ফখরুলের এমনতর জবাবে দমেননি সরকারি দলের নেতারা। জবাবটির কোনো মার্ক দিতে চান না তারা। বরং অগ্রাহ্য করে তারা বলেই চলছেন, খালেদা-তারেক নির্বাচনে অযোগ্য হয়ে গেছেন। তারা আর নির্বাচন করতে পারবেন না।
এ ধরনের বাহাসে যেতে চায় না বিএনপি। সরকারের তরফে এ ধরনের প্রশ্ন ও মন্তব্যের উদ্দেশ্য ভালো করেই উপলব্ধি করছে তারা। তাই এ ধরনের প্রশ্নও মন্তব্যে গা না মেখে বিব্রত হওয়া থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে বিএনপি। দলটির একনিষ্ঠ কর্মী-সমর্থকরা জানেন, তাদের নেত্রী ভাঙলেও মচকানোর নন। এটা তার বৈশিষ্ট্য। পারিবারিক, ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক নানা ট্রাজেডি আর বয়স মিলিয়ে রোগে-শোকে অনেকটাই বিপর্যন্ত তিনি। কারাগার হয়ে হাসপাতাল-আর বাসায় শয্যাশায়ী ৭৬ বছর বয়সী খালেদা জিয়া। তিনি বেশ কিছু রোগে অনেকদিন ধরেই ভুগছেন। বিশেষ করে লিভার, কিডনি, আর্থরাইটিস, হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস এগুলো তার আগে থেকেই ছিল। করোনায় আক্রান্ত হয়ে তিনি অনেকদিন হাসপাতালেও ছিলেন। বাঘকে খাঁচায় বন্দি করে তার সাথে যেমন দর্শক ভেংচি কাঁটে, খোঁচা মারে, বেগম জিয়ার সাথেও ক্ষমতাসীনরা ওই কাজটিই করছে। উন্নত চিকিতসার জন্য বিদেশে যেতে প্রথমে দিতে চায়নি, পরে শর্ত দিয়েছিলো, রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইলে যেতে দেয়া হবে। কিন্তু সেই শর্ত নাকচ করে দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। বিদেশ থেকে ডাক্তার এনে চিকিৎসার সুযোগও তিনি নেননি। এর পরিণতিতে শারিরীক-মানসিক দু’ভাবে পর্যুদস্ত হয়ে চলছেন তিনি। তার দৃশ্যত কোনো ভূমিকা নেই দল পরিচালনার। আবার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশান্তরি। এরপরও বিএনপি চলছে। এগুচ্ছেও। নেতৃত্বহীন অবস্থার মাঝেই মাঠের আন্দোলন চাঙ্গা হচ্ছে ক্রমশ। যা কেবল বিশ্লেষণ নয়, রাজনৈতিক গবেষণারও বিষয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তী সময়ে ক্ষমতার চোরাগলিতে বিএনপির জন্ম। মাত্র সাড়ে ৩ বছরের শাসনে ছিলেন দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। ৮১তে তার হত্যাকাণ্ডের পর ৮২তে ক্ষমতাচ্যুত। এরপর ক্ষমতা পুনুরুদ্ধারে অপেক্ষা করতে হয় টানা ৯ বছর। সেই সাফল্য আসে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে। এরপর আরেক দফায় ২০০১ সালে বিশাল জয়ে ক্ষমতা পায় বিএনপি। আর পঁচাত্তর ট্র্যাজেডিতে ক্ষমতাচ্যুতির পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ফিরে পায় ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে। ২০০১ সালে নির্বাচনে হেরে পরের মেয়াদেই ২০০৯ সালে আবার ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। সেই থেকে আর ক্ষমতা ছাড়তে হয়নি। তাদের টানা ১৩-১৪ বছর ক্ষমতা আকড়ে থাকার সাফল্যের বিপরীতে বিএনপির সময় যাচ্ছে নাস্তানাবুদ দশায়। সময়-প্রেক্ষিত সবই বদলে গেছে।
ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতার ইতি টানতে চান না। এটাই হয়তো স্বাভাবিক। এ কাজে আজকের ক্ষমতাসীনরা কেবল সফলই নন,অস্বাভাবিক নানা উদাহরণও তৈরি করে আসছেন। তা চলতেই থাকবে? এর জের কোথায় গিয়ে ঠেকবে?-এ প্রশ্নের পাশাপাশি গুরুতর প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে সামনের দিনগুলোতে বিএনপির কী হবে? কী ঝুলছে দলটির ভাগ্যে। মুসলিম লীগ হয়ে যাবে না ফের ক্ষমতায় আসবে? নাকি এর মাঝামাঝি কিছু? সরকার ভয় পাচ্ছে কেবল বিএনপিকেই। তাই দলটিকে নিঃশেষের চেষ্টায় একটুও কমতি করছে না। অনেকে বলছেন, বেগম জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ দিলে, সেখানে মা-ছেলে মিলে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবেন৷ কিন্তু প্রথম কথা হলো, বেগম জিয়ার যা বয়স এবং তার শারীরিক যে অবস্থা তাতে তার ষড়যন্ত্র করার ইচ্ছা থাকলেও সক্ষমতা নেই। তার চেয়ে বড় কথা,ডিজিটাল বিশ্বে এখন আর ষড়যন্ত্র করতে একত্রিত হওয়ার দরকার করে না। কিন্তু, সরকারের দিক থেকে চেষ্টায় কোনো কমতি নেই। বরং বিএনপিকে মুসলিম লীগ- ন্যাপের চেয়েও দুর্গতিতে ফেলার চেষ্টা জোরদার। এ থেকে কিভাবে রেহাই মিলবে বিএনপির?
দলের নেতারা বলে আসছেন, ‘বিনা ভোটে ১৫৩ এমপির জিতে যাওয়া’ বা ‘রাতের ভোট’ আর হতে দেবেন না তারা। আসলে কি তাই? সরকার কমজোরি হয়ে গেছে? বিএনপির শক্তি বেড়ে গেছে?–এ প্রশ্নেরও স্পষ্ট জবাব নেই। আবার দৃশ্যত বিএনপির অগ্রগতির তথ্যও নেই। বরং বিএনপিকে নাকানিচুবানি খাওয়ানোর এন্তার আয়োজন চলছে। ড.কামাল হোসেনকে ইমাম মেনে যুক্তফ্রন্টের ব্যানারে করা নির্বাচনে প্রতারিত হয়েছে বলে দলের নেতারাও মন্তব্য করেছেন। বলছেন, আগামীতে আর তা হবে না। তার মানে বিনা ইমামতিতেই নির্বাচন করবেন? –এ প্রশ্নেরও জবাব নেই। তবে, আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে আরেকটি ঘোরটোপে ফেলার গুঞ্জন বেশ চাউর। গুঞ্জনটির সারাংশ হচ্ছে- বিএনপিকে একটি প্যাকেজ ডিলে ফেলে একটি চরম আছাড় দেবে সরকার। এ চেষ্টায় সরকারের পক্ষে এবার ইমামতির মতো দায়িত্বে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। আর সহযোগী বিএনপির এক সময়ের পাওয়ার মেকার, বেগম খালেদা জিয়ার একান্ত বিশ্বস্ত মোসাদ্দেক আলী ফালু। চাচা-ভাতিজার এই মিশনে রাখা হয়েছে শেখ হাসিনাকে টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় রাখা এবং বিএনপিকে ২০২৯ সালে ক্ষমতায় আনার গ্যারান্টি ক্লজ। ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো নয়, দৃশ্যত সুষ্ঠু-অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমেই তা বাস্তবায়নের ছক আঁকা হয়েছে।
এই মুহুর্তে শেখ হাসিনার পতন ঘটিয়ে সরকার পরিচালনার সামর্থ নেই বিএনপির, দ্রব্যমূল্যসহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামলানো কঠিন হবে- তাই আরেক মেয়াদে ক্ষমতার বাইরে থাকলে তাদের জন্য ভালো হবে-এমন একটি বুঝ গেলানো হচ্ছে। শোনা যায়, এর বাইরে চিন্তা করলে তৃতীয় শক্তির উত্থানে আওয়ামী লীগের সাথে নিজেদের রাজনীতিও ম্যাসাকার হয়ে যাওয়ার ভয় গেলানো হয়েছে বিএনপির একটি অংশকে। এর চেয়ে এবার একশ চল্লিশটির মতো সিট নিয়ে বিরোধীদলে বসা বিএনপির জন্য ঝুঁকিমুক্ত এবং সম্মানের। বলা হয়েছে, বিএনপি নাকে তেল দিয়ে ঘুমালেও এ আসনগুলোতে জিতবে ধানের শীষ প্রতীক। সেইসঙ্গে দেয়া হবে নির্বাচনের যাবতীয় খরচপাতি। বেগম খালেদা জিয়াকে অন্ধকারে রেখে এ ধরনের প্যাকেজের খবর ফাঁস হয়ে গেছে মাঝপথে। এতে যারপরনাই ক্ষুব্ধ তিনি। এর সঙ্গে লন্ডনে অবস্থানকারী তারেক রহমানের আগ্রহ বা সম্পৃক্ততা রয়েছে কিনা, এ সংক্রান্ত তথ্য নেই। খালেদা জিয়ার অসুস্থতা ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিএনপিকে প্যাকেজের আওতায় প্যাকেট করে ফেলার এমন তৎপরতা সত্যি-সত্যি হয়ে থাকলে এর সাফল্য-ব্যর্থতা দুটাই নির্ভর করছে বিএনপির ওপর।
লেখক: সদস্য, বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি