Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সাম্প্রদায়িক উস্কানির প্রতিবাদ করাই ঝুমনের অপরাধ?

রহমান রা’দ
৩১ আগস্ট ২০২২ ২০:২১

সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে ‘শানে রিসালাত সম্মেলন’ নামে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে ২০২১-এর ১৫ মার্চ বক্তব্য দেন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক। সেই সমাবেশে তার বক্তব্যে মামুনুল প্রকাশ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে জঘন্য সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ান। তার বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে ১৬ মার্চ ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দেন দিরাইয়ের পার্শ্ববর্তী উপজেলা শাল্লার নোয়াগাঁওয়ের যুবক ঝুমন দাস। তিনি স্ট্যাটাসে মামুনুলের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের অভিযোগ আনেন। সন্ত্রাসী বক্তব্যের সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার প্রেক্ষিতে তবে, এই সমালোচনাকে ইসলামের সমালোচনা বলে ওই এলাকায় অপপ্রচার চালাতে থাকে মামুনুলের অনুসারীরা। এতে এলাকাজুড়ে উত্তেজনা দেখা দেওয়ায় নোয়াগাঁও গ্রামের বাসিন্দারা ১৬ মার্চ রাতে ঝুমনকে পুলিশের হাতে তুলে দেন। তখন থানা পুলিশ ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা গ্রামের বাসিন্দাদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছিলেন।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু তাদের নিরাপত্তা দিতে চরমভাবে ব্যর্থ হয় পুলিশ ও প্রশাসন। পরদিন কয়েক হাজার লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে মিছিল করে গ্রামের হিন্দু ঘরবাড়িতে হামলা চালায়। হামলাকারীরা ঝুমন দাসের বাড়িসহ হাওরপাড়ের হিন্দু গ্রামের প্রায় ৯০টি বাড়ি ও মন্দিরে ভাঙচুর-লুটপাট করে। হামলার ঘটনায় শাল্লা থানায় অজ্ঞাত পরিচয়সহ মোট দেড় হাজার লোকের বিরুদ্ধে মামলা হয়।

কিন্তু গ্রেফতারের পাঁচ দিন পর ২২ মার্চ ঝুমন দাসের বিরুদ্ধে জিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার পাশাপাশি নোয়াগাঁওয়ে হামলার ঘটনায় পৃথক তিনটি মামলা হয়। অর্থাৎ, হিন্দুদের উপর হামলার ঘটনাতেও যখন ঝুমন পুলিশ হেফাজতে ছিলেন, তখনো নাকি তিনি ধর্মীয় উস্কানি দিয়েছেন! মানে তিনি উগ্রবাদী হেফাজত নেতা মামুনুলের বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছিলেন মাত্র, যদি তাতে ঝুমন দাশের অপরাধ হয়ে থাকে, তাহলে তো মামুনুল কোনো দোষ করেনি। আবার যদি মামুনুল ধর্মীয় উস্কানি ও চরম জঘন্য সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিয়ে অপরাধ করে থাকে, তবে তার প্রতিবাদ করা ঝুমন অবশ্যই কোনো অপরাধ করেনি। দুইজনই তো একই অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হতে পারেন না, তাই না?

কিন্তু অবাক হলেও সত্য ঝুমনকে মামুনুলের বক্তব্যের প্রতিবাদ করার অপরাধে বিনা অপরাধে জেলে থাকতে হলো দীর্ঘ সাত মাস। তার বিরুদ্ধে ধর্মীয় উস্কানির মামলায় কয়েক দফায় জামিন আবেদন খারিজের পর ঝুমন দাসের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে জামিন আবেদন করা হয়। অবশেষে বিনা অপরাধে জেল খাটা ঝুমন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও সমাজের বিশিষ্টজনদের সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কারাবন্দীর ছয় মাস পর শর্তসাপেক্ষে জামিনে মুক্তি পায়। এরইমধ্যে ঝুমনের জামিন আবেদন নাকচ হয়েছে কমপক্ষে ৭ বার, অথচ হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা চালানো সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের মধ্যে যে শতাধিক গ্রেফতার হয়েছিল, তাদের প্রায় সবাই জামিন পেয়ে বেরিয়ে গেছে। খোলা হাওয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল তারা।

বিজ্ঞাপন

ঘটনা এখানে শেষ নয়। ঝুমন আবার আলোচনায় এলেন গতকাল পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে। দুইদিন আগে হজরত বিনয় ভদ্র নামে এক নেটিজেনের করা একটি পোস্ট শেয়ার দেওয়ায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেবার অভিযোগে তাকে আবার গ্রেফতার করে পুলিশ। বিনয়ের পোস্টটি ছিল সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুলে ১৪ শতকের প্রাচীন নবরত্ন মন্দিরের গেটে নবরত্নপাড়া জামে মসজিদের জন্য হাত খুলে দান করার আহ্বানসহ একটি দানবাক্স ঝুলিয়ে দেওয়ার ছবি নিয়ে। ঝুমন স্রেফ বিনয়ের কাছ থেকে ছবিটা নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে পোস্ট দিয়েছিলেন, ফলে তার বিরুদ্ধে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননাকর পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে আবারো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়েছে পুলিশ।

আজ বুধবার আদালতে চালান করা হবে তাকে।

কী লিখেছিল ঝুমন ওই পোস্টে? ঝুমনের সেই পোস্টটা পাঠকের সুবিধার্থে এখানে তুলে দেয়া হলো:

“অসভ্যতা ও বর্বরতার এইটা একটা নজির।

সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুলে ১৪ শতকের প্রাচীন নবরত্ন মন্দিরের গেটে মসজিদের এই দানবাক্স দেখে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল।

কোনো মসজিদের প্রধান গেটে কোন মন্দিরের দানবাক্স লাগানোর কল্পনাও কেউ করতে পারবে না। করলে ধর্ম অবমাননার মামলা খেয়ে কারাগারে থাকতে হবে অনেকদিন।

তাহলে এটা (মন্দিরের গায়ে মসজিদের জন্য দানবাক্স) লাগানোর সাহস এরা কিভাবে করে?

ঐ মন্দিরের আশেপাশে হিন্দুদের এটা অপসারণ করার বিন্দুমাত্র সাহস বা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করার ক্ষমতা নেই বলেও আশ্চর্য হয়েছি।

মন্দিরের গেটে মসজিদের দানবাক্স বা ইসলামী বয়ান লাগানো স্রেফ গুণ্ডামি, সংখ্যাগুরুর ইতরামি!”

ঝুমনের বলা এই কথাগুলোর মধ্যে ঠিক কোন শব্দটি ধর্ম অবমাননা হয়েছে বলে মনে হয় আপনাদের? কিভাবে এই কথাগুলো কোন ধর্মের অবমাননা আর সাম্প্রদায়িক উস্কানি হয়? হাটিকুমরুলের নবরত্ন মন্দিরের গেটে মসজিদের দানবাক্স লাগানোর ঘটনায় যদি কোন ধর্ম অবমাননা না হয়, কোন সাম্প্রদায়িক উসকানি খুঁজে না পায় পুলিশের ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা, তাহলে সেটার ছবি পোস্ট করে প্রতিবাদ জানিয়ে কিভাবে ধর্ম অবমাননা করল ঝুমন?

তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হচ্ছে ঝুমন যে কথাগুলো বলেছেন, সেগুলো কি কোনোভাবে ভুল? এই বাংলাদেশে কোনো অপরাধ না করার পরেও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীরা নিরপরাধ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়ি-ঘর, মন্দিরে আগুন দেয়, ভাংচুর করে, লুটপাট করে বায়বীয় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অজুহাতে, সেখানে যদি কখনো কোন মসজিদের গেটে মন্দিরের জন্য দানবাক্স সেঁটে দেওয়া হয়, কী ভয়াবহ পরিণতি হবে সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। অথচ উল্টোটা হয়ে আসছে আজ এতদিন ধরে, মন্দিরের গেটে মসজিদের জন্য দানবাক্স বসানো আছে, জঘন্য সাম্প্রদায়িক উসকানি দিয়ে আসছে স্থানীয় নবরত্নপাড়া জামে মসজিদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীরা, অথচ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক, ওই দানবাক্সটি পর্যন্ত সরানোর খবর আসেনি। কিন্তু স্রেফ এই কথাটা বলবার জন্য ঝুমনকে ধরে নিয়ে গিয়ে আবার ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা দেওয়া হয়েছে। জঘন্য অবিচার আচরণ করা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে, যাদের উপর দায়িত্ব ছিল ঝুমনদের নিরাপত্তা দেওয়া।

অথচ সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়ার যে অভিযোগ আনা হয়েছে ঝুমনের বিরুদ্ধে, সেটা লজিক্যালি অসম্ভব।এক ধর্মের মানুষের পক্ষে আরেক ধর্মের মানুষকে কোন কিছুতে উস্কে দেওয়া হাস্যকর। বাংলাদেশে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলার কেস হিস্টরি তলিয়ে দেখলে যেটা সবচেয়ে প্রকট সত্য হয়ে সামনে আসে সেটা হচ্ছে অন্য ধর্মের মানুষকে ফাঁসাতে এমনকি কোরআন শরীফ পর্যন্ত মন্দিরে রেখে আসার হীন চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উস্কানি এবং পরিকল্পনার বাস্তবায়নে হামলা চালানোর সবকিছুই করে আসছে উগ্রবাদী ধর্মান্ধরা, আর তাতে উগ্রবাদী ধর্মীয় বক্তারা রাখছে অন্যতম প্রধান ভূমিকা। ওয়াজ মাহফিলগুলোতে ভিন্ন ধর্ম, ধর্মাবলম্বী ও তাদের উপাস্য সম্পর্কে ছড়ানো হচ্ছে নোংরা বিষাক্ততা, তাদের উৎসাহিত করা হচ্ছে, অনুপ্রাণিত করা হচ্ছে, উস্কানি দেওয়া হচ্ছে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপর হামলা করবার, এরপরে তাদের উস্কানিতে এলাকার উগ্রবাদী ধর্মান্ধ জনগোষ্ঠী, কখনো ধর্মীয় নেতাদের নেতৃত্বে, কখনো ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের নেতৃত্বে, কখনো ট্রেইনড জঙ্গী, উগ্র সাম্প্রদায়িক ক্যাডারেরা হিন্দু বা অন্য ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে, দোকানপাট, মন্দিরে ভাংচুর-লুটপাট করছে, আগুন দিচ্ছে, উপাস্যদের ভাংচুর করছে। অথচ এদের বিচার হচ্ছে নামেমাত্র, গ্রেফতার হলেও কয়েকদিন পরেই এরা জামিন পেয়ে বেরিয়ে গিয়ে আক্রান্ত হিন্দু জনগোষ্ঠীকে উল্টো হুমকি দিচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো এক অদ্ভুত কারণে যার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগ আসে, তাকে যত দ্রুততার সঙ্গে গ্রেফতার করে, সত্যিকারের হামলা চালানো সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সেই তৎপরতার অর্ধেকও দেখায় না। সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনা ঘটে আদালতে, পুলিশ তাও যে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করে, তারা খুব সহজেই আদালত থেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে এসে আবারও একই কাজ শুরু করে। মহামান্য আদালতের বিচারকেরা এতো সহজে এদের জামিন দেন যেন এরা ছিঁচকে চুরির অপরাধে গ্রেফতার হয়েছিল। অনুভূতির বায়বীয় আঘাতের ছুতোয় পরিকল্পিতভাবে অজস্র নিরীহ নিরপরাধ মানুষের ঘরবাড়ি-জীবিকার উৎস, উপাসনালয় ধ্বংস করে দেওয়া বর্বর নরপিশাচগুলোর কোনো সাজা হয় না, বিচারের ফস্কা গেরো দিয়ে তারা ঠিকই বেরিয়ে যায়। যারা সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস করল, তারা মুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় আর ধর্মানুভূতির বায়বীয় অভিযোগে আক্রান্তরা জেলে জেলে পঁচে মরে।

আমরা যদি সোচ্চার না হই, হতভাগা ঝুমন দাশও জেলে জেলে পঁচে মরবে। অবিলম্বে তার বিরুদ্ধে হওয়া ষড়যন্ত্রমূলক মামলা প্রত্যাহার করে তাকে সসম্মানে মুক্তি দেবার দাবী তুলুন। দাবী তুলুন নবরত্ন মন্দিরের গেটে যারা মসজিদের দানবাক্স ঝোলাল, তাদের খুঁজে বের করে সাম্প্রদায়িক উস্কানির অপরাধে বিচারের মুখোমুখি করবার। দাবী তুলুন ঝুমন দাশের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া স্থানীয় পুলিশ কর্তৃপক্ষকে বিচারের আওতায় আনার, কারণ তারা মন্দিরের গায়ে মসজিদের দানবাক্স রাখায় কালপ্রিটদের আইনের আওতায় না এনে এই জঘন্য উস্কানির প্রতিবাদ করা মানুষটাকে গ্রেফতার করে বাদী হয়ে মামলা দিয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এই মৌলবাদ তোষণের নীতি জাতির জন্য অশনিসংকেত। ঝুমনকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার ও মামলা দেবার প্রতিবাদ করুন সোচ্চার কণ্ঠে, নইলে এরপরে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আক্রান্ত হবেন আপনি, পালা আসবে আপনার!

লেখক: একটিভিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর