Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পর্তুগালের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ ও আমাদের শিক্ষা

কায়সুল খান
৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৩:৩৫

ইউরোপের অন্যতম কল্যাণ রাষ্ট্রের নাম পর্তুগাল। দেশটি কোভিড-১৯ পরিস্থিতি অত্যন্ত সাফল্যের সাথে মোকাবিলা করেছে। যার কৃতিত্ব দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগের, আরও স্পেসিফিকভাবে বললে সদ্য সাবেক পর্তুগিজ স্বাস্থ্যমন্ত্রী মার্তা তেমিদোর। পর্তুগাল সোশ্যালিস্ট পার্টির এই নেত্রী স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ২০১৮ সালে এবং তিনি কৃতিত্বের সাথেই দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। বিশেষত কভিড-১৯ মোকাবিলা তথা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে পর্তুগিজ সরকার যে সকল কঠোর অবস্থান ও নিয়মনীতি প্রণয়ন করেছিল তার একক কৃতিত্ব মূলত মার্তা তেমিদোর। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো তার এই যাত্রা খুব কন্টকাচ্ছন্ন থাকলেও তিনি সাফল্যের সাথেই দায়িত্ব পালন করছিলেন। দেশটিতে মধ্যবর্তী নির্বাচন, মন্ত্রী পরিষদ পুনঃগঠন ইত্যাদি নানা কিছু ঘটলেও মার্তা তার নিজ পদেই বহাল ছিলেন। বর্তমান পর্তুগিজ প্রধামনন্ত্রী অ্যান্তনীয় কস্তার অত্যন্ত আস্থাভাজন মন্ত্রী ছিলেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

গত ২২ আগস্ট, ২০২২ তারিখে দুর্ভাগ্যজনকভাবে একজন ভারতীয় পর্যটক গর্ভবতী নারী লিসবনের অন্য একটি হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্স যোগে শান্তা মারিয়া হাসপাতালে স্থানান্তরের সময় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। ঘটনাটি সমগ্র পর্তুগালে তোলপাড় শুরু করে এবং পর্তুগিজ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা বলে চিহ্নিত হয়। এমন কি পর্তুগালের জাতীয় দৈনিকে এখানকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এসএনএসকে জাতীয় বিপর্যয় ব্যবস্থা হিসেবে ঘোষণা দেয়। ঘটনার প্রেক্ষিতে ৩০ আগস্ট, ২০২২ তারিখে দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী মার্তা তেমিদো ব্যর্থতার দায় নিয়ে নিজ পদ থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেন। পর্তুগালের বর্তমান জনপ্রিয় সরকারের আমলে এই একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।

বিজ্ঞাপন

পর্তুগালের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা মূলত ইংল্যান্ডের এনএইচএস বা ন্যাশনাল হেলফ সার্ভিসের অনুকরণে গড়ে উঠেছে। এদেশে এটিকে বলা হয় এসএনএস বা সার্ভিসো ন্যাসিওনাল দি সৌদে অর্থাৎ জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। পর্তুগালের এই এসএনএস ভিত্তিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা খুবই উন্নত। বিশেষয় ইমার্জেন্সি সার্ভিসের ক্ষেত্রে তারা খুব দ্রুত কাজ করেন। সাধারণ অসুখ বিসুখের পাশাপাশি অনেক জটিল অসুখের চিকিৎসা এসএনএস এর ভিত্তিতে বিনা মুল্যে পাওয়া সম্ভব হয়। এই দেশের প্রত্যেক নাগরিক ও রেসিডেন্টের এই স্বাস্থ্য নম্বর বা এসএনএস নম্বর থাকে। যেটি উক্ত ব্যক্তির আজীবনের অসুখ বিসুখের বিস্তারিত তথ্য সংরক্ষণ করে রাখে এবং সমস্ত প্রেসক্রিপশনের কপিও সংরক্ষিত থাকে। ফলে কখনো নতুন কোন চিকিৎসকের কাছে কোন রোগী গেলে তার পুরাতন মেডিকেল হিস্টি তারা দেখতে পান, কি চিকিৎসা তাকে দেওয়া হয়েছে সে সম্পর্কেও সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারেন।

২০২০ এর শুরুতে যখন সারা বিশ্বের ন্যায় কভিড-১৯ এর সংক্রমণ শুরু হলো তখন এই এসএনএস ব্যবস্থার মাধ্যমে রোগীদের জরুরি স্বাস্থ্য সেনা প্রদান করে পর্তুগিজ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। বয়স্ক ও অত্যন্ত ক্রিটিক্যাল রোগীদের জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি কিংবা প্রয়োজনে ইউরোপের অন্যান্য দেশে যেখানে আরও উন্নততর চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে পর্তুগিজ সরকার। আর এই কাজটি সম্পন্ন হয় এসএনএস এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। পরবর্তীতে কভিড-১৯ এর টিকা দেওয়া, বুস্টার শটের ব্যবস্থা করা সব কিছুই অত্যন্ত পদ্ধতিগত উপায়ে সম্পন্ন হয়। যে কাজটি অত্যন্ত সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করেন তৎকালীন পর্তুগিজ স্বাস্থ্যমন্ত্রী মার্তা তেমিদো। শুধু তাই নয়, তার বিগত ৫ বছরের মন্ত্রীত্বকালে তিনি নতুন চিকিৎসক নিয়োগ, চিকিৎসক ও নার্সদের বেতন বৃদ্ধি, হাসপাতালে সিট বৃদ্ধি ও আধুনিকায়ন এবং পর্তুগালের বার্ষিক মৃত্যু হার কমিয়ে আনতে দৃঢ়তার সাথে ভূমিকা রাখেন। বলা যায় স্মরণকালে পর্তুগালের অন্যতম সফল মন্ত্রী মার্তা তেমিদো। কিন্তু তবুও তিনি একটি বিদেশী গর্ভবতী ভারতীয় পর্যটকের অনাকাঙ্খিত মৃত্যুর দায় নিজ কাঁধে নিয়ে পদত্যাগ করলেন। আমাদের বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বিষয়টি কল্পনা করুন তো?

বিগত ২ দশকে যে কোন সরকারের আমলেই আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যুগান্তকরী কোন পরিবর্তন হয় নি। বরং জনস্বাস্থ্য দেখভালের দায়িত্ব ক্রমশ সরকারের কাঁধ থেকে বেসরকারি খাতের উপর বর্তেছে। ফলে এক দিকে যেমন চিকিৎসা ব্যবস্থা নিম্নমুখী হয়েছে তেমনি অন্যদিকে চিকিৎসা খরচ বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে দুর্নীতি, চিকিৎসক নিয়োগে দুর্নীতি, হাসপাতালে ওষুধ ও খাবারের নিম্নমান, উপযুক্ত সেবা প্রদানে চিকিৎসকদের অনীহা, স্বাস্থ্যকর্মীদের উপযুক্ত সম্মানী প্রদান না করাসহ হাজারো সমস্যা বর্তমান। কভিড-১৯ কালীন সময়ে সংকটের মাঝেও যখন দেশে একটি কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তথা এসএনএস এর মত মেডিকেল নম্বর প্রদানের সুযোগ তৈরি হয়েছিল, আমাদের সরকার সেটি করতে ব্যর্থ হয়েছে। সম্ভবত বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকগণের মাথায় এমন কিছু গড়ে তোমার প্রয়োজনীয়তার কথা উপলব্ধিতেই আসে নি। অন্তত কোন পত্রপত্রিকায় এই জাতীয় বিষয়ে আলাপের প্রমাণ পাওয়া যায় না।

বাংলাদেশে প্রতি মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় কয়েকশো মানুষের অপমৃত্যু ঘটে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে গত আগস্ট মাসে দেশে ৪৫৮ টি সড়ক দুর্ঘনায় ৫১৯ জনের মৃত্যু ঘটেছে। ঈদ বা অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবের সময় যেই সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যায়। এখানে লঞ্চ ডুবি ঘটে, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার মত ঘটনা ঘটে, আগুনে পুড়ে একরাতে শতাধিক মানুষের জীবনহানি ঘটে। কিন্তু কখনো কোনো মন্ত্রী ঘটনার দায়িত্ব নিয়ে কি পদত্যাগ করেন? পদত্যাগ দূরের প্রশ্ন, নিজ কাঁধে দায় বা ব্যর্থতার অংশীদার হওয়ার মত মানবিক গুণাবলী প্রদর্শনের উদাহরণও কি পাওয়া যায়?

একটি উন্নত ও কল্যাণ রাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের মৌলিক পার্থক্য এখানেই দৃশ্যমান। আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক জনসম্মুখে বলেন ‘ডাক্তার হতে পারিনি, তবে ডাক্তারদের মন্ত্রী হয়েছি।’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২২)। অন্যদিকে পর্তুগিজ স্বাস্থ্যমন্ত্রী তার এত জনপ্রিয়তা ও সাফল্য থাকার পরও এমন একটি ব্যর্থতার দায়ে পদত্যাগ করেন যাতে তার সরাসরি কিছুই করার ছিল না। স্বাস্থ্যব্যবস্থা পুনর্গঠনে পদ্ধতিগত উন্নয়নে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন এই ভাবনা থেকেই তার পদত্যাগ।

বাংলাদেশ আর পর্তুগালের সরকারের মাঝে এই ব্যাপক চিন্তার পার্থক্যই মূলত আমাদেরকে এখনো উন্নয়নশীল দেশের কাতারে ফেলে রেখেছে। অন্যদিকে পর্তুগাল ক্রমশ ইউরোপের গুরুত্বপুর্ণ ও শক্তিশালী দেশে পরিণত হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রকৃত উন্নয়ন সংঘটনের জন্য তাই দরকার ক্ষমতাসীনদের মানবিক বোধ জাগ্রত করা, দায়িত্ব গ্রহণে আরও সতর্ক হওয়া এবং ব্যর্থতার গ্লানি নিজ কাঁধে নেওয়ার সৎ সাহস অর্জন করা। যদি এই শক্তি ও সাহস আমরা অর্জন করি তবেই আমাদের প্রকৃত এগিয়ে যাওয়ার পথ সুগম হবে এবং জাতিগতভাবে আমরা দ্রুত অগ্রগতি লাভ করব। আমরা আমাদের সরকারি, বেসরকারি সকল পর্যায়ের দায়িত্বশীলগণের বোধোদয় কামনা করি এবং আশাকরি পর্তুগিজ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এই পদত্যাগ তাদের বিবেককে নতুনভাবে নাড়া দিয়ে সৎ কর্তব্যপরায়ন মানুষ হতে সাহায্য করবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, লিসবন, পর্তুগাল

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

কায়সুল খান পর্তুগালের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ ও আমাদের শিক্ষা মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর