Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সাম্প্রদায়িক সহিংসতা কার সন্তুষ্টিলাভের জন্য?

সুমিত বণিক
৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৪:৪৭

স্বাধীন এই ভূখণ্ডে মূলত চারটি ধর্মের মানুষকে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও, দেশে নানা ধরণের ধর্মচর্চার প্রচলন রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে কাজ করার আগে যে ধর্মটির কথা কখনো শুনিনি, সেটি হল ক্রামা ধর্ম। এখন এটি আমার জানার অগোচরে ছিলো বলে কি তাদের এই ধর্মীয় রূপকে আমার অস্বীকার করার সুযোগ আছে? জীবনে অনেক প্রকারের ধর্মচর্চার মানুষ দেখেছি।

এক.
কেউ নিজের ধর্মচর্চা নিয়ে ব্যস্ত, নিজের স্বীয় সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি বিধানে সদা অন্তঃপ্রাণ মানুষ, তার সন্তুষ্টি বিধানই জীবনের একমাত্র আরাধ্য বিষয় মনে করে।

বিজ্ঞাপন

দুই.
নিজের প্রভুর সন্তুষ্টি বিধানে কাজ করলেও নিরবে নিভৃতে পুরোদস্তুর সাম্প্রদায়িক চেতনা লালনকারী, নিজের ধর্মের বাইরে অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষকে শত্রু ভাবাপন্ন মনে করে।

তিন.
এরা সকল ধর্মের উর্ব্ধে গিয়ে মানুষের জয়গান গায়, তারা নিজেদের কোন ধর্মীয় বিশ্বাসের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখতে চান না, এমনকি নির্দিষ্ট কোন লেবাসে বা আচারে ধর্মচর্চাকে প্রশ্রয় দেন না, মানবধর্মকেই শ্রেষ্ঠ ধর্ম হিসেবে চর্চা করে।

চার.
এরা কোনো ধর্মকেই বিশ্বাস করে না, এরা প্রতিনিয়ত বিজ্ঞানের সাথে ধর্মকে তুলনা করে যুক্তিখন্ডন করে, বরং প্রতিনিয়ত ধর্ম একজন মানুষের জীবনে স্বাধীনতা, অধিকারভোগে কী ধরণের বৈষম্য তৈরি করে, সেটি উন্মোচন এবং প্রসারে কাজ করে।

জীবন চলার পথে দেখা মানুষদের দেখে মোটা দাগে এই চারভাগে ভাগ করেছি। এটি কোন প্রাতিষ্ঠানিক বিভাজন নয়, নিতান্তই নিজস্ব চিন্তায় করা বিভাজন। তাই দ্বিমত থাকবে এটাই প্রত্যাশিত।

‘রোর মিডিয়া’য় প্রকশিত একটা লেখা অনুযায়ী, ‘ক্রামা ধর্মের ধর্মগ্রন্থের নাম রিইয়ুং খতি। ধর্মীয় রীতিনীতি এবং জীবন নির্দেশিকা তাতে লিপিবদ্ধ। ক্রামা ধর্মের অনুসারীরা মানুষের শরীরকে একটা ঘরের সাথে তুলনা করেন; আত্মাকে মালিক। ঘরকে নিয়মিত দেখাশুনা করলেই কেবল তা পরিচ্ছন্ন থাকবে। শরীর ও আত্মার জন্যেও তাই-ই। যখন সমাজে চুরি ডাকাতি ও খারাপ কাজ বেড়ে যায়; তখন ভগবান শাস্তি দেন। ফলে বিভিন্ন বিপদ-আপদ আসে। খারাপ কাজে শাস্তি না দিলে তো অপরাধ বেড়ে যাবে। স্বর্গ বেশি দূরে না; বরং খুব কাছে। মন সৎ আর পবিত্র হলে এবং আচরণ ভালো হলে স্বর্গ দূরে না মোটেও। তাদের মতে, ‘কারো কষ্টের ফসল কেড়ে নিও না। পাপের বোঝা বাড়বে তাতে। যে অপরের ব্যাথা বোঝে না; সে পাগলের অধিক ক্ষেপা। মানুষকে ভয় করার কিছু নেই। যদি একান্তই ভয় করতে হয়; তবে ভগবানকে করা উত্তম। কারণ তিনিই রক্ষাকর্তা এবং একক সত্তা।’ আচ্ছা, এ দেশের একজন সুস্থ মানুষ হিসেবে মনে করি, এই মতবাদে খারাপ বা সাম্প্রদায়িক কোন বার্তা নেই, কোন মানুষের জীবনে অহেতুক অনিষ্ট করার মতো উস্কানিমূলক কোন কথা নেই। তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে জন্ম নেয়া এই ধর্মকে কেন আমি অশ্রদ্ধা করবো? কোন অধিকারে করবো? সংখ্যাল্প মানুষের এই ধর্মানুভূতিকে অসাংবিধানিক কিংবা অযৌক্তিক বলার কোন সুযোগ আছে? আমার জানা মতে তা-ও নেই।

বিজ্ঞাপন

যতটুকু বুঝি এই পৃথিবীর সভ্যতার উন্নয়নে যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি তারা সবাই মানুষ। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা মানুষ হিসেবে নিজেদের সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে উপস্থাপন করতে খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে এখন মানুষ হিসেবে ভাবতেই বেশি কষ্টবোধ হয়। কারণ আজকাল মানুষ হয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে ধর্মীয় উত্তেজনা ও গুজব ছড়িয়ে অসংখ্য মানুষের জীবনে বিপন্নতা তৈরি করতে আমাদের মনে একটুও বাধে না। সব সময় ধর্মীয় পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়ে বিভেদের জাল তৈরি নীলনকশা তৈরি নেশায় বিভোর এক শ্রেণীর মানুষ। কিন্তু যে ধর্মীয় চেতনা থেকে আমরা সংখ্যালঘু মানুষের জীবনে এমন নাজুক অবস্থা তৈরি করি, এটা কি সৃষ্টিকর্তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য? আর এর মাধ্যমে কি পরমারাধ্যের সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব? আমার স্বল্প ধর্মীয় চেতনার মাঝে কখনো তো বিধাতাদের মাঝে কোন দ্বন্ধ বা বৈরিতার কথা শুনি নি! বরং মানুষই সৃষ্টিকর্তার সানুগ্রহ বা নৈকট্য লাভের জন্য তার প্রার্থনা করে। ভিন্ন ভিন্ন ধর্মে, ভিন্ন উপাচারে। কিন্তু মূল তত্ত্বকথা একই। যেন অন্তিমে সেই পরম করুণাময়ের করুণা লাভ হয়। সর্বোপরি একটি সুশৃঙ্খল জীবন প্রণালীর মধ্যে থেকে নিজেকে পরিচালিত করে তার আনুগত্য স্বীকার করা।

যতদূর জানি এ পর্যন্ত কোন ধর্মগ্রন্থই অশান্তির বারতা প্রচার করে নি, খারাপ কাজ করার জন্য অনুমোদন দেয়নি, অন্যের অনিষ্ট করার জন্য উৎসাহিত করেনি। তবে কেন মানুষ ধর্মের নামে এসব অধর্ম করছে? একদিকে বিধাতার সানুগ্রহ বা সন্তুষ্টি লাভের দোহাই দিয়ে কিছু মানুষ অবিরত অন্যের ক্ষতি করে চলছে। এই যে ধর্মের নামে অপকর্মগুলো মানুষ করছে, স্বয়ং সেই ধর্মেই কি এই কাজগুলো অনুমোদন করে কিনা সেটাই বা কজন বিবেচনা করে? কতজন চর্চা করে? ধর্মচর্চা প্রশান্তিময় জীবনের সন্ধান দিয়ে আলোকিত করে দেহ-মন। ধর্মের পবিত্রতার ছোঁয়ায় পঙ্কিলতামুক্ত অন্তর হয়ে উঠে ভালবাসার আশ্রয়স্থল। সেই দ্যুতি ছড়ায় মানুষ থেকে মানুষে। কিন্তু ধর্ম ও ধর্মান্ধতার কালো থাবায় কোথায় যেন এক অন্ধকার গন্তব্যহীন পথে ছুটে চলেছি আমরা! না হচ্ছে ধর্ম, তবুও ধর্মের দোহাই দিয়ে সহিংসতা চলছেই! বিপন্ন হচ্ছে মানুষ ও মানবতা! সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে একদল মানুষ দুর্গোৎসব এলে যেন মূর্তিভাঙ্গার নেশায় উন্মাদ হয়ে পড়ে। আর সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ফেসবুককেই মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়- ‘মাটির মূর্তি ভজে করে কেউ পূণ্য অভিলাষ, আবার কেউবা এটিই ভেঙ্গে করে নগ্ন উল্লাস!’

ধর্ম যার যার উৎসব সবার। বর্তমানে এই বহুল প্রচলিত অসাম্প্রদায়িক বাক্যটিকে ঘিরেও নানা বিকৃত ভাবনার সৃষ্টি করা হয়েছে। রচিত রয়েছে ভিন্ন অপব্যাখা। আর মুর্তি ভাঙ্গা কিংবা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের ধর্ম চর্চায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করার মতো নিকৃষ্ট কাজ কোন সভ্য মানুষের কাছে কখনো প্রত্যাশিত নয়। বিশেষত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদেরকে কেন্দ্র করে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষের ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগগুলো আনা হয়। আর এসব ঘটনায় একশ্রেণীর মানুষকে ভুল ব্যাখা দিয়ে উত্তেজিত করা হয়। করা হয় লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর, মারধরসহ নানা অনাচার। পরবর্তীতে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে প্রকাশ পায়, কিছু ধর্মান্ধ মানুষ ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে স্ট্যাটাস দিয়েছিলো, যেখানে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মতে ধর্মীয় অবমাননার ঘটনা ঘটেছিলো। পরবর্তীতে ঘটনার নেপথ্যে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষ জড়িত থাকলেও, ভূক্তভোগী সংখ্যালঘু পরিবার বিনা দোষে অমানবিক জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। যার দায় কেউ নেয় না! কখনো কি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার এসব ঘটনায় একটা সংখ্যালঘু পরিবার বা সমাজে এর গভীর ক্ষতটা সামগ্রিকভাবে বোঝার চেষ্টা করেছি? আক্রান্তরা কতটা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে? কখনো কখনো আইনি জটিলতায় বিনা দোষে দীর্ঘদিনের কারাবাস ভোগ করতে হয়। ধর্মীয় চেতনা প্রকাশে আমাদের মাঝে কেন এই সংকীর্ণ ও বৈরি ভাবনার প্রকাশ? কেন আমরা মানুষ ও মানবতার প্রশ্নে আমরা এক হতে পারি না? এই সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় চেতনা ও সংস্কৃতি আমাদের মাঝে বিভেদের দেয়াল গড়ে তুলছে! সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে আমরা মানুষ পরিচয়টা কে কি সবার উপরে তুলে ধরতে পারিনা? কেনই বা মানুষের দুঃখ-কষ্টের মাঝেও ধর্মের গন্ধ খুঁজি?

সাধারণত শিক্ষা মানুষের ভেতরের এ সকল অন্ধকার দূর করে উন্মুক্তভাবে ভাবার সুযোগ করে দেয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেও একটি কুচক্রীমহল নানাভাবে সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়িয়ে দেওয়ার পাঁয়তারা করেই চলছে। স্বাধীনতার পরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে সাম্প্রতিককালে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাগুলোকে দেখে শুনে মনে হয়; স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমরা পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করতে পারিনি। আমরা সামষ্টিকভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করতে পারিনি। সংবিধানের ধর্ম নিরপেক্ষতার মতো মূলনীতিকে আমরা বিকৃত করে ফেলেছি। ফলশ্রুতিতে মহান স্বাধীনতার মত একটি অর্থবহ ঐক্যবদ্ধ সামষ্টিক চেতনাও অনেকক্ষেত্রেই প্রশ্নবিদ্ধ! আমরা কি পেরেছি দল-মত নির্বিশেষে এই মহান স্বাধীনতার চেতনাকে সমাজের সকল স্তরে প্রসারিত করতে? এখানেও রয়েছে বিভেদ, ভিন্নমত ও দর্শনের আধিপত্য! মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি যে মানবিকতা ও মূল্যবোধের পরিচয় দেওয়ার কথা! সেটা কে আমরা সমুন্নত রাখতে পারছিনা। ফলে সমাজ ব্যবস্থায় অসাম্প্রদায়িক চেতনার বদলে প্রতিনিয়ত সাম্প্রদায়িক চেতনার বিষবাষ্প বিকশিত হচ্ছে, যা পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পর্যন্ত বিস্তৃত। সম্প্রীতির শিক্ষা অবহেলিত থেকে যাচ্ছে সর্বক্ষেত্রে। বৃহত্তর জাতীয় কল্যাণের স্বার্থে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনরুদ্ধারের বিকল্প নেই। আর এক্ষেত্রে মানুষের মনোজগতের ভাবনা ও চেতনার ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে গণমাধ্যমের দায়িত্বশীল অগ্রণী ভূমিকা অপরিসীম।

লেখক: জনস্বাস্থ্য কর্মী ও প্রশিক্ষক

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

মুক্তমত সাম্প্রদায়িক সহিংসতা কার সন্তুষ্টিলাভের জন্য? সুমিত বণিক

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর