ঢাকার রাজনীতিতে নতুনরা পূর্ণতা দিক আওয়ামী লীগকে
৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৮:২৯
রাজনৈতিক ভাষণ দেওয়ার অতি সক্ষমতা, যে কোনো নেতৃত্বের মৌলিক গুণাবলির মধ্যেই পড়ে। একজন নেতা যদি সুধী সম্বোধনে যেয়ে জনমানুষের আবেগ ও চাওয়া পাওয়াকে ধারণ করে জনশ্রেণির জন্য নিবেদিত সত্তা হিসাবে নিজেকে প্রমাণ না করতে পারেন- নেতা কী আর সে হতে পারল?
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, বক্তব্য সারা বাংলার মানুষকে এককাট্টা করতে পেরেছিল বলেই ফল মিষ্ট ছিল। এদিকে, স্বাধীনতা অর্জনের একান্ন বছরে বাংলাদেশ খুব বেশি সুবক্তা আর পায় নাই।
তবুও, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, নূরে আলম সিদ্দিকির ছান্দসিক ভাষণ দেয়ার ক্ষমতার ধারাবাহিকতায় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ফজলুর রহমান, জাসদ নেতা আব্দুল মালেক রতন, ঢাকার সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফের মাঠে ময়দানের ভাষণ মানুষকে আন্দোলিত করত। সংসদের অভ্যন্তরে সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। আরো পরে জাসদ নেতা মাঈনুদ্দীন খান বাদলও ছিলেন তুখোড় বক্তা।
তরুণদের মধ্যে সংসদে ও টেবিল টকে বিকল্পধারা মাহী বি চৌধুরী ও বিজেপি নেতা ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ তাঁদের সক্ষমতা তুলে ধরতে সচেষ্ট হন। এই ধারাবাহিকতায় গণ সংহতি আন্দোলনের নেতা জোনায়েদ সাকিও ভাল বক্তা। তরুণ নেতা ভিপি নূরও বেশ শক্ত করে বলতে জানেন। বিএনপি পুনর্গঠনের উদ্যোক্তা ও রাজনীতির অপ্রচলিত চরিত্র কামরুল হাসান নাসিম ছিলেন খুব সম্ভবত শ্রেষ্ঠ পর্যায়ের বক্তা। তিনি রাজনীতিতে অনিয়মিত, অবশ্য মাঝে মাঝে ফিরে আসেন।
সেদিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা এস এম কামাল এর বক্তব্য শোনার সুযোগ হলো। তাঁর কণ্ঠস্বর ভালো। ইতিহাসের মৌখিক ধারাভাষ্য দেওয়ার আলাদা গুণ আছে। এক কথায় তিনি সুবক্তা।
হাইব্রিড অপবাদ নিয়ে রাজনীতিতে আগ্রহীদের তথা নবীনদের বাধা আছে। পুরোনোরা শুরুতেই ধাক্কা দিয়ে বলতে চায়, ‘কতদিন ধরে রাজনীতিতে? সুবিধা নেয়ার জন্য এসেছো?’ এমন তির্যক শ্লেষ কে হাইব্রিডেরা মোকাবিলা করতে পারত, যদি তাদের মধ্যে রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়ার ঝাঁজ থাকত। আসলেই তা তাঁরা করতে পারছে না বলেই দলের মধ্যে বিতর্কিত হয়ে পড়ার অভ্যাসেও আছে।
রাজনৈতিক গবেষণাকর্মী হিসাবে প্রায় নয় বছর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করছি। বাংলাদেশের সংবিধান, জাতীয়তা, শাসনরীতি, রাজনৈতিক দল, জনপ্রতিনিধি- এ সবের ওপর কাজ করতে গিয়ে প্রতি বছরই দেখি যে, বাংলাদেশের তিনশত সংসদীয় আসনে বড় বড় রাজনৈতিক দল থেকে জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার লক্ষ্যে প্রত্যাশীদের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। কিন্তু প্রতিভাধর হয়ে কিংবা জনকল্যাণে নিজের সেরাটা দেওয়ার অভিপ্রায়ে নবাগতদের সংখ্যা পুরোপুরি রাজনৈতিক সত্তা সূচকের বিবেচনায় অপ্রতুল।
এক সমীক্ষায় যেমন রাজধানী ঢাকার কথাই যদি তুলে ধরা হয়, সেখানে আমরা ঢাকা মহানগীর ১৫টি আসন নিয়ে যদি আলোচনায় যাই, সেখানে কী দেখা যাচ্ছে ? উল্লেখ্য, ঢাকা জেলার সংসদীয় আসন মোট ২০টি। মহানগরের ১৫টি। প্রতিভাধর হয়ে কিংবা সুবক্তা হয়ে রাজনীতিতে কেউ জায়গা নিতে পারছে না। যারা দুই একজন আসছেন, তাঁরা আবার দলের মধ্যে অবস্থানকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারছে না।
যেমন, ঢাকা-৪ আসনে নতুন কোনো মুখ নেই। মহানগরের আসন শুরুই ঢাকা-৪ দিয়ে। এখানে পুরোনোরাই দলিয় মনোনয়ন প্রত্যাশী। বর্তমানে সাংসদ হিসাবে ভাগ্যের কৃপায় বা অংশীদারিত্বমূলক রাজনীতির সংস্কৃতিতে জাতীয় পার্টির সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি বনেছেন। কিন্তু, এই এলাকার আসল নেতার নাম আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য সানজিদা খানম। বিএনপি থেকে পুরোনো মুখ মোহাম্মদ সালাহউদ্দীন ছিলেন। কিন্তু, অন্য কেউ আর উঠে আসতে পারেনি।
ঢাকা-১৮ হলো মহানগরের শেষ আসন। এখানে সৎ সত্তা সাহারা খাতুনের মৃত্যুর পর কে এমপি হয়েছে, সে সম্পর্কেও এই এলাকার মানুষগুলো জানে না। বিএনপি থেকেও তেমন নেতা নেই। কিন্তু, মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সংখ্যা অনেক। এভাবেই রাজধানীর অধিকাংশ আসনগুলোয় নতুন মুখের সন্ধান আছে, কিন্তু তাঁরা নিজেদেরকে প্রমাণ করে সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না।
নেতৃত্বের মৌলিক গুণাবলির মধ্যে সততা, দক্ষতা, দূরদৃষ্টি, দেশপ্রেম ও চরিত্র থাকতে হবে। কিন্তু আজকের বাস্তবতায়, একজন নেতাকে কথা বলায় পারদর্শী হতে হবে, নতুবা প্রখর জ্ঞ্যানের অধিকারী হয়ে রাষ্ট্রের স্বার্থে নিজেকে অতি উচ্চতার চিন্তামনষ্ক চরিত্র হিসাবে দাঁড় করাতে হবে।
ঢাকায় কয়েকজন নতুন নতুন যোগ্য রাজনৈতিক সত্তাদের আলোচনায় আসতে দেখা গেছে। তাঁদের ভবিষ্যৎ ভাল হবে বলে দেখার সুযোগও আছে। পারিবারিক রাজনীতির উত্তরসূরী হয়ে সাদেক হোসেন খোকা পুত্র ইশরাক হোসেন রাজনীতিতে এসেই আলোচিত হয়েছেন। কিন্তু, তাঁর বক্তব্য দেয়ার আদলটি গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না। একই দলের শেখ রবিউল আলমের মধ্যে কিছুটা মেধা প্রতিভাত এবং তাঁর বক্তা হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। বিএনপি সুস্পষ্টভাবে ঢাকায় তরুণ নেতৃত্বের সংকটে আছে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের মধ্যে হাজি সেলিমের আসনে সংকট বাড়ছে। কিন্তু, নতুন নাম নেই। ঢাকা-৫, ঢাকা-১১, ঢাকা-১৪, ঢাকা- ১৭ ও ঢাকা- ১৮ আসনে তাই শেখ পরশ, শেখ ফাহিম, ডক্টর আশিকুর রহমান শান্ত, আদম তমিজী হকেরা মূল্যায়িত হলে আওয়ামী লীগের জন্য ভালো হবে।
একটি দলকে প্রতিনিধিত্ব করতে চাইলে যে কোনো পরিস্থিতিতে দলীয় মুখপাত্রের মত করে দাঁড়িয়ে যেয়ে কথা বলার অভ্যাসে যেতে হবে। নতুনেরা তাই যারাই আসছেন, কথা দিয়েই তাঁদের নেতৃত্বকে আলাদা জাতের হিসাবে প্রদর্শনে যেতে হবে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিতে এমন একটি চরিত্র নেই, যে আন্দোলন জমিয়ে তুলতে পারবেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের হয়ে যারা টেলিভিশন টক শো তে যান, সেভাবে তাঁরা দলের ভাবমূর্তি তুলে ধরতে সক্ষম হচ্ছে না। জ্যেষ্ঠ পর্যায়ে এস এম কামালদের সংখ্যা কম। ফলশ্রুতিতে আওয়ামী লীগমনা বিদগ্ধশ্রেণি দিয়ে টিভির বাক্স মোকাবিলা করা গেলেও মাঠের রাজনীতিতে তাঁদের সুবক্তা নেই।
সাংবাদিকতার একটি বিশেষ অভিজ্ঞতা জানিয়ে লেখাটিকে শেষের দিকে নিয়ে যাই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে চার খলিফার একজন হিসাবে সু স্বীকৃত নূরে আলম সিদ্দিকি একদিন বলেছিলেন, আমি মূলত একটা সময় বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য দেওয়ার আগে মাঠ গরমের কাজটা করে দিতাম। যাতে করে যারা উপস্থিত আছেন, তাঁরা জেগে যায়- অতঃপর বঙ্গবন্ধু এসে তাঁর দরাজ কণ্ঠ দিয়ে হৃদয়ের শানিত ছুরি দিয়ে বাঙালি জাতির আবেগকে ধারণ করে বলতেন, জয় বাংলা !
লেখক: গবেষক ও সাংবাদিক