গ্যালিভার শেখ হাসিনায় নিপাত যাক অপশক্তি
৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৯:৪৩
সময় এখন ভাদ্র মাসের। প্রতি মুহূর্ত স্মরণ করিয়ে বলবে, স্বস্তিতে নেই। ঋতুনীতিকে উপেক্ষা করে অবশ্য ক্ষণে ক্ষণে মেঘের ভেলা উড়ে যাবে। বাংলার আকাশ বেয়ে আসবে জল। প্রকৃতির রূপ এখন এমনই। বিকেল করে যদি এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যায় ! নিজেকে শান্ত করে প্রিয় মন কাশবন ঘেষে শরতকে বলবে, ভালোই আছি।
ভালো আছি শুনতে পেলে ঘর বলবে, তুমি আত্মকেন্দ্রিক। ঘর যদি বলে ভালো আছি, সমাজ বলবে তোমরা বুর্জুয়াশ্রেণিভুক্ত সামাজিক প্রতিনিধি। সমাজ যদি বলে ভালো আছি, তখন সরকার বলবে, রাজস্ব দাও। সরকার যদি বলে, মানুষ সুখে আছে, রাষ্ট্র বলবে, তুমি শোষক, শাসক নও। রাষ্ট্র যদি বলে, ভালোই আছি, তখন প্রকৃতি বলবে, তোমরা প্রাকৃতিকনীতি না মেনে ধর্মভিত্তিক শাসন কায়েমে ছলেবলে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র কায়েম করে মহান ঈশ্বরকেই ভুলে গেছো।
মানুষ তাঁর বোধ থেকে বিবেক আর আবেগের মিশেলে নিজের পথচলাকে নির্ধারণ করুক। পূর্বসূরি গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস যেমন বলেছিলেন, নিজেকে প্রশ্ন আর উত্তর খোঁজার মধ্য দিয়েই জীবনকে উপভোগ কর। কিন্তু, প্রশ্ন আর উত্তর খুঁজতে মানুষ ফলত ইচ্ছুক নয়।
সামাজিক ক্রমবিকাশের কেন্দ্র হয়ে পুঁজি, ক্ষমতা ও যৌন আকর্ষণ গ্রাস করেছে। কাদেরকে? মানুষ নামের বুদ্ধিমান গোত্রের জীবকুলকে। এতটাই প্রভাব ফেলছে, মানুষ কার্যত জীবন সংসারে বৈষয়িক। ঘর তাঁর সামাজিক নিরাপত্তা চায়। অন্যদিকে, সমাজ ধর্মের কাছে বন্দিত্বে।
এদিকে রাজনৈতিকদলগুলো বলে জনস্বার্থের কথা, কিন্তু সারাবিশ্বের শ্রেষ্ঠ তিনশত রাজনৈতিক দল বাছাই করতে গেলে কষ্ট হবে। ধনী রাষ্ট্র হওয়ার জন্য যারা কাজে করেছে বা এখনো ধারাবাহিকতা রক্ষা করে যাচ্ছে, তাঁদেরকে পথ প্রদর্শক বা প্রফেট হিসাবে অবশ্য ধরতেই হবে।
বাংলাদেশের শাসন নিয়ে যারা কাজ করছে তাঁদের কে ঘিরে লিলিপুটের আকার নিয়ে থাকা প্রায় একটি ছোট্ট জনগোষ্ঠীর চিৎকার রয়েছে। যে চিৎকার ফলত গ্যালিভারদের কানে মৃদু আওয়াজে আসে, কিন্তু গুরুত্ব পায় না।
লিলিপুট বলতে? সাহিত্যের পাড়ায় কবি নেই, লেখক নেই— তাই কারোর নামের পাশে উপন্যাস থেকেও, আসলে নেই। সত্তর আশিটা উপন্যাস লিখলেই তো ঔপ্যনাসিক হওয়া যাবে না। ওরা যে লিলিপুট, লিলিপুট সাহিত্যিক!
ইতিহাসের ধারাভাষ্য দিয়েই তো তাঁদের লেখনি শৈলী প্রমাণ করে রাগাশ্রয়ী সুর লিখিত ছন্দে বন্দিত হয়ে বলবে, কী নেই বলো, যা লিখেছি? কিন্তু, সাহস করে কেউ তো বলতে পারছে না। বরং তারা বই স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে বই বিক্রির আশায় ভিক্ষুকের মত বলছে, আমি অমুক আহমেদ তমুক গঙ্গোপাধ্যায়!
সঙ্গত যুক্তিতে নিজের জীবন থেকে শুরু করে ঘর, সমাজ, সরকার কিংবা রাষ্ট্র সম্যক উন্নত ধারণা নিয়ে বাংলাভাষি জনশ্রেণি বেড়ে উঠে শিক্ষিত হতে পারেনি। একজন ফেলো করা ব্যক্তিসত্তাও শিক্ষিত হতে পারছে না।
বাংলাদেশ এমন একটি জনশ্রেণির দেশ, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অতি উচ্চশিক্ষিত হয়েও তারা তাঁদের কথিত সংসারের বৈঠকখানার পাঠাগারে প্রধান পুস্তক হিসাবে দেশের সংবিধানটি কে জায়গা দিতে পারেনি। নিজ অর্থে সংবিধান ক্রয় করেনি, করবে না। কিন্তু, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সরকারকে তাড়ানোর জন্য ব্যক্তিবিশেষ বা গোষ্ঠীর কথিত গণতন্ত্রমুখী লড়াইকে বাহবা দিয়ে, হাত তালি দিয়ে বলবে, তোমাদের সাথে আছি। তাঁরা ভুলে যায়, প্রফেট বঙ্গবন্ধুর কথা। তাঁরা গ্যালিভার শেখ হাসিনার উন্নত চিন্তাকে অবজ্ঞা করে।
তোমাদের সাথে আছি বলতে হলে, সেই রাজনৈতিক দলের পক্ষ হতে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েমের ঘোষণাকল্পে উদ্যোগগুলো তবে নিশ্চিত কর। তা তো দেখি না। সেই গোষ্ঠীকে প্রমাণ করে বলতে হবে, আমরা জাতীয়তাবাদী, জামায়াতেবাদী নই। সেই রাজনৈতিক দলকে অতি অবশ্যই রাষ্ট্র ধনী হবে, তা প্রমাণকরত যুক্তি পেশ করতে হবে। কিছুই তাঁরা করবে না, কিন্তু বামন জনশ্রেণি খুব জ্ঞানী সেজে বলবে, আওয়ামী লীগ অজনপ্রিয়।
খুব সস্তা আলোচনা হলেও বলা দরকার যে, বেগম খালেদা জিয়া তো বামন রানি ছিলেন। না, তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা ছিল, না ছিল তাঁর স্থানীয়- বৈশ্বিক রাজনৈতিক জ্ঞান। কী ছিল তাঁর? লিলিপুটের দেশের রানি হওয়া ছাড়া তো কিছুই দেখি না। ‘চলনে বলনে ভিক্টোরিয়া-মাথার ভেতরে তো আন্ডা!’
বাংলাদেশ এগোবে। গ্যালিভার শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই এগিয়ে যাবে। যখন ব্যক্তিমালিকানায় ৬০ বিঘার ওপর কারোর জমি থাকতে পারবে না, এমন আইন প্রণয়নের কথা শুনছি, এই দেশ সামাজিক নিরাপত্তার বলয় তৈরি করে এগিয়ে যাবে। প্রতিটি মানুষ অর্থনৈতিক নিরাপত্তার মধ্যে যাবে। এখন নিম্নবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষ এই দেশে ভালো আছে। খুবই খারাপ আছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। যা একজন শেখ হাসিনাও উপলব্ধি করছেন। আগামী তিন বছরের মধ্যে দেশের মধ্যবিত্তশ্রেণি সুখময় জীবনে চলে যাবে। তবে একটি কথা বলাও দরকার যে, মানুষ সঞ্চয়মুখী যেন না হয়, রাষ্ট্র যদি তোমার চলার গতিপথের মসৃণতা নিশ্চিত করে, কেন সঞ্চয়ী হয়ে সুখে থাকার বন্দোবস্তে যেতে হবে? ঈশ্বর তখনই নারাজ হয়, যখন তুমি বৈষয়িক হয়ে সম্পদ, অর্থের জন্য যা খুশি করছো।
একান্ন বছর বয়সী বাংলাদেশ এখন পররাষ্ট্রনীতি দাঁড় করাতে পারছে। প্রতিবেশী আধিপত্যবাদী শক্তি ভারত সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে কয়েকটি দেশে অবাধ সামরিক ও অর্থনীতি কায়েমে সফল হলেও বাংলাদেশই এখানকার একমাত্র দেশ যে কারোর খবরদারি চলছে না, চলবে না। বাংলাদেশ বরং খুবই চতুরতার সাথে চীন ও ভারতের সাথে সম্পর্ক ধরে রেখে ‘নীতি’ দাঁড় করাতে পেরেছে। যা সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনার জন্য। তিনি দিল্লি থেকে ফিরে এসেছেন। এখন তিনি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে অনুমিত হয়।
তবে, লিলিপুটের দেশে গ্যালিভার হওয়ার বিড়ম্বনাও আছে। খোদ আওয়ামী লীগের মধ্যেও নেতাদের মধ্যে অধিকাংশের মান লিলিপুট গোছের। বেগম জিয়ার মতো! আবার কর্মীরাও তো আর ইউরোপ থেকে বেড়াতে আসেনি। তাঁরাও লেখাপড়া করে রাজনৈতিক- সাংস্কৃতিক জ্ঞান অর্জন করে বঙ্গবন্ধু-শেখ হাসিনার দল করার সক্ষমতা অর্জন করেনি। এখানেই জাতির দুর্ভাগ্য।
আমাদের ভালো সাংবাদিক নেই, রাজনীতিক নেই, সংস্কৃতিকর্মী নেই— সব জায়গায় গরিব প্রেক্ষাপট ও গরিব সত্তাদের মিছিল সমাবেশ। তবে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ ক্রিকেট ও একজন শেখ হাসিনা আমাদের প্রাপ্তি। এমন চিন্তা করেই এগিয়ে যেতে হবে। লিলিপুটের খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
আওয়ামী লীগ তাঁদের রাজনৈতিক পথচলায় যে ক’জন সাধারণ সম্পাদক পেয়েছিলেন, আমি বলব তাঁদের সবাই গ্যালিভার না হলেও কয়েকজন তেমন ছিলেন। জিল্লুর রহমান, আব্দুল জলিল কিংবা সৈয়দ আশরাফ কিংবা ওবায়দুল কাদের তো বটেই। আসন্ন সম্মেলনে তাঁরা একজন গ্যালিভার গোত্রের সাধারণ সম্পাদক বাছাই করুক। একজন শেখ হাসিনার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে রাজনীতি করতে হলে এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন তেমন মানেরই চরিত্র হয়ে দাঁড়াতে পারেন। অন্যদের মধ্যে মাহবুবুল আলম হানিফ কিংবা মির্জা আজমও একদিন পরিণত হবেন বলে মনে করার সুযোগ আছে।
সংবিধান হলো, মানুষের স্বাপ্নিক কাঠামোগত প্রায়োগিক নির্দেশনা, যা রাষ্ট্র কর্তৃক অনুমোদিত হয়ে আদেশক্রমে অনুরোধের ফলাফল। সংবিধান না পড়ে, দেশের জাতীয়তা প্রশ্নে একসূত্রে না থেকে কোন জাতির ভাগ্য পরিবর্তন হয় না। একজন শেখ হাসিনা তা বোঝেন। পথ প্রদর্শক হয়ে তাই তিনি বলছেন, বাংলাদেশ আগে এগিয়ে যেতে থাকুক। অতঃপর জনশ্রেণিও একদিন সত্যিকারের শিক্ষিত হয়ে পড়বে। তখন আমরা আমাদের শাসনরীতি ও অনুশীলন নিয়ে ব্যস্তও হয়ে পড়ব। কেহ আমাদের লিলিপুট বলতেও পারবে না ‘সেদিন’।
তাল পাকার সময় এখন। তেমন উষ্ণতা প্রকৃতিতেও। আবার সমাজেও। তাই রাজনৈতিক তালও পাকবে। রাজনৈতিক অপশক্তি মোকাবিলায় দেশবাসীকে বলব না, গ্যালিভারদের সতর্ক থাকতে হবে। সমস্যা হলো, বাংলার রাজনৈতিক আকাশে এই মেঘ, এই রোদ আর বৃষ্টির খেলায় শেখ হাসিনার লাল সবুজের বাংলাদেশে অতিথি অপশক্তির আনাগোনা বেশি।
ঋতুকে সম্মান না জানিয়ে যেমন প্রকৃতিও নানা রূপ দেখাচ্ছে, রাজনীতিতেও তাই। এরপরেও রয়েছে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনাকে অবমাননা করার কতিপয় অনুশীলনও। যা কষ্ট দেয়। গাজীপুরের বরখাস্ত মেয়র জাহাঙ্গীর আলম যেমনটি করেছিলেন। খুবই দুঃখজনক। জাহাঙ্গীর আলম কে রুখতে প্রায় দেখি আলোচিত আদম তমিজী হক অদম্য সত্তা হয়ে এখনো তার শাস্তির জন্য লড়ছেন। তিনি এর বিহিত চান। সূত্রমতে আদম তমিজী হক তো গাজীপুরের মেয়র হতে চান না, কিন্তু, তিনি মনে করছেন, ‘এই প্রতিবাদ না করলে এমন অসংস্কৃতি চলতে থাকবে। যা বরদাশত করার সুযোগ নেই।’ আসলে এমন যেই করবে তাঁদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাওয়ার সময় হয়েছে। একইসঙ্গে জনস্বার্থ ব্যতিরকে যারা আন্দোলনের নামে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করবে, সেখানেও শক্ত প্রতিরোধ দরকার বটে।
লেখক: সাংবাদিক, গবেষক