একজন অন্তর্মুখী কবির আখ্যান
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৭:৫৮
‘এক আশ্চর্য ফুল বিনয় মজুমদার’ বইটি নিয়ে কথা বলতে গেলে ক্রমশ অন্তর্গামী তিনটি পর্যায়ে কথা বলা প্রয়োজন। প্রথম পর্যায় হলো বইটির বাহ্যিক বিষয় এবং দ্বিতীয় পর্যায় হলো এর ভিতরে কী কী বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সেগুলো। সর্বশেষ তৃতীয় পর্যায়টি হলো অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলির ভেতরে আসলে কী কী অন্তর্লিখিত বক্তব্য আছে তা অংশত উন্মোচন করার চেষ্টা করা। ‘অংশত উন্মোচন’ শব্দ দুটি সচেতনভাবে প্রয়োগ করা গেল কারণ পরিপূর্ণ উন্মোচন করার সাহস দেখানো যাবে না, যেহেতু বইটি অনেক বড় আকারের। যদি আমাদের গন্তব্যটা একটা রেখায় দেখতে চাই তবে বলা যায়— ক্রমশ ভেতরে প্রবেশ্য!
বাহ্যিক বিষয়:
‘এক আশ্চর্য ফুল বিনয় মজুমদার’ বইটি আট শ’ সতেরো পৃষ্ঠার একটি বৃহৎ কলেবরের বই। আশ্রয় প্রকাশনের প্রশ্রয়ে এবং নিবিড় ছত্রছায়ায় বইটি প্রকাশিত হয়েছে এপ্রিল ২০২১-এ বাংলা একাডেমির বিলম্বিত বইমলোতে। বইটির প্রচ্ছদের কারিগর রাজিব দত্ত। বইটির মোটিফ ও অলংকরণে ছিলেন দেবাশিষ সাহা, সানজিদা সুলতানা। বইটি সম্পাদনা করেছেন দুই তরুণ সম্পাদক এহসান হায়দার এবং স্নিগ্ধদীপ চক্রবর্তী। মূল্য রাখা হয়েছে ১৪৫০.০০ টাকা। এই বইটির বাহ্যিক দৃশ্য অর্থাৎ প্রচ্ছদ, ছাপা, বর্ণবিন্যাস, অলংকরণ, ছবি, ডিজাইন— সর্বক্ষেত্রে একটা মানসম্পন্ন পরিচ্ছন্ন রুচি এবং মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন এর পেছনে যারা কাজ করেছেন বিশেষত দুইজন বয়সে তরুণ সম্পাদক। কোথাও এতটুকু কৃপণতা বা অদক্ষতার ছাপ লক্ষ্য করা গেল না। সত্যি বলতে কী বইটি হাতে নিলে মন ভালো হয়ে যেতেই পারে। মনে হতে পারে— কতটা যত্ন আর মমতা দিয়ে এতবড় কাজটা সম্পন্ন করা হয়েছে। বিশেষত আমরা যদি আমাদের বইয়ের অভিজ্ঞতার সাথে পক্ষপাতহীন বিবেচনা করি। আমার জানা মতে এপার বাংলা ওপার বাংলা মিলে বিনয় মজুমদারকে নিয়ে এতবড় সংকলন আর বের হয়নি। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ‘এক আশ্চর্য ফুল বিনয় মজুমদার’ একটি বিনয় মাইল ফলক। ভবিষ্যতে যদি কেউ বিনয়কে নিয়ে কাজ করে মাইলফলক স্থাপন করতে চান তবে এই বইটিকে মাথায় রেখে, অর্থাৎ এরপরে গিয়ে ফলকটি স্থাপন করা অনিবার্য হয়ে পড়বে। সুতরাং গণনাটি এই বই থেকে শুরু করা জরুরি হয়ে পড়বে। একটা মলাটে সম্পূর্ণ বিনয় মজুমদার বলতে এই গদ্যপ্রধান বইটিকে চিহ্নিত করতে পারি, পাঠকের কাছে তুলে ধরতে পারি এবং একই সাথে একটি বিনয়-মহাগদ্য হিসাবে আখ্যায়িতও করতে পারি।
ভিতরে কী কী বিষয় অন্তর্ভুক্ত:
‘এক আশ্চর্য ফুল বিনয় মজুমদার’ বইটির ভেতরের বিষয়গুলো উৎসাহব্যঞ্জক, গুরুত্বপূর্ণ এবং পরিপূর্ণমূলক। উড়ন্ত সূচনা করা হয়েছে দুটি গদ্য দিয়ে। একটা হলো ‘অন্তরালে, বিনয়দর্শন শূন্য এক সত্যের ব্যথা’ এবং অন্যটা হলো ‘কেন বিনয় মজুমদার’। উৎসর্গ করা হয়েছে দুইজন শিক্ষাগুরু ও দিকপাল সাহিত্যিক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ এবং অধ্যাপক গণেশ বসুকে।
বইটির শুরুতে দু’জন সম্পাদকের মুখবন্ধমূলক দুটি প্রবন্ধের পর প্রথমভাগে বিনয় মজুমদারের জীবনী রাখা হয়েছে, যেখানে তাঁর বর্ণাঢ্য ও অবহেলিত জীবন-আলেখ্য লিপিবদ্ধ করা হয়েছে ‘জীবন কথা’ শিরোনামে। এরপর ‘বিনয়কথকতা’ শিরোনামে একষট্টিটি বিনয়বিষয়ক প্রবন্ধ লিপিবদ্ধ হয়েছে যা এপার-বাংলা ওপার-বাংলার একষট্টি জন প্রখ্যাত, অখ্যাত নবীন-প্রবীণ লেখকদের লেখা। এরপর ‘স্মৃতিগদ্য’ পর্ব শিরোনামের অধীনে বিনয় মজুমদারকে দুটি গদ্য রাখা হয়েছে। এরপর কবিকে নিয়ে কবিতা শিরোনামে বিনয়মজুমদারকে নিয়ে দশজন প্রথিতযশা কবি কবিতা লিখেছেন। এরপর পর্ব শিরোনাম ‘বিনয়কে নিয়ে চিত্রনাট্য’। এরপর বিনয় মজুমদারের সাক্ষাৎকার শিরোনামে তিনটি সাক্ষাৎকার রাখা হয়েছে। এরপর আলাপচার পর্ব শিরোনামে তিনটি লেখা বিন্যস্ত হয়েছে। এরপর বিনয়ের আত্মকথন পর্ব শিরোনামে মোট পাঁচটি লেখা সজ্জিত হয়েছে। এরপর ‘অপ্রকাশিত ও অগ্রন্থিত বিনয়’ শিরোনামে গল্প, গদ্য, কবিতা, ছড়া, লিমেরিক, চিঠি, জ্যামিতি ও বীজগণিত, বিনয়ের আঁকা ছবি এবং বিনয়ের হস্তাক্ষর জায়গা পেয়েছে।
এরপর বিনয়-কবিতার অনুবাদ, কবিতা থেকে চিত্রকলা, অ্যালবাম, উবাচ, বিনয়ের বংশতালিকা, বিনয়ের সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জী এবং সর্বশেষ লেখক পরিচিতি জায়গা পেয়েছে। এতবড় বিশাল সূচি নিয়ে ‘এক আশ্চর্য ফুল বিনয় মজুমদার’ বইটি প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিটি পর্বের শুরুতে একটি হ্যান্ডমেড কাগজে বিনয়ের ছবি চিত্রিত আছে যা রচনা করেছে পর্ব পার্থক্য।
‘এক আশ্চর্য ফুল বিনয় মজুমদার’ বইটিতে দুই বংলার অনেক দিকপাল লেখকদের লেখা সংবলিত হয়েছে যেগুলো সংগ্রহ করাতে নিঃসন্দেহে দুই তরুণ সম্পাদক মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন অজস্রলেখার ভীড়ে স্বজনপ্রীতি এবং অনুরোধ-সুপারিশের মায়াজাল অতিক্রম করে যোগ্যতম লেখাটি বাছাই করার দক্ষতায়। সম্ভবত তারা নাম, পদমর্যাদা, ডিগ্রী কোনোটার উপর বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে কেবলমাত্র লেখার মানের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন সেটা লেখাগুলি পড়লেই সহজে অনুমান করা যায়। আর এজন্য তরুণ এবং প্রবীণ সব ধরনের লেখকদের একটা সুসমন্বয় ঘটেছে। আর তাই এখানে ঋত্বিক ঘটকের মতো লেখকের সাথে অনেক নবীন লেখকরাও ঠাঁই পেয়েছেন শুধুমাত্র কলমের জোরে।
আসলে কী কী অন্তর্লিখিত বক্তব্য আছে:
‘এক আশ্চর্য ফুল বিনয় মজুমদার’ বইটির শুরুতে ‘অন্তরালে, বিনয়দর্শন শূন্য এক সত্যের ব্যথা’ এবং ‘কেন বিনয় মজুমদার’ প্রবন্ধ দুটি বিনয় সম্পর্কে কিছু মৌলিক প্রশ্ন এবং কৌতূহলের মীমাংসা হয়ে যাবে।
‘অন্তরালে, বিনয়দর্শন শূন্য এক সত্যের ব্যথা’ এই গদ্যটিতে বিনয়ের যে অন্তরালবর্তী কারিগরি দক্ষতার শৈল্পিক আঁচড় সেগুলি বিধৃত হয়েছে পরম মমতায়। বিধৃত হয়েছে তাঁর গাণিতিক উচ্ছ্বাস, বাংলা কবিতার বাঁক বদলে তাঁর ভূমিকা, নৈঃসঙ্গ, শূন্যতা এবং ধ্বনি-প্রতিধ্বনির সুরশ্রী খেলা।
‘কেন বিনয় মজুমদার’— এটি একটি মৌলিক প্রশ্ন বটে! এখানে বিনয়ের যে নিজস্বতা, বিষয়বস্তু এবং বাচনভঙ্গি সেটা চিহ্নিত হয়েছে। লেখাটি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে বিনয়ের কিছু কাব্যের আঙ্গিক, ব্যাকরণ এবং আধুনিক বাংলা ও বাঙালিকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি।
এরপর ‘জীবন কথা’ শিরোনামে কবি বিনয় মজুমদারের জীবনী বর্ণনা করা হয়েছে মাঝারি ধরনের আকারে। এরমধ্যে আলোচিত হয়েছে বিনয়ের পুরো জীবনকাহিনী। তাঁর জন্ম এবং ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে ক্রমশ বেড়ে ওঠা। তাঁর জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জীবনের প্রয়োজনে স্থান পরিবর্তন এবং এটা তাঁর জীবনকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। পিতার চাকরির সূত্রে প্রথম জীবনে বারবার স্থান পরিবর্তন এবং পরে তাঁর শিক্ষা ও কর্মজীবনের জন্য বিভিন্ন স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে। এই মেধাবি কবির জীবন কেটেছে চরম অবহেলা, আঘাত, অর্থকষ্ট এবং অপমানের ভিতর দিয়ে। তবে তার ভেতর দিয়েও যেমন প্রকৃত আলোকে শত অন্ধকার ঢেকে রাখতে পারে না তেমনই বিনয় মজুমদার উদ্ভাসিত হয়েছেন নিজস্ব দীপ্তিতে। মেরুদ- সোজা করে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে তৎকালীন সমাজ ও সাহিত্যের মুখোমুখী। সময়ের ভ্রূকূটিকে পরাজিত করে যুগযুগ ধরে তাঁর ‘ফিরে এসো, চাকা’ পাঠক হৃদয়ে প্রতিধ্বনি তোলে এবং প্রকৃতপক্ষে তাঁর প্রেমকে ফিরে আসার আহ্বান জানায়। বিনয়ের জীবনে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো গণিত। শুধু গণিত নিয়ে তাঁর যে গ্রন্থাবলী তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকার মতো। অনুবাদক হিসাবে বিনয়ের কাজ মনে রাখার দাবি রাখে। অনুবাদক হিসাবে তাঁর যে কাজ সেটা কোনো সৌখিন কাজ নয় বরং তা এক দারুণ পেশাদারিত্বে রূপ নিয়েছে। তিনি ছিলেন একজন তুখোড় রেজাল্ট করা প্রকৌশলী। তাঁর মস্তিষ্কে প্রকৌশলবিদ্যার কলাকৌশল ও তত্ত্ব গোঁজা থাকলেও অস্থি-মজ্জায় গেঁথে থাকে কবিতা। তাই তাঁকে আমরা বার বার শব্দপল্লীর কবিতার ঘরেই আশ্রয় নিতে দেখি। তাঁর মূল্যায়নে আমাদের আফসোস থেকে যেতেই পারে, তবে সেই আফসোসের অতসী কাচের ভেতর দিয়ে আমরা দেখতে পাবো তাঁর মূল্যায়ন বা পুরস্কার একেবারে কম ঈর্ষনীয় নয়।
এরপর ‘বিনয় কথকতা’ শিরোনামে একষট্টিটি বিনয় বিষয়ক প্রবন্ধ লিপিবদ্ধ হয়েছে যা এপার-বাংলা ওপার-বাংলার একষট্টি জন লেখকের রচনা।
প্রথমে অদ্রীশ বিশ্বাসের লেখা বাল্মীকির কবিতা: যৌনতার ভাষ্য নির্মাণের দিকে তাকাই। এটি বিনয় মজুমদারের সবচেয়ে বিতর্কিত একটি কাব্যগ্রন্থ, যেটি সমাজ ও তথাকথিত চিন্তাভাবনা কবিকে ছিঁড়ে তছনছ করে দিয়েছিল। অপমানের চূড়ান্ত সীমানায় পৌঁছে দিয়েছিল। এখানে যৌনতাকে যে শিল্পিত রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা তা বিভিন্ন প্রতীক দিয়ে উপস্থাপন করেছেন।
অমিয় দেব লিখেছেন কবিতা, গণিত ও বিনয় মজুমদার। শিরোনামের তিনটি বিষয়ই একটি অপরটির সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত, সৃষ্টি তাত্ত্বিকভাবে সম্পর্কিত। ‘কবিতা’ অথবা ‘গণিত’ যে কোনো একটির সাথে বিনয় মজুমদার যুক্ত থাকলেও বিনয় মজুমদার নামটি আমাদের সামনে এমনই উজ্জ্বল থাকতো। হাজার নামের ভীড়ে আমাদের তাকে খুঁজে বের করতে হতোই। তাঁর গণিত রচনা প্রসঙ্গে অমিয় দেব লিখেছেন— “…অবিরাম গণিত রচনা করে চলেছেন। যেন এক্স ও ওয়াই এর এক রুদ্ধশ্বাস উপন্যাস। লাল খাতার পর হলুদ খাতা, হলুদের পর সবুজ— কখনো কখনো দিনে পঞ্চাশ-ষাট পৃষ্ঠা পর্যন্ত লিখে উঠেছেন। লিখেছেন ইংরেজিতে, মলাটে কোনো খাতার নাম ‘কনিক সেকশন’ কোনোটার ‘ইন্টার পোলেশন সিরিজ’। তাঁর এই রচনাসমূহের গাণিতিক মূল্য বিচার করার যোগ্যতা আমার ছিল না।” বোধকরি অমিয় দেবের এই গণিত-ভূমিকা তাঁর গণিত রচনার মান নিয়েও সামান্য নাড়া দিয়ে যায়। এই প্রসঙ্গটি সংক্রমতি হয়েছে বিজয় সিংহের বিনয় ‘মজুমদারের আরশি নগর’ প্রবন্ধেও। ‘বেদনার আলো’ জয় গোস্বামীর এক বিনয়হীন পরিবেশে তার লেখা হতে আবিষ্কৃত আলোক বিচ্ছুরণ। একটু জয় গোস্বামীর যুক্তিটা পড়ে দেখা যাক— কোনো কবি যথার্থ শক্তিশালী কিনা তা বোঝার অন্যতম উপায় হলো তার এই নতুনত্ব সৃষ্টি করার ক্ষমতাকে খুঁজে পাওয়া।
‘অভিভূত প্রত্যাশায় এরূপ বিরহ ব্যথা ভালো।’
এই পংক্তিটি ছেড়ে অন্য কয়েকটি বলি—
কোনোকালে কোনো আততায়ী
শত্রু ছিল বলে আজও কাঁটায় পরিবেষ্টিত হয়ে
গোলাপ যেমন থাকে, তেমনি রয়েছো তুমি। আমি
পত্রের মতন ভুলে অন্য এক দুয়ারের কাছে।
ঋত্বিক ঘটক লিখেছেন, সাম্প্রতিককালের এক কবি। এই শিরোনামের মধ্যে দিয়ে বোঝা যায় বিনয়কে কতটা আধুনিক আখ্যায়িত করেছেন। চমৎকার করে রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রবন্ধটির প্রাসঙ্গিক অবতারণা করেছেন। কবিতার অন্তর্গত তাত্ত্বিক আলোচনা দিয়ে প্রবন্ধটির কাঠামো বা কঙ্কাল রচনা করা হয়েছে।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় বিনয় মজুমদার প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তিনি লিখেছেন কবিতা ‘বিষয়ক প্রস্তাব’। প্রস্তাবটি কয়েকটি খ-িত বিষয়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এরপর তিনি খ-গুলিকে তত্ত্বের হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো করেছেন, উন্মোচন করেছেন বিনয়ের কবিতার অন্তর্গত রহস্য।
উৎপল বসু লিখেছেন, ‘বিনয় মজুমদার : তাঁর কবিতা’। উৎপলকুমার বসু শুরু করেছেন, ‘বিনয় মজুমদার প্রসঙ্গে আমার পক্ষে কিছু লেখা দুরূহ।’ এই মিথ্যা ভাষণের পর দেখা যাবে কত সহজে বিনয়ের কবিতা প্রসঙ্গে চিরে চিরে দেখেছেন চিরল তেঁতুল পাতার মতো। তবে এই বাক্যটির সত্যতা খুঁজতে গিয়ে মনে হয় উৎপলকুমার বসুর মনে হতে পারে বিনয়ের যে পরিমাপ, গুণগত মানের যে ব্যাপ্তি তা ঠিক মতো বলতে পারবো তো! সেই দৃষ্টিকোণে এটি দুরূহ মনে হওয়াটা সত্যি। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি এক ধাঁধার মধ্যে দিয়ে পরিসমাপ্তি টেনেছেন প্রবন্ধটির।
কালিকৃষ্ণ গুহ লিখেছেন, বিনয় মজুমদারের বিরহ বসবাস ও মহাপয়ার। বোধকরি এই ‘বিরহ বসবাস’ ও ‘মহাপয়ার’ বিনয়ের কবিতার সাথে কাঁধে-নিঃশ্বাসে জড়িত। গায়ত্রী চক্রবর্তী হলো ‘গায়ত্রী চাকা’। এই গায়ত্রী চক্রবর্তী পরে আমেরিকায় চলে যান। কবির সাথে তিন-চার দিনের আলাপের সূত্রে যে হৃদকম্প তৈরী হয়েছিল তা সেই আমেরিকা যাওয়ার সাথে সাথে বিরহ বাসে পরিণত হয়। আর মহাপয়ার (৮+১০) কবির সবচেয়ে প্রিয় ছন্দ (অক্ষরবৃত্তের একটি মাত্রাগত বিশেষ ধরন)।
বাসুদেব দাশগুপ্ত লিখেছেন, প্রসঙ্গ: বিনয় মজুমদার। এখানে বিনয়ের লেখার উপস্থাপন ও বিষয়গুলিকে আলোচনা করা হয়েছে। এরপর গৌতম বসু লিখেছেন, অঘ্রানের অনুভূতিমালা এবং কালসীমাবৃত্ত : একটি টীকা। অঘ্রানের অনুভূতিমালা এমন একটি কবিতামালা যা ছয়টি সর্গে চব্বিশ ঘণ্টার এক সময়বৃত্তে সাজানো মালা যা তাত্ত্বিক সুতোয় সংযোজিত অনুভূতিরাশি। অঘ্রানের অনুভূতিমালাকে বিনয়ের অন্যতম প্রধান কাজ হিসাবে ধরা হয় এবং যেখানে বহুমাত্রিক কাজটিতে অতিগোপনে প্রাকৃতিক শৃঙ্খলার একটি আকৃতি স্থাপন করেছেন।
শৈলেশ্বর ঘোষ লিখেছেন, আমরা দন্ডিত হয়ে জীবনের শোভা দেখে যাই। এটি লেখকের একটি ব্যাক্তিক চরম বিনয়-অভিজ্ঞতা। ঊষাপ্রসন্ন লিখেছেন, স্মৃতির মন্তাজে বিনয়। এখানে লেখক বিনয় মজুমদারের জীবনের একটা খন্ডিতকাল সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেছেন যেখানে গায়ত্রী চক্রবর্তী ও বিনয় মজুমদার সম্পর্কে বেশ কিছুটা আবিষ্কার করা গেল। তাদের মর্মর সম্পর্কের নৈঃশব্দ্য এখানে ধ্বনিত হয়েছে যা শুধু অনুমান করে নেওয়া যায়।
বিপ্লব চক্রবর্তী লিখেছেন, বিনয় মজুমদারের কবিতায় লোকাভরণ। এখানে বিনয় মজুমদারের লেখার শৈলী নিয়ে কথা বলা হয়েছে।
বিনয়ের সবচেয়ে কাছের বন্ধু জ্যোতির্ময় দত্ত লিখেছেন, বিনয় মজুমদার। লেখক সম্পূর্ণ লেখাটিকে তিনটি বিশেষ ভাগে ভাগ করেছেন। ভাগগুলি এরকম : ১. ব্যক্তি, ২. কবিতা : প্রথম পর্ব, ৩. কবিতা : পরবর্তী পর্ব। ভাগগুলি দেখেই বোঝা যাচ্ছে প্রথমটি ব্যক্তি বিনয় এবং পরবর্তী ভাগ দু’টিতে তাঁর কবিতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
বুদ্ধদেব বসুর কন্যা মিনাক্ষী দত্ত লিখেছেন, দীর্ঘদিন বিনয়ের সাথে। মিনাক্ষী দত্ত এবং জ্যোতির্ময় দত্তের বাড়িতে বিনয়ের থাকাকালীন মিনাক্ষী দত্তর যে বিনয়-অভিজ্ঞতা সেটাই এখানে বর্ণিত হয়েছে। এখানে বিনয়ের কিছু বিকৃতি তুলে ধরা হয়েছে। তুলে ধরা হয়েছে বিনয়ের প্রতি কিছু লেখক বন্ধুর আশ্রয়-প্রশ্রয় এবং দায়িত্ববোধ।
জহর সেনগুপ্ত লিখেছেন, বিনয় মজুমদার : একটি পর্যালোচনা। এটি আটটি পর্বের এক বাস্তব বিনয় পর্যালোচনাই।
সনাতন পাঠক লিখেছেন, একটি অসাধারণ কবিতার বই। এই অসাধারণ কবিতার বইটি হলো ‘ফিরে এসো, চাকা’। এই বইটি সম্পর্কে অনেকেই বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছেন। কারণ এই বইটি বিনয়ের জনপ্রিয়তার চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। আমরা এই লেখা থেকে আরো একটু উন্মোচন করে নিই। ‘‘ফিরে এসো, চাকা’র কবিতাবলি ১৯৬০-এর মার্চ থেকে ১৯৬২-এর ২০ জুনের মধ্যে লেখা। এই কবিতার কোনো আলোচনা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কবিতাগুলো একনজর পড়লেই বোঝা যায় দুর্লভ এক কবির হৃদয় বা মস্তিষ্ক এগুলো রচনা করেছে, এই কবিতা চৈতন্যের অনেক ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। এই কবিতা উপভোগ করার, আলোচনার নয়’’— লেখকের এই সরল আত্মসর্মপণ এবং প্রস্তাব বিনয়ের এই বইটির কবিতাকে অন্য এক উচ্চতায় উন্নীত করে।
মৃদুল দাশগুপ্ত লিখেছেন, মহাশিশুর দৌরাত্ম্যময় আগামী পৃথিবী। এটা লেখকের এক দারুণ আলোচনামুখর স্মৃতিচারণ। “তীরে যে জলোচ্ছ্বাস, তরঙ্গ-বিক্ষোভ, সে ঢেউ পেরোলেই শান্ত সমুদ্র; শোকসাগরে আমরা এখন সেই স্থির অবস্থানে। হাহাকার স্তিমিত হয়েছে। এবার জেগেছে যে শূন্যতা, তারই ভেতর চূর্ণ চূর্ণ হয়ে আছেন বিনয় মজুমদার। এখন থেকে আমাদের সাধনা ওই শূন্যের ভেতর তাঁর অবয়ব খুঁজে পাওয়ার। অর্থাৎ এইতো সেই সময়, তার পুনরুজ্জাীবনের সূচনার ”— শুরুর এই পংক্তিমালা আমাদের যে শূন্যতার মধ্যে ডুবিয়ে দেয় যার মধ্যে থেকে বিনয়কে খুঁজে পাওয়ার আভাস দেয়।
শ্রীতরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, বিনয় মজুমদারের কবিতাতত্ত্বের সংক্ষিপ্ত পরিচয়। লেখক বিনয়ের কবিতা তত্ত্বকে মোট পাঁচটি পর্বে পরিচয় ঘটিয়েছেন এই প্রবন্ধটিতে।
আর্যনীল মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, আমাদের জ্ঞানদন্ডে এক প্রাপ্ত শুদ্ধতম গণিত… আর অন্যপ্রান্তে কবিতা।
বিনয়ের গণিত ও কবিতা দুটি প্রান্তস্পর্শী ফলক যার কোনোটাকে গুরুত্বহীন ভাবার সুযোগ নেই, পাল্লার দুই প্রান্তের মতো আবদ্ধ ও সম্পর্কযুক্ত।
“ফুলের ভেতরে কোনো জ্যামিতি বা জ্যমিতির ইশারাও নেই
সবফুল মিলেমিশে একাকার এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে
জ্যামিতি জমিতে ছিল, পঙতিতে শুধু জ্যামিতিই ছিল।” (অঘ্রানের অনুভূতি মালা থেকে)
মুজিব মেহদী লিখেছেন, বিনয় মজুমদার বিষয়ে যৎকিঞ্চিৎ। বাংলা কবিতাঙ্গনে ‘কবিতার শহিদ’ বলে খ্যাত বিনয় মজুমদার সম্পর্কে যৎকিঞ্চৎ বলতে গিয়ে তার চিন্তার, চরিত্রের, প্রকৃতির প্রান্ত স্পর্শ করার চেষ্টাই শুধু করেছেন তাই নয়, বরং তার চেয়ে বেশী কিছু বলতে প্রণোদিত হয়েছেন। ‘শুধু কবিতার জন্য বেঁচে থাকা’— এইভাবে ভাবতে পারা গেলে আপনা-আপনি একটি ধ্যানযোগ ঘটে যায় কবি চিত্তে। এই ধ্যানই কবির বক্তব্যকে পৌঁছে দেয় অভাবিত পূর্ব দার্শনিক উচ্চতায়। প্রকৃতপক্ষে লেখক সেই আদর্শের অন্তর্গত ক্রিয়া-প্রক্রিয়া প্রতিফলিত করেছেন এই লেখার গঠনে।
বিনয় মজুমদার সম্পর্কে শামসুর রাহমান লিখেছেন, মেধাবী, অসামান্য কবি বিনয় মজুমদার। এখানে লেখক শিরোনামের মধ্যে দুটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছেন। একটা হলো ‘মেধাবী’ অন্যটা হলো ‘অসামান্য কবি’। বিনয় মজুমদার সম্পর্কে বলতে গেলে তাঁর মেধা এবং কবিত্ব নিয়ে কথা না বলে পারা যায় না। শামসুর রাহমান সেটিই করেছেন দক্ষতার সাথে।
আহমদ ছফা লিখেছেন, যৎকিঞ্চিৎ বিনয় মজুমদার। এই গদ্যটির মধ্যে বিনয়ের প্রসঙ্গে প্রবেশ করতে অনেকটা সময় নিয়েছেন এমনকি তার কাব্য-সন্মোহনের ইতিহাস বলার পর দক্ষতার সাথে বিনয়ের প্রসঙ্গটি অবতারণা করেছেন। বিনয় প্রসঙ্গে তার জমে থাকা কথাগুলো এমন— “তিনি যদি কবিতা না লিখে অন্যান্য বিষয়ের চর্চা করতেন, আমার ধারণা অনায়াসে সিদ্ধি অর্জন করতে পারতেন। তাঁর নানা রকম যোগ্যতা এবং পারঙ্গমতা ছিল। তিনি সব বাদ দিয়ে শুধুই কবিতার সাথে লটকে রইলেন। এটা অবাক ব্যাপার। অথচ বিনয়ের ক্ষেত্রে এটাই সত্য হলো। আমাদের মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। একজন মানুষ যখন প্রেমে পড়ে সেখানে ভালো-মন্দ বাছ-বিচারের প্রশ্নটা গৌণ হয়ে দাঁড়ায়।”
মোল্লা শাহাবুদ্দিন লিখেছেন, “ফিরে এসো, চাকা” কাব্যগ্রহন্থের প্রথম চারটি পংক্তি। আমরা সেই চারটি পংক্তি বা কাব্যটির সেই উড়ন্ত সূচনা দেখে নি—
“একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে
দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে
পুনরায় ডুবে গেলো— এই স্মিত দৃশ্য দেখে নিয়ে
বেদনার গাঢ় রসে আপক্ব রক্তিম হলো ফল।”
এই লেখাটিতে ‘ফিরে এসো, চাকা’ কাব্যের উপরোক্ত প্রথম চারটি লাইনকে লেখক মোল্লা শাহাবুদ্দিন অর্থগত ভাবে টুকরো টুকরো করে ভেঙেছেন। এরপর প্রতিটি টুকরোকে অন্তর-বাহিরে ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে তবে ছেড়েছেন। প্রতিটি ভাঙনে পাঠককে নতুন এক উন্মোচনের সৃষ্টিশীলতার দিকে নিয়ে গেছেন যেখানে পাঠক গঠনতত্ত্বেই পূর্বাপর ডুবে যান এবং ক্রমশ নতুন এক উন্মোচনের দিকে ধাবিত হন। আর এই ধাবিত হতে হতে লেখাটি মনোমুগ্ধতার ভুবন ছেড়ে ভাঙনশিল্পের মর্যাদা অর্জন করে।
এরপর কবিকে নিয়ে কবিতা শিরোনামে বিনয় মজুমদারকে নিয়ে দশজন বিখ্যাত কবি কবিতা লিখেছেন। অসাধারণ কবিতাগুলি বিনয়কে দ্রষ্টব্য করে, আবিষ্কার করে এবং ব্যাখ্যা করে।
এরপরের পর্ব শিরোনাম বিনয়কে নিয়ে চিত্রনাট্য। লিখেছেন নুরুল আলম আতিক। এটি বিনয়কে উপস্থাপনের দৃশ্য ও শিল্পসমৃদ্ধ প্রচেষ্টা।
এরপর বিনয় মজুমদারের সাক্ষাৎকার শিরোনামে তিনটি সাক্ষাৎকার রাখা হয়েছে। এখানেও সাক্ষাৎকার গ্রহীতারা বিনয়কে আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন সংলাপের শব্দমাখা তত্ত্বে।
এরপর আলাপচার পর্ব শিরোনামে তিনটি লেখায় অলংকৃত করা হয়েছে। এখানে আলাদাভাবে বিনয়ের সাথে বস্তুনিষ্ঠ আলাপ করা হয়েছে।
এরপর বিনয়ের আত্মকথন পর্ব শিরোনামে মোট পাঁচটি লেখা সজ্জিত হয়েছে। নিজেকে প্রতিফলিত করেছেন, উপস্থাপন করেছেন এবং চিত্রিত করেছেন এই আত্মকথন দিয়ে।
এরপর অপ্রকাশিত ও অগ্রন্থিত বিনয় শিরোনামে গল্প, গদ্য, কবিতা, ছড়া, লিমেরিক, চিঠি, জ্যামিতি ও বীজগণিত, বিনয়ের আঁকা ছবি এবং বিনয়ের হস্তাক্ষর জায়গা পেয়েছে।
এরপর বিনয়-কবিতার অনুবাদ, কবিতা থেকে চিত্রকলা, অ্যালবাম, উবাচ, বিনয়ের বংশতালিকা, বিনয়ের সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জী এবং সর্বশেষ লেখক পরিচিতি জায়গা পেয়েছে।
উপসংহার:
‘এক আশ্চর্য ফুল বিনয় মজুমদার’ একটি আশ্চর্য সমন্বিত সৃষ্টি। এই বইটি বিনয় সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ ধারণা দেয় এবং একইসাথে এটি জীবনী গ্রন্থ হিসাবে বাংলা সাহিত্যকে ঋদ্ধ করেছে। বইটির প্রতিটি লেখা আলাদা করে বিশদ আলোচনার দাবি রাখে। তবে এই স্বল্প পরিসরে তা সম্ভব না হলেও প্রতিটি পাঠকের অন্তরে তা বর্ণিত হবে, বর্দ্ধিত হবে এবং ধ্বনিত হবে। আমরা অনুমান করে নিতে পারি এতবড় বইটি নিঃসন্দেহে অনেকের দীর্ঘদিনের নিরলস পরিশ্রমের একটি ফসল। অজ¯্র প্রকাশনার ভিতরে এই বইটি মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে এবং পাঠকবর্গের হৃদয় জয় করে নিবে আর জয় করতে করতে সীমানার পর সীমানা পার করবে, ফলকের পর ফলক স্থাপন করবে। এই প্রত্যাশার সাথে সাথে বইটির জন্য ব্যাক্তিক শুভকামনা জানাতেই পারি।
লেখক : কবি ও গল্পকার
সারাবাংলা/এজেডএস