নারী সাফ চাম্পিয়নশিপে অদম্য বাংলাদেশ
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৯:৫৯
ফুটবল, ক্রিকেট নিয়ে আমাদের আবেগের একটা জায়গা আছে। আমরা আবেগী জাতি। দল হারলে কষ্ট পাই। গত কয়েকবছর ধরেই আমাদের আনন্দের উৎসটা মূলত ক্রিকেটকে ঘিরেই হয়েছে। কারণ ফুটবল এগিয়ে যেতে পারেনি। বিশ্ব দরবারে এখনও ফুটবলে নিজেদের মেলে ধরতে পারিনি। তবে ছেলেরা না পারলেও মাঝে মধ্যেই মেয়েরা সেই আনন্দ উপহার দেয়। এই যেমন এখন নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশকে একের পর এক আনন্দঘন মুহূর্ত উপহার দিচ্ছে আমাদের মেয়েরা। একের পর এক বিজয় তাও আবার বিশাল ব্যবধানের তা সত্যি আমাদের গর্বিত করে। বাংলাদেশের সাবিনা, শিউলি, আঁখি, সানজিদা, কৃষ্ণা, রিতু চাকমা, মনিকা, মারিয়া, সামসুন নাহাররা অসাধারণ ফুটবল শৈলীতে বিজয় ছিনিয়ে আনছে। যেখানে প্রতিটি আসরেই ভারত, নেপাল থাকে অগ্রগামীর তালিকায় এখন সেখানে শুধু বাংলাদেশ। সোমবার বাংলাদেশ ফাইনাল খেলবে স্বাগতিক নেপালের সাথে। ফলাফল যাই হোক বাংলাদেশ এ পর্যন্ত যা খেলেছে তাই দেশকে সম্মান এনে দিয়েছে।
একসময় আমরা কলসুন্দর জায়গাটাকে অনেকেই চিনতাম না। আগে আমি এর নামও শুনিনি। বাংলাদেশের আর কয়েকটা সাধারণ গ্রামের মতই এটাও একটা। কিন্তু এখন আর সে সুযোগ নেই। এই সাধারণ গ্রামেই রয়েছে দেশের মুখ উজ্জল করা কিছু অসাধারণ মেয়ে। যে মেয়েরা দেশের গৌরব বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা একসময় এএফসি বাছাই পর্বে মেয়েদের বিজয় থেকে শুরু করে নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশীপের আজকের অর্জন। এ সবই মেয়েদের সাফল্যগাঁথা। কয়েকজন কিশোরী, মুখে রাজ্য বিজয়ের হাসি, হাতে বাংলাদেশের পতাকা উচু করে ধরে রাখা। দেখে মনে হচ্ছে যুদ্ধ জয় করে বিজয়ী হয়ে দেশকে তুলে ধরছে। এদের বয়স কতই বা হবে! এরা তো কিশোরী। কিন্তু এদের হাত ধরেই আমাদের দেশে আজ উচ্ছাসের বেগ। খেলাটা ফুটবল। আমাদের দেশের একসময়কার তুমূল জনপ্রিয় খেলা যা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে গেছে। আমাদের সোনার মেয়েরা। দেশের পতাকা তুলে ধরলো সবার ওপরে। যেন জানানা দিতে চাইছে আমরা আসছি। এই আমাদের দেশ। সেই সাথে আরও একটা দিক জানালো ফুটবল এখনো নিভে যায় নি। আমাদের হাতেই আবার ফিরবে। আমরাই ফেরাবো সোনালী গৌরব।
অথচ সারা বিশ্বে এই দৃশ্য ভিন্ন। বেশীরভাগ দেশেই এই খেলাটাই জনপ্রিয়। ফুটবলারদের তারকাদুত্যিতেই সারা বিশ্বের মানুষ প্রভাবিত হচ্ছে। এই আমাদের দেশেই বিশ্বকাপ বা কোপা আমেরিকা বা ইউরো কাপ খেলার আগে সারা দেশ এক জ্বরে কাঁপতে থাকে। আবার বাছাই পর্বের খেলাতেও মনোযোগ থাকে। এটাকে নাকি বলে বিশ্বকাপ জ্বর। বাড়িতে, বাড়িতে উড়ে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ইংল্যান্ডসহ অন্য দেশের পতাকা। গালে, মুখে সেই দেশের পতাকা চিত্র আকিয়ে রাস্তায় দৌড়ে বেড়াই। মেসি না নেইমার সেই তর্কে দিনরাত কেটে যায়। কোথাও কোথাও তো বাড়াবাড়িই হয়ে যায়। তাহলে আমাদের দেশের মানুষ কিন্তু এক কথায় ফুটবল ভক্ত। সেই বহু বছর আগে থেকে। বর্তমান সময়ের আমাদের দেশের জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট যখন গ্রামে গঞ্জে পৌছেনি তখন থেকে। ঐ যে বললাম খেলাটা ফুটবল। ফুটবল খেলার এখন আর সেই গৌরব নেই। নেই সেই সোনালী অতীত। আবাহনী মোহামেডানের খেলা মানেই কান সজাগ রেডিওতে। ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা। এখন ক্রিকেটের সময়। চারদিকে শুধু ক্রিকেট আর ক্রিকেট। দেশের ফুটবল খেলাটা আজ জৌলুসহীন। হারের বৃত্ততে বন্দী হয়েই কাটিয়ে দিচ্ছে সময়। বিদেশী কোচরা আসছে আমাদরে দেশের খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ দিতে। তবে খেলায় খুব বেশী উন্নতি ফুটবল প্রেমীদের চোখে পরছে না। এখন সবার ঘরে ঘরে ক্রিকেট ব্যাট আর বল। এরও একটা কারণ আছে। আমি মনে করি না যে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার জন্য ফুটবল খেলা অনেকেই পছন্দ করে না। আসল কারণটা হলো আমাদের ক্রিকেটাররা আমাদের আনন্দ করার যে উপহার দিচ্ছেন তা ফুটবল খেলোয়াড়রা দিতে পারছেন না। অথচ একসময় এই দেশে নামকরা সব ফুটবলার চোখ ধাধানো ফুটবল খেলেছেন। আমরা চাই একটা কারণ। যে কারণে মাঠে গিয়ে উল্লাস করবো, দেশের হয়ে গলা ফাটাবো, বিজয়ের আনন্দে রাস্তায় নেমে আসবো আবার হেরে যাওয়ার কারণে চোখে জল আসবে। ক্রিকেটে যা হয়।
কৃষ্ণা, সানজিদা, মারিয়ারা বহুদিন পর ফুটবল প্রেমীদের চোখে আনন্দের উপলক্ষ এনে দিয়েছিল। আজকের মেয়েরাও আমাদের উল্লাস করার সুযোগ করে দিয়েছে। আমার কাছে যেন মনে হলো এইতো আমাদের ভবিষ্যত ফুটবল এগিয়ে নেওয়ার সারথীরা। হোক না মেয়ে। ওরাই তো করে দেখালো। ওরাই বাংলাদেশের স্বপ্ন হয়ে মাঠে নেমেছে। ওদের চোখে আমি ভয় দেখিনি। দেখেছি প্রতিপক্ষকে ভেঙে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়। ওরাই দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে অন্য দেশের মেয়েদের সাথে লড়াই করেছে। ওরাই আমাদের অনুপ্রেরণা। আমাদের মেয়েরা প্রমাণ করেছে অন্য দেশের মেয়েদের থেকে আমাদের দেশ পিছিয়ে নেই। শক্তি তো প্রমাণ হলো মাঠে। তাতে বাংলাদেশের মেয়েরা বিজয়ী। সেই সাথে বিজয়ী সারা দেশ। এভাবে যখন মারিয়ারা আমাদের গর্ব করার সুযোগ করে দেয় তখন সেই বিষয়টা নিয়ে আমাদেও আগ্রহ বাড়তে থাকে। আমরা ফুটবল প্রেমীরা আশা করি একদিন ফটবল নিয়ে আবারো সেই উন্মাদনা, সেই আগ্রহ সৃষ্টি হবে আজ অনেকটাই মলিন।
লেখক: প্রাবন্ধিক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি