বেসরকারি বিমানের উড়ানে সহায়তা প্রয়োজন
২০ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৬:৫৪
গত পচিশ বছর বেসরকারী বিমানসংস্থাগুলো বাংলাদেশের এভিয়েশনে টিকে থাকার জন্য লড়াই করছে। এই লড়াইয়ে বাস্তবিক চিত্র কোনোভাবেই সুখকর নয়। ৮ থেকে ৯টি বেসরকারী এয়ারলাইন্স শুরু থেকেই ইতিহাস হয়ে যাওয়ার পূর্ব মূহূর্ত পর্যন্ত অনেক দাবীই অপূর্ণ ছিলো।
অনেক দাবীর মধ্যে বেসরকারী এয়ারলাইন্সের জন্য হ্যাঙ্গার সুবিধা ছিলো অন্যতম। দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর পর রেগুলেটরী অথরিটি সিভিল এভিয়েশন সেই প্রত্যাশা পূরণ করেছে। বেসরকারী এয়ারলাইন্সগুলো ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছে। যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টিকে পরিশেষে গুরুত্বারোপ করে এয়ারক্রাফটগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম সুষ্ঠভাবে সম্পাদনের জন্য যাত্রীবাহী এয়ারলাইন্সগুলোকে হ্যাঙ্গার সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু বিগত দিনে বন্ধ হয়ে যাওয়া এয়ারলাইন্সগুলোও হ্যাঙ্গার প্রাপ্তির জন্য বহুবার তাগাদা দিয়েছে কিন্তু দাবী পূরণ হওয়ার পূর্বেই সেই এয়ারলাইন্সগুলো ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে।
এ্যারোনোটিক্যাল চার্জ। এই চার্জের মধ্যে সাধারণত ল্যান্ডিং, পার্কিং, রুট নেভিগেশন, সিকিউরিটি অন্যতম। ব্যবসায়িক গতিশীলতা বজায় রাখার জন্য বেসরকারী এয়ারলাইন্সগুলো সিভিল এভিয়েশনের কাছে সবসময়ই চার্জ কমানোর জন্য যৌক্তিক দাবী তুলে আসছে। এইসব চার্জের কারনে সরাসরি অপারেশন খরচ বেড়ে যায়, যা যাত্রী ভাড়ার উপর প্রভাব পড়ে। যাত্রী ভাড়াকে সহনীয় রাখার জন্য চার্জ কমানোর কোনো বিকল্প নেই।
দেশীয় এয়ারলাইন্স এর ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা চার্জ সমহারে নির্ধারণ করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে এয়ারলাইন্সগুলোর পক্ষ থেকে। বিশেষ করে এ্যারোনোটিক্যাল চার্জ অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের তুলনায় আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে প্রায় নয় থেকে দশ শতাংশ বেশী, যা একটি দেশীয় এয়ারলাইন্স কখনো প্রত্যাশা করে না।
সঠিক সময়ে চার্জ প্রদান না করতে পারলে মাসে ৬ শতাংশ হারে বাৎসরিক ৭২ শতাংশ হারে সারচার্জ প্রদান করতে হয়। যা পার্শ্ববর্তী যেকোনো দেশের তুলনায় অনেক বেশী। সারচার্জ ১২ শতাংশ হারে নির্ধারণ করার জন্য বেসরকারী এয়ারলাইন্সগুলো শুরু থেকেই দাবী জানিয়ে আসছে। কিন্তু সে দাবী পূরণ না করার কারনে এয়ারলাইন্সগুলো চার্জ ও সারচার্জ বকেয়া রেখেই ব্যবসা গুটিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। অধিক হারে চার্জ নির্ধারণ সময়মতো চার্জ প্রদান না করার প্রধান কারন বলেই মনে হয়ে্ছে।
বিভিন্ন সময় সংবাদ মাধ্যমে দেখা যায় বিভিন্ন এয়ারলাইন্স বিশেষ করে বন্ধ হওয়া এয়ারলাইন্সগুলো আর জাতীয় বিমান সংস্থার কাছ থেকে চার্জ আর সারচার্জ মিলিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা বকেয়া পাওনা রয়েছে সিভিল এভিয়েশনের। যৌক্তিক হারে চার্জ ও সারচার্জ নির্ধারণ করলে সিভিল এভিয়েশনকে বিশাল অংকের টাকার হিসাব বহন করতে হতো না।
বন্ধ হওয়া এয়ারলাইন্স জিএমজি, ইউনাইটেড ও রিজেন্ট এর কাছে প্রায় হাজার কোটি টাকার হিসাব আছে বকেয়া হিসাবে, যা আদৌ কোনোদিন আদায় করার কোনো সুযোগ আসবে কিনা সন্দেহ আছে। এছাড়া স্বল্প সময়ে অপারেশনে থাকলেও এ্যারো বেঙ্গল, এয়ার পারাবাত, বেস্ট এয়ার, এভিয়ানা এয়ারওয়েজ এর কাছেও বকেয়া হিসেবে পাওনা আছে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের। যা অনেকটা ‘জনম বাকী’ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। এছাড়া অনেক বিদেশী এয়ারলাইন্স এর কাছেও বিভিন্ন চার্জ বাবদ পাওনা রয়েছে সিভিল এভিয়েশনের।
নন-এ্যারোনোটিক্যাল চার্জ বিমানবন্দরের ভিতরে কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য বিভিন্ন জায়গা ভাড়া নেয়ার সুযোগ আছে। ব্যবসা হোক কিংবা না হোক বছরান্তে ভাড়া বৃদ্ধির প্রবণতাও দেখা যায় কর্তৃপক্ষের। নন-এ্যারোনোটিক্যাল চার্জ সহনীয় পর্যায়ে রাখলে এয়ারলাইন্সগুলো টিকে থাকার জন্য সহজ হবে।
সময়কে বিবেচনা না করে অনেক সময়ই বিভিন্ন ধরনের চার্জ আরোপ করতে দেখা যায়। উদাহরণ স্বরূপ কোভিড কালীন সময়ে এভিয়েশন এন্ড ট্যুরিজম খাত বিশ্বব্যাপী চরমভাবে বিপর্যস্ত ছিলো, বিভিন্ন দেশ যেখানে এখাতকে টিকিয়ে রাখার জন্য যারপর নাই চেষ্টা করেছে, সেখানে বাংলাদেশ এভিয়েশনে এয়ারপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ও সিকিউরিটি খাতে নতুন করে চার্জ আরোপ করেছে। যা সময়ের কাছে অযৌক্তিক মনে হয়েছে। কারন এয়ারপোর্ট ডেভেলপমেন্টও যেমন দরকার তেমনি সিকিউরিটিও প্রয়োজন কিন্তু চার্জ আরোপের ক্ষেত্রে সময়কে বিবেচনায় রাখা খুবই জরুরী।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন যাকে একনামে বিপিসি হিসেবে খুবই পরিচিত। সেবা ধর্মী একটি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু বিপিসির কার্যক্রম দেখলে মনে হয় যেন মনোপলিস্টিক বিজনেস-ই লক্ষ্য। জেট ফুয়েলের মূল্য নির্ধারণে দেশের এভিয়েশন খাতকে বিবেচনায় না রেখে লাভ-ক্ষতির হিসেবকেই প্রাধান্য দিয়ে আসছে। জেট ফুয়েলের উচ্চ মূল্য বাংলাদেশ এভিয়েশনের অস্থিরতার পিছনে মূখ্য ভূমিকা রাখছে। কারন হিসেবে যেকোনো রুটের অপারেশনাল খরচের প্রায় ৫০ শতাংশই হচ্ছে জেট ফুয়েলের খরচ। জেট ফুয়েলের মূল্য নির্ধারণে সতর্কতা অবলম্বন না করলে বাংলাদেশের এভিয়েশন কখনই বিদেশী এয়ারলাইন্সের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না।
অনেক সময়ই আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে মূল্য নির্ধারনে সমন্বয়হীনতা দেখা যায়। কোভিড কালীন ও কোভিড পরবর্তীতে বিদ্যূত গতিতে পূর্বের ক্ষতিকে কাটিয়ে উঠার জন্য ধারাবাহিকভাবে মূল্য বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিলো বিপিসি। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে জেট ফুয়েলের মূল্য কমলেও কচ্ছপ গতিতে লিটার প্রতি জেট ফুয়েলের মূল্য কমানোর হার দেখা যাচ্ছে। যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
এভিয়েশন এন্ড ট্যুরিজম খাতে গ্রীষ্মকালীন সূচিতে যাত্রী বৃদ্ধির হার থাকে নিম্নমূখী, সেই সঙ্গে দেশে মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে ও পদ্মা সেতু উদ্বোধনের কারনে দক্ষিণবঙ্গের যাত্রী হ্রাস পাওয়ায় বরিশাল ও যশোর রুটে ফ্লাইট সংখ্যার সাথে যাত্রী ভাড়া কমিয়ে সেবার মান ঠিক রাখার চেষ্টা করছে এয়ারলাইন্সগুলো।
দেশের আকাশ পথের গতিশীলতা বজায় রাখতে দেশের অভ্যন্তরে বন্ধ হওয়া বিমানবন্দরগুলোকে পুনরায় চালু রাখলে দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলো টিকে থাকার সুযোগ পাবে। সাথে সারাদেশকেই আকাশ পথে সংযোগ স্থাপনের সুযোগ তৈরী হবে।
নানারকম সুযোগপ্রাপ্তিতে এগিয়ে থাকা জাতীয় বিমানসংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এর সাথে বেসরকারী বিমান সংস্থাসমূহের লেবেল প্লেয়িং ফিল্ডের দাবী শুরু থেকেই। জ্বালানী তেল প্রাপ্তিতে কিংবা সিভিল এভিয়েশন অথরিটির পাওনা পরিশোধে ‘এক্সট্রা খাতির’ বরাবরই দেখা যায়। অথচ হাজার হাজার কোটি টাকা না পরিশোধ করেই প্রায়ই লাভের হিসাব দেখা যায় বিভিন্ন গণমাধ্যমে।
দেশের এভিয়েশনের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন, সিভিল এভিয়েশন অথরিটি কিংবা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এর দ্বি-নীতি পরিহার করলে ভবিষ্যতে দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলো সুসংহত হবে। বেসরকারী এয়ারলাইন্সগুলোর বন্ধ হওয়ার মিছিলের লাগাম টেনে ধরে এগিয়ে যাওয়ার মিছিল শক্তিশালী হবে।
বেসরকারী এয়ারলাইন্সগুলো শুরু থেকেই আকাশ পরিবহনের ব্যবসায় টিকে থাকার স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন, সিভিল এভিয়েশন অথরিটি, সিভিল এভিয়েশন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সরকারী সেবা মূলক ও নীতি নির্ধারণী প্রতিষ্ঠানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতার উপর।
লেখক: মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
বেসরকারি বিমানের উড়ানে সহায়তা প্রয়োজন মুক্তমত মোঃ কামরুল ইসলাম