Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাল্যবিবাহ বন্ধে সচেতন হতে হবে

রিফাত আমিন রিয়ন
২২ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১২:৪১

বাল্যবিবাহ হলো অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির আনুষ্ঠানিক অথবা অনানুষ্ঠানিক বিবাহ যা অবৈধ। আইনত মেয়েদের ক্ষেত্রে বিয়ের বয়স ১৮ বৎসর আর ছেলেদের ২১। বাল্যবিবাহে মেয়ে এবং ছেলে উভয়ের উপরই প্রভাব পড়ে। বেশিরভাগ বাল্যবিবাহে দুজনের মধ্যে শুধু একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক হয়ে থাকে। বিশেষত মেয়েরাই বাল্যবিবাহের শিকার ও ক্ষতিগ্রস্ত বেশি হয়। বাল্যবিবাহের কারণগুলোর মধ্যে প্রধানত – দরিদ্রতা, যৌতুক, সামাজিক প্রথা, বাল্যবিবাহ সমর্থনকারী আইন, ধর্মীয় ও সামাজিক চাপ, অঞ্চলভিত্তিক রীতি, অবিবাহিত থাকার শঙ্কা, নিরক্ষরতা এবং মেয়েদের উপার্জনে অক্ষম ভাবা।

ব্র্যাক পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অন্যান্য সময়ের তুলনায় বাল্যবিবাহ বেড়েছে ২৫ শতাংশ, যা গত ২৫ বছরে সর্বোচ্চ। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, করোনা ছাড়াও বিশ্বে বাল্যবিবাহের সর্বোচ্চ হারের দিক থেকে বাংলাদেশ অন্যতম। গত ৩০ বছর ধরে অবশ্য এই হার ধীরে ধীরে কমে আসছে। তবে করোনাকালে তা অনেক গুন বেড়েছে।

বাল্যবিবাহের প্রচলন অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- দারিদ্রতা, নিরাপত্তাহীনতা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণসমূহ। এখনও উন্নয়নশীল দেশসমূহ যেমন, আফ্রিকার কিছু অংশ, দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া, লাতিন আমেরিকা এবং ওশেনিয়া প্রভৃতি দেশে বাল্যবিবাহ বহুল প্রচলিত। ভারত, বাংলাদেশ ও মধ্য আফ্রিকার কিছু দেশে বাল্যবিবাহের হার সবচাইতে বেশি, যা প্রায় ৬০ শতাংশ এর উপর। ২০০৩-২০০৯ জরিপ অনুযায়ী, নাইজার, চাদ, বাংলাদেশ, মালি এবং ইথিওপিয়াতে ১৫ বছরের নিচে শিশুদের বাল্যবিবাহের হার ২০ শতাংশ এর উপর।

বেশিরভাগ ধর্মে বিবাহযোগ্য বয়সকেই সমর্থন করা হয়। খ্রিস্ট ধর্মে বয়ঃসন্ধির আগে কোনো মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আছে। হিন্দু বৈদিক লিপিতে মেয়েদের বিয়ে বয়ঃসন্ধি শুরুর ৩ বছর পর করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইহুদি বিশেষজ্ঞগণ বয়ঃসন্ধির পূর্বে বিয়ে নিরুৎসাহিত করেছেন, কিন্তু একই সাথে, ক্ষেত্রবিশেষে, ৩ থেকে ১২ বছরের শিশু কন্যাকে তার পিতা বিয়ে দিতে পারেন। ক্যাথলিক চার্চ অনুসারে, সর্বনিম্ন বিয়ের বয়স ছেলেদের জন্য ১৪ ও মেয়েদের জন্য ১২ ধরা হয়। পরে ১৯৮৩ সালে যাজকীয় অনুশাসনে ১৯১৭ সালের সংশোধিত বয়স ছেলেদের ক্ষেত্রে ১৬ ও মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৪ বছর বজায় থাকে।

ইসলামে বিবাহের কিছু প্রথা অনুযায়ী ১০ বছরের কম বয়সী মেয়েকে বিয়ে দেয়ার প্রচলন আছে। সহীহ বুখারি ও সহীহ মুসলিম-এর বর্ণনা অনুসারে, শরীয়াহ আইনের ভিত্তি হল মুহাম্মদের জীবনাদর্শ। তিনি তাঁর তৃতীয় স্ত্রী আয়শা (রাঃ)-কে ৬ বছর বয়সে বিয়ে করেন এবং ৯ বছর বয়স থেকে বৈবাহিক জীবন শুরু করেন। কিছু মূলধারার ইসলামি চিন্তাবিদদের মতে, সময়ানুক্রমিক বয়স নয়, বরং অভিভাবকরা যখন মেয়েকে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিবাহযোগ্য মনে করবে, মুসলিম ধর্মীয় আইনানুযায়ী সেইটাই বিয়ের উপযুক্ত বয়স। তবে তা নির্ধারণ করা কঠিন। এবং শরীয়াহ আইনের ভিত্তি অনুযায়ী এবং অধিকাংশ মুসলিম চিন্তাবিদের মতে ১৩ বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ে দেয়া গ্রহণযোগ্য।

ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, ছেলেদের কখনো কখনো অপরিণত বয়সে বিয়ে দেয়া হয়। কিন্ত তুলনামূলকভাবে মেয়েরা এর বেশি শিকার হয়। অপরিণত বয়সের ছেলেদের বিয়ের হার সামান্য। সেপ্টেম্বর, ২০১৪ এর হিসাব অনুযায়ী ১৫৬ মিলিয়ন ছেলে বাল্যবিবাহের শিকার। অন্যদিকে মেয়েদের উপর বাল্যবিবাহের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি। উন্নয়নশীল বিশ্বে ১৫-১৯ বছর বয়সী নারী মৃত্যুর প্রধান কারণ গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসব। পৃথিবীর সর্বোচ্চ বাল্যবিবাহের দেশ নাইজার, যেখানে প্রতি ৪ জনের মধ্যে ৩ জন মেয়ের বাল্যবিয়ে হয়।

ইউনাইটেড নেশন্স পপুলেশন ফান্ড (ইউএনএফপিএ)’র তথ্য মোতাবেক, যে সকল কারণ বাল্যবিবাহের জন্য দায়ী তার মধ্যে রয়েছে দারিদ্র্য এবং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, লিঙ্গ বৈষম্য, জমি-জমা বা সম্পদের চুক্তি, পরিবারের সম্মান রক্ষা, প্রচলিত প্রথা বা চর্চা, এবং নিরাপত্তাহীনতা।

ইউএনএফপিএ এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০০-২০১১ সালের মধ্যে উন্নয়শীল দেশসমূহের ২০-২৪ বছর বয়সী নারীদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ (প্রায় ৩৪ শতাংশ) তাদের ১৮তম জন্মদিনের পূর্বেই বিবাহিত। ২০১০ সালে এর আনুমানিক সংখ্যা প্রায় ৬৭ মিলিয়ন। প্রায় ১২ শতাংশ নারী ১৫ বছর বয়সের আগে বিবাহিত। বাল্যবিবাহের প্রবণতা স্থানভেদে ভিন্ন হয়। শহরাঞ্চলের মেয়েদের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের মেয়েদের বাল্যবিবাহের প্রবণতা প্রায় দ্বিগুণ। ইউনিসেফের রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বে যে ৫ টা দেশে বাল্যবিবাহের হার সর্বোচ্চ তা হল- নাইজার (৭৫ শতাংশ), চাদ (৭২ শতাংশ), মালি (৭১ শতাংশ), বাংলাদেশ (৬৪ শতাংশ), গিনি (৬৩ শতাংশ)। এবং এই ৫টা দেশের প্রত্যেকে ইসলাম প্রধান রাষ্ট্র।

বিশ্বব্যাপী বাল্যবিবাহের সর্বোচ্চ হার যে দেশগুলোতে বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। প্রতি ৩টি বিয়ের ২টি হয় বাল্যবিবাহ। ২০০৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সেসময়ের ২৫-২৯ বছর বয়সী নারীর মধ্যে ৪৯ শতাংশ এর বিয়ে হয়েছে ১৫ বছর বয়সে। বিশ্বজুড়ে শিশুদের অবস্থা-২০০৯ এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০-২৪ বছর বয়সী নারীদের ৬৩ শতাংশ এর বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই। ২০০৮ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, গ্রামাঞ্চলে কোনো মেয়ের প্রতি বাড়তি বছর অবিবাহিত থাকার ফলে সে গড়ে ০.২২ বছর বাড়তি পায় শিক্ষা গ্রহণের জন্য। যত দেরীতে মেয়েদের বিয়ে হয়, তত তারা প্রতিরোধমমূলক স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ পায়। অল্প বয়সে বিবাহিত মেয়েরা সাধারণত পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে উদাসীন থাকে। এদের মধ্যে মাতৃ-মৃত্যুর হার বেশি এবং স্বামীর পরিবারে এদের অবস্থানও নিচে থাকে। বাংলাদেশে মেয়েদের বিবাহের সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর ও ছেলেদের ২১ বছর, তবে সম্প্রতি ২০১৭ সালে বাল্যবিবাহ নিরোধক বিল পাশের মাধ্যমে বিশেষ ক্ষেত্রে আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে ১৮ বছরের নিচে বিয়ের অনুমতি দেয়া হয়।

অপ্রাপ্তবয়স্কদের সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষার জন্য আদালতের অনুমতিসহ অনেক শর্ত পূরণ করলেই কেবল বিশেষ পরিস্থিতিতে এ ধরনের বিয়ে হতে পারে। অপ্রাপ্তবয়স্কদের সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য একটি যাচাই কমিটি থাকবে। এ কমিটির প্রধান হলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। দুজন কিশোর-কিশোরীসহ স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিনিধিরা এ কমিটির সদস্য থাকবেন। এ কমিটি খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখবে যে বিয়ে না দিয়ে আর কোনো উপায় ছিল কি না। এরপরও কমিটির প্রতিবেদন আদালতে যাবে। আদালত এ প্রতিবেদন গ্রহণ করতে পারেন, প্রত্যাখ্যানও করতে পারেন। বাল্যবিবাহ হতে হলে এতগুলো ধাপ পার হতে হবে। তাই যে–কেউ মনে করলেই বাল্যবিবাহ দিতে পারবেন না।

করোনাকালে সাতক্ষীরার আলীপুর আদর্শ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ৬৭ ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়েছে এমন তথ্য প্রকাশ হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়। বেসরকারি সংস্থা এনসিটিএফের জরিপে বলা হয়, ২০২০ সালে এই ইউনিয়নে ৮৭টি বাল্যবিবাহ হয়। অপরদিকে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত বাল্যবিবাহ হয়েছে ৬৭ জনের। অন্যদিকে বাল্যবিয়ে হয়েছে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার বড়ভিটা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮৫ শিক্ষার্থী। এতে হতাশা ব্যক্ত করেছেন ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। দরিদ্রতা, কুসংস্কারসহ নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে এ উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার দিনের পর দিন বেড়েই চলছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এমন শতশত শিক্ষার্থীর জীবনে নেমে এসেছে বাল্যবিবাহ নামের কালো মেঘ।

বাল্যবিবাহ নামের কালো এ মেঘ থেকে মেয়েদের বাঁচানো সম্ভব। মেয়েদের শিক্ষাপদ্ধতি এমন হওয়া প্রয়োজন, যেন শিক্ষা শেষে চাকরির নিশ্চয়তা থাকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়ার একটা বড় কারণ বাল্যবিবাহ। এ ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। মেয়েরা যেন শিক্ষা, চাকরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার না হয়, সেটা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন।

সরকার ও এনজিও সমন্বিতভাবে কাজ করার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। দরিদ্র মানুষেরা যেন সহজে আইনি প্রতিকার পায়, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। অর্থের অভাবে যেনো পড়াশুনা বন্ধ না হয়ে যায় সেজন্য মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণের সমস্ত ব্যয় সরকারকে বহন করতে হবে। দেশের প্রতিটা স্কুল-কলেজে কাউন্সিলিং করাতে হবে।বাল্যবিবাহ রোধ করা সরকারের পক্ষে এককভাবে সম্ভব নয় সেজন্য সকল নাগরিককে একত্রিত হয়ে বাল্যবিবাহকে প্রতিহত করতে হবে। সেইসাথে নিকাহ রেজিস্ট্রারদের হুশিয়ারি উচ্চারণ করে জানিয়ে দিতে হবে বাল্যবিবাহ যাতে রেজিস্ট্রার করা না হয়। কথিপয় কিছু নিকাহ রেজিস্ট্রারদের জন্যও বাল্যবিবাহ বেড়েছে। তাদের প্রতিহত করাও দরকার।

লেখক: শিক্ষার্থী, জয়পুরহাট সরকারি কলেজ

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

বাল্যবিবাহ বন্ধে সচেতন হতে হবে মুক্তমত রিফাত আমিন রিয়ন


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর