ক্রীড়াঙ্গনে নারীর অগ্রযাত্রা ও প্রতিক্রিয়াশীলদের দ্বিচারিতা
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৪:২১
এই যে আপনারা একদল বারবার বলছেন খেলাধুলা হারাম। আবার খেলাধুলা শেষে কেউ হাটু গেড়ে সিজদাহ্ সদৃশ কিছু করলে ইনিয়ে-বিনিয়ে সেটাকে ইসলামের মোড়ক লাগিয়ে হালাল বানানোর চেষ্টা করছেন। আপনাদের উদ্দেশ্যটা আসলে কী! এমন দ্বিচারিতা কেন?
সম্প্রতি সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে জাতীয় ফুটবল টিমের মেয়েরা দারুণ একটা কীর্তি গড়লেন। গোটা বাংলাদেশের মানুষ স্বর্ণকন্যাদের হিমালয় জয়ে উচ্ছ্বসিত। এই টিমে যেমন মুসলিম মেয়ে আছে- আছে হিন্দু, বৌদ্ধ কিংবা অন্য ধর্মের। তাদের এই বিশাল অর্জনের পথটা মোটেই এতটা সুখকর ছিলোনা। পদে-পদে বাধার সম্মুখীন তাদেরকে হতে হয়েছে। কেউ আর্থিক, কেউ সামাজিক, কেউ ধর্মীয়, কেউ পারিবারিক আবার কেউ-বা এইসবগুলো সমস্যা এককভাবেই মোকাবিলা করে এসেছে। কতটা দুর্বিষহ সময় তাদেরকে পার করতে হয়েছে শুধু একটিবার কল্পনা করুন। বিশেষ করে মুসলিম পরিবারের মেয়েগুলো সবথেকে বেশি বাধার সম্মুখীন হয়েছে ধর্মীয় দিকথেকে। এমনো অভিযোগ এসেছে, তাদেরকে দমানোর জন্য বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ফতোয়া জারি করা হয়েছে, ধর্মীয় বিষয় সামনে এনে তাদেরকে সামাজিকভাবে হেয়-প্রতিপন্ন করা হয়েছে। ‘দামড়া-দামড়া মেয়ে পর্দা করেনা কেন’, ‘মেয়েদের আবার কীসের খেলা’, ‘ইমান ছুটে গেছে’, ‘ওদের কেউ বিয়ে করবেনা’, ‘ওরা দোজখে যাবে’ ইত্যাদি এমন শত-শত কটুবাক্য তাদেরকে, তাদের আপনজনকে প্রতিনিয়ত জর্জরিত করেছে। এমনকি ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করে এমন একটা রাজনৈতিক দলের ব্যানার থেকে মহিলা ফুটবলের বন্ধের জন্য আন্দোলন পর্যন্ত হতে দেখেছি। প্রায় এক দশক পূর্বে নারীদের ঘরবন্দী করার লক্ষ্য নিয়ে একটা ইসলামিক দল তো শাপলাচত্বরও অবরুদ্ধ করেছিল। এইসমস্ত বাঁধা, পিছুটান উপেক্ষা করে বাংলার মেয়েরা যখন সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করলো, তখনই গিরগিটির মতো রঙ পাল্টাতে দেখলাম ঐ লোকগুলোর অনেককে। মেয়েদের বিজয় দেখে যদি প্রতিক্রিয়াশীলদের মনে অনুশোচনা বোধ কাজ করে, তাহলে ব্যাপারটা অন্যভাবে ভেবে দেখা যেতে পারে। কিন্তু এখানে ঘটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে ভিন্ন কিছু। তাদের কেউ-কেউ আবার নিজেদের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে উপেক্ষিত নারী ফুটবলারদের অর্জনকে ধর্মীয় মোড়কে মুড়ে ফেলার চেষ্টা চালিয়েছেন।
হটাৎ করে খ্যাতি পাওয়া কতিপয় ধর্মীয় বক্তা থেকে শুরু করে ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে এমন কিছু ব্যক্তি ও তাদের ওস্তাদ-সাগরেদরা রীতিমতো একপক্ষকে ধুয়ে দিচ্ছেন। তাদের অভিযোগ, ‘কিছু ধূর্ত লোক না-কি নারী ফুটবলারদের অর্জনকে ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থানে নিয়ে ধর্ম বিদ্বেষ করছেন’, ‘নারীরা মাঠে সিজদাহ্ করে স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জন করেছে’। এটা চরম মাপের অসত্য কথা। নারীদের খেলার অর্জনকে ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কেউই করেনি। সাংঘর্ষিক সেই লোকগুলোর সাথে, যারা ধর্মের লেবাসধারণ করে এই প্রতিভাগুলোকে জাগ্রত হতে দিতে চায়নি। উল্টো ধর্মের লেবাসধারী কতিপয় লোকগুলোই এই মেয়েদের ফুটবল খেলা নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে ব্যানার সহযোগে মিছিল করেছিল, সাফ জয়ী ফুটবলার সিরাত জাহান স্বপ্না সহ অন্যান্য মুসলিম ফুটবলারদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ফতোয়াবাজি করে তাদেরকে দমিয়ে রাখার অপচেষ্টা চালিয়েছিল, ক্রমাগত ওয়াজ মাহফিলের মঞ্চে উঠে নারীবিদ্বেষ ছড়িয়েছিল, নারীর প্রতি- নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতার তিক্ত কটুবাক্য ব্যক্ত করেছিল। অর্থাৎ, এটা কখনোই ইসলাম বিদ্বেষ নয়। এখানে প্রত্যেকটা ঘটনার সঙ্গে ধর্মকে প্রত্যক্ষভাবে তারাই জড়িয়ে ফেলেছেন, সাংঘর্ষিক অবস্থানে এনেছেন। খেলার মাঠে হাফপ্যান্ট পরে হাটু গেড়ে মাথা গুজে বসে পড়াটা স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ নয়, এটা নিছকই সাধারণ উদযাপন। আমার জানা নেই মারিয়া মান্ডা, ঋতুপর্ণা চাকমা কিংবা কৃষ্ণা রাণীরা এভাবে হাটু গেড়ে মাথা গুজে বসে স্রষ্টার ইবাদত করে কি-না! উজবুকের মতো এধরণের প্রশ্ন যারা করছে, দেশ ও দশের কাজে তাদের সিকিভাগ অবদান নেই। সংগ্রামী মেয়েগুলো জীবনেও যাদের পাশে পায়নি, এই বিজয়ে তাদের এত আস্ফালন কেন! অথচ প্রতিনিয়ত ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে- বিশেষ করে মাদরাসাগুলোতে কোমলমতি ছাত্রদেরকে ‘ধর্ষণ বা বলাৎকার’ করা হচ্ছে, যা সম্প্রতি বছরগুলোতে বেশিমাত্রায় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এসব অপকর্ম-ব্যভিচার নিয়ে ঐসব প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতিবাদ করতে দেখা যায় না, এসব যায়গায় তাদের অনুভূতি নীরব ভূমিকা পালন করে।
যার যার ধর্ম সে নিঃসংকোচে পালন করবে। এতে কারো কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। আপত্তিটা হতে পারে অন্য যায়গায়। খেলাধুলার মতো ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়ে কেন বারবার ধর্ম ঢুকানোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে! ধর্ম ধর্মের যায়গায়, খেলা খেলার স্থানে। এই দুটো বিষয়কে এক করে কেন সাংঘর্ষিক করা হচ্ছে এবং এটা কারা করছে! প্রশ্ন রাখা যেতেই পারে।
আমার জানামতে খেলার মাঠে সাম্প্রদায়িক আচরণের অপ্রত্যাশিত কাজটি শুরু হয়েছে জাতীয় ক্রিকেট দলের কিছু খেলোয়াড়ের হাত ধরে। শর্টকাটে ধর্মীয় সহানুভূতি আদায়ের মোক্ষম অস্ত্রটি তারা প্রয়োগ করেছে খেলার মাঠে; জিতলেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সিজদাহ্ করা! এ-দ্বারা সেইসব সেলিব্রিটিগুলো তাদের ভক্ত-আশেকদের মাঝে এই বার্তাটা দিলো- ‘তুমি হারাম কাজ করো, হারাম খেলো- আর যেটাই করো; মাঠে গিয়ে দুবার মাথা ঠুকে দিয়ো, তোমার কাজটা সহিহ্!’ ব্যাপারটা সোজা না? হ্যাঁ, অনেক সোজা। জটিল করে ভাববার কিছু নেই।
আমার এতগুলো কথা বলার একটাই কারণ, আমার দেশে একটা সাংস্কৃতিক দুর্ভিক্ষ চলছে। আর এই সাংস্কৃতিক দুর্ভিক্ষে সুযোগ নিচ্ছে সাম্প্রদায়িক কীটগুলো। আমাদের তরুণরাও তাদের সবকথায় হ্যাঁ-হ্যাঁ ঠিক-ঠিক করছে। এটা তারুণ্য নয়, এটা বার্ধক্য। এই সংকট নিরসনে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের বিকল্প নেই। নারীর অগ্রযাত্রা থেমে থাকেনি, থেমে থাকবেওনা। প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’।
লেখক: শিক্ষার্থী
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
ক্রীড়াঙ্গনে নারীর অগ্রযাত্রা ও প্রতিক্রিয়াশীলদের দ্বিচারিতা মুক্তমত শিশির ওয়াহিদ