Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মানবজাতির অস্তিত্বের দাবির নাম ধূমপানবিরোধী আন্দোলন

আদনান কাদির
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৬:৫৪

‘ধূমপান’ মাত্র চারটি অক্ষরের একটি শব্দ হলেও এর প্রভাব যে কতটা সুদূরপ্রসারী এ ব্যাপারে একটি শিশুও ভালোভাবে অবগত। সহজ ভাষায় বলতে গেলে ধূমপান একটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যাধি যা একজন মানুষকে ধীরে ধীরে অস্বাভাবিক মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। ধূমপান যে শুধু ব্যক্তির স্বাস্থ্য ও সম্পদের উপরই আঘাত হানে তা নয় বরং তার চারপাশের পরিবেশেরও উপর বয়ে আনে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব।

পৃথিবীতে তামাক তথা সিগারেটের যাত্রা শুরু হয় উনিশ শতকে। সেসময় সিগারেট বা তামাকের প্রচারণা রাতারাতি একে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা দান করে। আর তাই ধূমপান ও সাধারণ খাবারের মধ্যে তখন বিশেষ কোনো পার্থক্য ছিলনা বরং সিগারেট ছিল এক ধরণের আভিজাত্যের প্রতীক। এর জনপ্রিয়তা তখন এতই বেশি ছিল যে এর বিপক্ষে যাওয়া যেকোনো গবেষণাকে সাধারণ মানুষ উপেক্ষার চোখেই দেখতেন। অবশেষে ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সার্জন জেনারেল লুথার এল. টেরির রিপোর্টে বিশ্ববাসীর টনক নড়ে। তখন থেকেই এর ভাবমূর্তিতে মরিচা ধরতে শুরু করে। আগেই বলা হয়েছে, ধূমপান শুধু ব্যক্তিরই নয় বরং তার চারপাশের পরিবেশেরও ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপানের জন্য যে তামাক ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে কমপক্ষে ৭,০০০ টি রাসায়নিক পদার্থ বিদ্যমান, যার কমপক্ষে ২৫০টি বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ হিসেবে চিহ্নিত। এর ফলে ব্যক্তি আক্রান্ত হয় ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, হৃদরোগের মতো প্রাণঘাতী সব রোগে। প্রতিবছরই প্রায় ৮০ লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ ধূমপানের কারণে অকাল মৃত্যুর সম্মুখীন হন। তবে এখানেই শেষ নয়। ২০১৯ এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপায়ী ব্যক্তির সিগারেটের ধোঁয়ার ফলে পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন প্রায় ৬৭ লক্ষ মানুষ, যাদের একটি বৃহদাংশই শিশু। ১৯৬৪ সাল থেকে এই পর্যন্ত শুধু এই পরোক্ষ ধূমপানের জন্যই ২৫ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। শুধু তাই নয়, ধূমপানের কারণে যে পরিমাণ মৃত্যু ঘটে তা সড়ক দুর্ঘটনা, মাদক, আত্মহত্যার ফলে সংঘটিত মৃত্যুকে এক করলেও সেই সংখ্যায় পৌঁছাবেনা। পৃথিবীতে ফুসফুসের ক্যান্সারের ফলে সংঘটিত মৃত্যুর ৮৭%-ই ধূমপানের কারণে হয়। বাংলাদেশেও চার ভাগের এক ভাগ মৃত্যুই ঘটে ধূমপানের জন্য। তবে এটা শুধু মানবজীবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী, প্রতিবছর ৬০ কোটি গাছ, ২ লক্ষ হেক্টর জমি, ২২০০ কোটি টন পানি তামাক চাষের জন্য দূষিত হয় এবং ৮.৪ কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হয়। তাই ধূমপানকে আত্মহত্যা কিংবা গণহত্যার সাথে তুলনা করলেও মন্দ হয়না। শুধু আসল গণহত্যা বা আত্মহত্যার সাথে পার্থক্য এই যে, এক্ষেত্রে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কেবল সাময়িক আনন্দলাভের উদ্দেশ্যে এই হত্যা করে থাকে, আর যারা এই হত্যার অংশীদার নয় তারাও নিজের অজান্তেই এর শিকার হন।

বিজ্ঞাপন

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ধূমপানের কারণে প্রতিবছরই ৫০০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়, যা বাংলাদেশি টাকায় ৫১ ট্রিলিয়ন টাকার সমান। ২০১২ সালে ধূমপানের ফলে সৃষ্ট রোগের কারণে ১,৪৩৬ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়, যা উক্ত বছরের জিডিপির ১.৮% এর সমান। আর এই পরিমাণ অর্থের উৎসের ৪০% অংশজুড়েই রয়েছে উন্নয়নশীল দেশ। এছাড়া অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত ক্ষতির দিক বিচার করলে এশিয়ার দেশগুলোই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত। তবে বিস্ময়কর হলেও ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকাও এক্ষেত্রে মোটেই পিছিয়ে নেই। অথচ এত বিশাল অঙ্কের অর্থের সাহায্যে একটি উন্নত দেশের জাতীয় অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যয় করা হলে যে উন্নয়ন করা সম্ভব তা বর্তমানে ২-৩ বছরেও করা সম্ভব নয়।

কিন্তু এখানেই কি শেষ? বর্তমানে পৃথিবীর একটি অন্যতম দুঃখের বিষয় হলো এই যে প্রতিবছর হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ মানুষ ধূমপানের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করলেও প্রায় প্রতিটি দেশেই সিগারেট বিক্রি করা বৈধ। এর ফলে সিগারেট কোম্পানিগুলোর ব্যবসাতেও ১৯৬৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত বড় ধরণের কোনো ধস নামেনি, বরং দিনকেদিন লাভের হার বেড়েই চলেছে। সুতরাং যতই ভাবমূর্তি নষ্ট হোক না কেন, আসল উদ্দেশ্যের কিছুই হয়নি। ফলশ্রুতিতে প্রতিবছরই জ্যামিতিক হারে ধূমপানের ফলে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলছে এবং বলা হয় যে ২০৩০ সালের মধ্যে ধূমপানের ফলে বার্ষিক মৃত্যুর সংখ্যা ১ কোটিতে দাঁড়াবে এবং এই হার বজায় থাকলে এই শতাব্দীতে শুধু ধূমপানের জন্য ১০০ কোটি মানুষ মারা পড়বে। তাই এর বিরুদ্ধে জরুরী পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।

বিজ্ঞাপন

আমার মতে যদি ধূমপান নির্মূল করা আমাদের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে এর উপর কঠোর বিধিমালা আরোপ করা উচিত। আমাদের দেশে কাগজে-কলমে বিধিনিষেধ থাকলেও বাস্তবে কোনো প্রয়োগ নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রথম কয়দিন কঠোরতা থাকলেও ধীরে ধীরে ঠিকই শিথিল হয়ে সেই আইন আর আইন না থেকে ‘মৃত আইন’ হয়ে যায়। তামাকজাত দ্রব্যের পক্ষে প্রচার-প্রচারণা চালানো বাতিল ঘোষণা করতে হবে। এছাড়াও ধূমপায়ীদের সংখ্যার বিশালতার একটা প্রধান কারণ সহজলভ্যতা। ফলস্বরূপ ধূমপায়ীদের একটা বড় অংশই দরিদ্র জনগোষ্ঠী থেকে আগত। এজন্য তামাকের উপর বাড়তি কর আরোপ করতে হবে। লুথার এল. টেরির মতে সিগারেটের প্রতি প্যাকেটের দাম ১০ ডলার (১,০৩৭ টাকা) ধার্য করা হলে ৪৮ লক্ষ ধূমপায়ী ধূমপান ত্যাগ করতে বাধ্য হত। তখনকার হিসাব করলে এই দাম এখন আরো বাড়ার কথা ছিল। কিন্তু দাম তো বাড়েইনি, বরং এর চেয়ে প্রত্যেক দেশেই যথেষ্ট কম এবং ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। আর এই স্বল্পমূল্যের ফলে দরিদ্রদের মধ্যে ধূমপায়ীদের সংখ্যা বেশি। তবে সবার আগে যেটা প্রয়োজন তা হলো জনসমর্থন। আমাদের দেশে জনগণের সক্রিয়তার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। তাই রাস্তায় দেখা যায় বাবা এক হাতে সিগারেট আবার আরেক হাতে তার ছোট্ট ছেলের হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছেন স্কুল-কোচিংয়ে, কিন্তু একবারও ভাবছেন না তার ছেলের কী ক্ষতি হতে পারে। তাই জনসচেতনতা সবার আগে প্রয়োজন। এক্ষেত্রে দেশের ধর্মীয় নেতাদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা আমাদের দেশ ধর্মের পাগল। তাদের প্রচার-প্রচারণা চাইলেই তামাকবিরোধী গণআন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম। এক্ষেত্রে আমাদের জন্য ভুটানের আদর্শ অনুকরণীয়। ভুটানের জনগণের মধ্যে ধূমপানবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলার পেছনে তাদের ধর্ম এবং ধর্মীয় নেতাদের অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর সর্বপ্রথম তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ভুটানেই পাস হয় এবং এর কর্ণধার ছিলেন ধর্মগুরু নগওয়ানা নমগিয়াল। যখন জনগণ স্বেচ্ছায় তামাকবিরোধী কার্যক্রমের অংশীদার হবে, তখন তামাকের উপর পরিপূর্ণভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা সম্ভব হবে।

অস্বাভাবিক কিংবা অকাল মৃত্যু কারোরই কাম্য নয়। ছোট্ট একটি বদভ্যাসের জন্য আজ পুরো পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ শারীরিক কিংবা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আর শুধু ছোট্ট একটা পদক্ষেপই বর্তমান এবং পরবর্তী প্রজন্মের হাজার কোটি মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে। তাই একটি সুস্থ জীবন, সুস্থ দেশ ও সুস্থ পৃথিবীর জন্য ধূমপানবিরোধী আন্দোলনের অংশীদার হওয়া এখন শুধু সময়ের নয়, মানবজাতির অস্তিত্বেরও দাবি।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

আদনান কাদির মানবজাতির অস্তিত্বের দাবির নাম ধূমপানবিরোধী আন্দোলন মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

ইত্যাদি এবার মোংলায়
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ১৯:৩৪

বরবাদের আইটেম গানে নুসরাত
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ১৯:২৬

আরো

সম্পর্কিত খবর