Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মন্দিরে যাওয়া হলো না ওদের

আকিজ মাহমুদ
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২২:১৮

পূজোর আমেজে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে উৎসব বিরাজ করছে দেশজুড়ে। মাটির তৈরি প্রতিমাতে বর্ণিল সাজসজ্জায় দূর্গা যেন রূপে প্রাণদীপ্ত মূর্তায়ন। সকলের মুখে হাসি। উৎসবের এই রঙিন রঙ মাধুরিতে দেশজুড়ে ছুটেছে আলোকছটা। শুধু ঢাক ঢোলের মুহুর্মুহু শব্দে দিকবিদিক আন্দোলিত হওয়ার অপেক্ষা। এই উৎসব তো বাঙালির। অসাম্প্রদায়িক বাংলায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উৎসব যে শুধু তাদের একার নয়। আমাদের গ্রামাঞ্চলের মুরুব্বিরা এখনো বলেন হিন্দুদের উৎসবে মুসলিমরা শামিল না হলে ওটা ঠিক উৎসবে পরিণত হতো না। কথাটা কতটুকু সত্য জানি না। তবে তাদের আনন্দে আমিও শৈশবে কতবার মাত হয়েছি। পূজোকে ঘিরে আয়োজিত মেলায় কত স্মৃতিচিহ্ন জমে গেছে শৈশবের। তাই প্রতিবার পূজো এলে শৈশবের কথা মনে পড়ে।

বিজ্ঞাপন

আমার এক বান্ধবীকে গত বছরের পূজোতে মানসিক সমর্থন দিয়েছিলাম। সেই পূজোতে কী ঘটেছিল আমাদের সকলের জানা। প্রতিমা ভেঙে নির্বোধ শ্রেণীর অসাধুতা ফুটে উঠেছিল। হিন্দু মুসলিমরা বন্ধনের শিকল ভেঙে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল। কুরআন শরীফের অবমাননার প্রশ্নে দেশজুড়ে চলছিল জ্বালাও-পোড়াও। সরকারের প্রশংসিত পদক্ষেপে ভুল ভেঙেছিল মুসলিমদের। শেষ দৃশ্যে মুসলমানরা এগিয়ে এসেছিল প্রতিমা পাহাড়া দিতে। আহা! কত সুন্দর দৃশ্য। এমন দৃশ্য যে এক শ্রেণীর ধর্মান্ধদের সহ্য হয় না। গতবছরের ব্যথার দিনগুলো ভুলে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আনন্দ উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু তাদের সেই অনিশ্চয়তা সেই দুঃখ কি আজও দূর হয়েছে? ঠিক কতজন এই প্রশ্নের দিতে পারবেন আমি জানি না। পূজোর প্রারম্ভে এখন অব্দি মন্দির ভাঙার খবরে দেশের প্রচলিত মিডিয়াগুলো সায়লাব হয়নি। কিন্তু এবার যেন বেহালার দুঃসহ সুর বেজে উঠেছে। এ যেন ক্রন্দনের বেদনা বিভোর সুরের মাতম। দেবী দূর্গা দর্শনের মহৎ উদ্দেশ্যে নৌকায় উঠে প্রাণ গেল ৬০ জনেরও বেশি ধর্মপ্রাণ হিন্দুর। আহা তাজা প্রাণের ঝরে যাওয়ার বেদনা নদীর তীর, কি কঠিন মুহুর্ত অবতারণা ঘটালে। উৎসবে নিস্তব্ধতার দমকা হাওয়া মলিন করলে কয়েকটি দিন। এ বছর ওদের যে মন্দির দর্শন হলো না। নিথর দেহ খুঁজে পেতে স্বজনের আহাজারির শব্দ হয়তো পৌঁছে গেছে ওদের দেবী দুর্গার কানেও।

বিজ্ঞাপন

ঘটনাটা ঘটেছে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়ার করতোয়া নদীতে। মাড়েয়া বাজার সংলগ্ন আউলিয়া ঘাট থেকে শ্যালো ইঞ্চিন চালিত নৌকায় উঠেছিলেন ৮০ জনেরও বেশি যাত্রী। নদী পার হয়ে বদেশ্বরী মন্দির দর্শনের পূর্বেই ঢুবে গেল সম্পূর্ণ নৌকা। ছিল নারী পুরুষ ছোট্ট বাচ্চারাও। বাঁচার জন্য যুদ্ধ করে কয়েকজন প্রাণ নিয়ে ফিরলেও অধিকাংশই এখনো নিখোঁজ। লাশের সারিও প্রতিনিয়ত লম্বা হচ্ছে।

নৌ-দুর্ঘটনা এদেশে নতুন কোন প্রেক্ষিত নয়। সড়ক পথের ন্যায় নৌ দুর্ঘটনায় প্রাণ ঝরে যাওয়া এদেশের নিত্য দিনের ঘটনা। এসব দুর্ঘটনা দেখে আমরা যেন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কিন্তু আজ আমার মন ভারাক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে করতোয়া নদীতে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় ওদের পরিবারের কথা ভেবে। এই গন্তব্যে মৃত্যু যে তাদের লেখা ছিল এটা তারা কেউ জানতো না। জানলে হয়তো এবারের নৌযাত্রা পরের বছরের জন্য থামিয়ে দিত। ওদের পরিবারগুলো ঠিক কী ভাবে পুষিয়ে নিবে এই অপূরণীয় ক্ষতি, ক্ষতের এই দাগ কি কখনো শুকাবে?

উৎসবেরও রঙ যে কখনো কখনো নীল হয়। মৃত্যুর অনিবার্য এই সত্য মেনে নিয়েই হয়তো মনে না রাখার বৃথা চেষ্টা করে যাবে পরিবারগুলো। কিন্তু পূজোতো প্রত্যেক বছরই আসবে। আনন্দঘন এই সময়ে গৃহের কোন এক কোণে কারও মা, কারও বাবা কারও সন্তান কিংবা কারও স্ত্রী নিঃশব্দ অশ্রু বিসর্জন দিবে।

এ ধরনের দুর্ঘটনায় বরাবর একটি শব্দই উচ্চারিত হয়; অসচেতনতা। আর কত প্রাণের বিনিময়ে আমাদের মধ্যে এই সচেতনতাবোধ জাগ্রত হবে। করতোয়া নদীতে যে দুর্ঘটনা ঘটলো তার পেছনের কথাও একই। অসচেতনতা। মাঝিরা বলছে মহালয়া উপলক্ষে সেখানে প্রচন্ড যাত্রী চাপ ছিল। এজন্য গাদাগাদি করে নদী পার হতে গিয়েই ঘটলো এই দুর্ঘটনা। আঁতকে উঠলাম যখন শুনলাম একটি নৌকোর ধারণ ক্ষমতার চাইতেও ৪০-৫০ জন যাত্রী বেশি নিয়ে নৌকা নদী পার হওয়ার চেষ্টা করছিল।

কিন্তু এগুলো তো এদেশে কত স্বাভাবিক ঘটনা। পরিবহন ব্যবস্থার কাছে জিম্মি এদেশের নিরুপায় মানুষজন। জল, স্থল, আকাশ কোথাও সেই নিস্তার নেই। সময়ে অসময়ে ভাড়া বাড়ে, সাথে বাড়ে মৃত্যুর সংখ্যাও। উৎসব কেন্দ্রিক এই নৈরাজ্য যেন লাগামছাড়া। মুনাফালোভী এই মানুষদের মানুষত্ব কোন দিন ঘুচবে, আমরা কেউ জানি না।

নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির তথ্যমতে, গত ৫০ বছরে দেশে নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে অন্তত ২ হাজার ৫৭২টি। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ২০ হাজার ৫০৮ জন।

এতো মৃত্যুর পরও মৃত্যু যেন থামছেই না। মৃত্যু অনিবার্য কিন্তু দুর্ঘটনায় মৃত্যু কোনভাবেই কাম্য নয়। পদ্মা, শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা, কর্ণফূলী কিংবা মেঘনা এতো দুর্ঘটনার পরেও আমাদের টনক নড়ছে না কেন? ঘটনার পর ঘটনা চাপা পড়ে যাচ্ছে, দেশে নৌপথ সংক্ষিপ্ত হয়ে আসছে, অথচ নৌ দুর্ঘটনা যেন কিছুতেই কমছে না।

দ্য ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৬ (আইএসও ১৯৭৬) আইনের ৪৭ ধারা অনুযায়ী, সরকার কর্তৃক নৌ-পরিবহন সংক্রান্ত অপরাধের বিচারের জন্য এক বা একাধিক মেরিন কোর্ট (নৌ-আদালত) প্রতিষ্ঠার কথা বলা আছে।

মেরিন কোর্টের বিচারক ১ম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতার প্রয়োগ অধিকারী হন। সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে এই আইনে বলা হয়েছে, পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধানের কথা (৭০ নং ধারা)। এই আইনে ধারা ৫২ (২) অনুযায়ী উক্ত মেরিন কোর্টের অতিরিক্ত হিসাবে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ আদেশ দেয়ার ক্ষমতা আছে।

আইন থাকলেও এই আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতা একই ধরনের অপরাধ বারবার ঘটানোর রসদ জোগাচ্ছে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে সক্ষম হলে নৌপথের বিশৃঙ্খলা অনেকটাই এড়ানো সম্ভব।

পঞ্চগড়ের নৌ-দুর্ঘটনায় কিছু মানুষের গাফিলতি রয়েছে। অবশ্যই তা খতিয়ে দেখার দাবি রাখে। নৌ ঘাটে এতো চাপ থাকা সত্ত্বেও মাঝিদের অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে কেন স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারি ছিল না তা তদন্ত করা দরকার। আমাদের ছোট ছোট অসচেতনতার জন্য অনেক বড় মূল্য দিতে হয়। কাঠোর শাস্তি না হওয়ায় তা বারংবার ঘটে চলছে।

পরিবহন ব্যবস্থা মৃত্যু যমে পরিণত হোক তা কখনোই চাই না। দেশ উন্নত হচ্ছে, জাতির মেধা ও মনন জগতের সমৃদ্ধি ঘটছে। অকালে একটি জীবনের ঝরে যাওয়ার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সাধ্য এই পৃথিবীর কারো নেই। অনিশ্চিত জীবনের নিরাপদ গন্তব্যই আমাদের প্রত্যেকের চাওয়া।

ইদের আনন্দ কিংবা পূজোর আমেজ পরিবহন দুর্ঘটনা আর নিথর দেহে চাপা না পড়ুক, এটাই কাম্য।

লেখক: শিক্ষার্থী ও সভাপতি, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

আকিজ মাহমুদ মন্দিরে যাওয়া হলো না ওদের মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

বিদেশ বিভুঁই। ছবিনামা-১
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ২৩:০০

আরো

সম্পর্কিত খবর