চাকরিতে আবেদনের ফি বৃদ্ধি ও বেকারদের মর্মভেদী কান্না
২ অক্টোবর ২০২২ ১৭:৫৫
আমাদের দেশে বয়সভেদে নানা শ্রেণীর মানুষ রয়েছে। প্রায় সকলেই কোন না কোনভাবে মানুষের কাছে মূল্যায়িত হয়। তবে একশ্রেণীর মানুষ আছে আমাদের দেশে যাদেরকে কেউ মূল্যায়ন করে না। তারা অনেকটা ফুটবলের মত। যে যেভাবে যে অবস্থায় পায় সেভাবেই লাথি মারে! আর ফুটবলের মত দিক বিদিক ছুটে যায় এই মানুষগুলো। আমার মনে হয় কাদের কথা বলছি এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন। আমি বলছি আমার দেশের হতভাগা বেকারদের কথা। এই সমাজ এই রাষ্ট্র বেকারদের কথা কখনোই ভাবেনা। তাদের দুঃখের, কষ্টের কথা শোনার মত কেউ নেই! আমাদের দেশের বেকাররা অনেকটা মাঝি বিহীন নৌকার মতো, নদীর মাঝখানে গিয়ে শুধুই ভাসতে থাকে তবে কূলকিনারা পায় না খুব সহজে। আর এভাবেই ভাসতে ভাসতে হাজার হাজার বেকার যুবক হারিয়ে যায় নদীর অতল গহবরে।
সংবাদপত্র খুললেই আমরা দেখি হাজারো হতাশার গল্প। চাকরি না পেয়ে আত্মহত্যার গল্প। কারণ এই সমাজে শুধু সফল যুবকদেরই মূল্যায়ন করা হয়। ছুড়ে ফেলা হয় ব্যর্থ যুবকদের যারা কখনো চাকরি নামক সোনার হরিণের মুখ দেখেনি। এমনিতেই চাকরি না পাওয়াই হতাশায় থাকে প্রায় বেশিরভাগ যুবক। এর মধ্যে অধিকাংশ তরুণের থাকে অর্থনৈতিক দৈন্যদশা যার ফলে সে ঠিকমতো চাকরির প্রস্তুতি নিতে পারে না। কারণ চাকরিতে আবেদন করতে এদেশ প্রচুর টাকা খরচ হয়। তাছাড়া মেসে থাকা খাওয়া যাতায়াত ও বই খাতা কেনার জন্য খরচ তো রয়েছেই। এত খরচ থাকা সত্ত্বেও টিউশনি ছাড়া বেকারদের আর কোন ভরসাস্থল নেই বললেই চলে!
ঠিক এরকম অবস্থায় বেকারদের সাথে বড় ধরনের তামাশা শুরু হয়েছে আবার। সাম্প্রতিক সময়ে চাকরিতে আবেদন ফি বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। সেখানে নবম গ্রেড বা তদূর্ধ্ব চাকরিতে আবেদনের জন্য ৬০০ টাকা ধার্য করা হয়েছে যেটি আগে ছিল ৫০০ টাকা। দশম গ্রেডের চাকরিতে আবেদনের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০০ টাকা যেখানে পূর্বে ৩০০ অথবা ৪০০ টাকাতে আবেদন করা যেত। ১১ তম ও ১২ তম গ্রেডে আবেদন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০০ টাকা যেখানে আগে আবেদন করা যেত ২০০ টাকা দিয়ে। ১৩ থেকে ১৬ তম গ্রেডে আবেদন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ২০০ টাকা যেখানে সাধারণত ১৫০ বা ১২০ টাকায় আবেদন করা যেত। আর সর্বশেষ ১৭ থেকে ২০ তম গ্রেডের আবেদন ফি নির্ধারিত হয়েছে ১০০ টাকা। এই গ্রেডগুলোতে পূর্বে আবেদন করা যেত মাত্র ৫৬ টাকা বা ১১২ টাকা দিয়ে।
পূর্বের তুলনায় এভাবে আবেদন ফি বাড়ানোর ফলে বেকারদের মধ্যে মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়ে হতাশার পরিমাণ বাড়বে। আত্মহত্যার পরিমাণও বাড়বে। তখন এর দায় কে নেবে? যেখানে কর্তৃপক্ষের উচিত আবেদন ফি কমিয়ে একদম সীমিত করে ফেলা, সেখানে এভাবে চাল ডালের মূল্য নির্ধারণের মতো আবেদনের ফি নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা বেকারদের সাথে এক ধরনের তামাশার স্বরূপ। এটাতো গেল সরকার নির্ধারিত চাকরির ফি। দেশে বহু স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে একটি আবেদন করতে কমপক্ষে ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা গুনতে হয়। শুধু কি আবেদন করলেই খরচের পর্ব শেষ হয় বেকারদের? না শুধু আবেদন করেই খরচের পর্ব শেষ হয়ে যায়না বেকারদের কারণ আবেদন করলে পরীক্ষা দিতে যেতে হয় ঢাকাতে। প্রথম আলোতে প্রকাশিত তথ্য মতে বছরে প্রায় ২ কোটি চাকরি প্রত্যাশী চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে মাত্র পঞ্চাশ লাখ ঢাকায় থেকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। আর বাকিরা উপজেলা কিংবা জেলা শহর থেকে এসে পরীক্ষা দেন। যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়া বাবদ আরো অন্ততপক্ষে ২০০০ টাকা খরচ হয়।
এছাড়া চাকরির পরীক্ষা গ্রহণে দীর্ঘসূত্রিতা তো আছেই। দেখা যায় আবেদন করার তিন বছর পর পরীক্ষা গ্রহণ করা হয় যেটা বেকারদের জীবনে এক ধরনের অভিশাপ স্বরুপ। সাম্প্রতিক কালে এমনও ঘটনা দেখা গেছে যে আট বছর পর চাকরির পরীক্ষা গ্রহণের জন্য প্রার্থীদেরকে প্রবেশপত্র পাঠানো হয়েছে। এটি যেমন নিন্দনীয় কাজ তেমনি বেকারদের সাথে তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর বেকারদের টাকাগুলোকে নষ্ট করারও এক ধরনের ফন্দি বটে।
বেকারদের পকেট থেকে যত বেশি খরচ হবে তত বেশি মানসিক চাপ বাড়বে বেকারদের উপর। ফলে খুব সহজেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়বে আমাদের তরুণ সমাজ। আর আমরা হারিয়ে ফেলবো জাতির সবচেয়ে মূল্যবান মানবসম্পদকে।
সাবেক মন্ত্রী পরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেছেন “চাকরি প্রার্থী তরুণদের পরীক্ষার ফি ও তাতে অংশ নিতে অনেক খরচ হয়ে যায়। তাই নিয়োগ পরীক্ষার আয়োজনের খরচের বেশি টাকা তরুণদের কাছ থেকে নেওয়া অন্যায়।” স্যারের কথার সাথে সুর মিলিয়ে বলতে চাই সময় এসেছে তরুণ বেকারদের কষ্টের কথা চিন্তা করে চাকরিতে আবেদন ফি কমিয়ে ভোগান্তি লাঘব করা। যাতে করে তরুণরাও সত্যিকার অর্থে এই দেশকে ভালোবেসে দেশের জন্য কাজ করার প্রয়াস নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে। চাকরিতে আবেদনের ফি কমানো গেলে লাখো বেকার যুবক-যুবতী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে! তাদের দেহে প্রাণ ফিরবে। তাই চাকরিতে আবেদনের ফি না বাড়িয়ে বরং কমিয়ে দেওয়ার জন্য যে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত সেগুলো খুব দ্রুত গ্রহণ করা। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের দেশের ব্যাংকে নিয়োগ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে পারে। ব্যাংকে আবেদন ফি যেমন কম তেমনি ভাবে গুচ্ছ পরীক্ষার জন্য খরচে অনেকাংশে কমে যায়। তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করতে কোন টাকাই লাগে না। আমাদের সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো চাইলেই বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুসরণ করে চাকরিতে আবেদন ফি নির্ধারণ করতে পারে। চাকরিতে আবেদন ফি নির্ধারণে বাংলাদেশ ব্যাংক হোক মূল আদর্শ, বেকাররা হাফ ছেড়ে বাঁচুক। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সকলেই এগিয়ে যাক দুর্দান্ত গতিতে স্বপ্নের ঠিকানায়।
লেখক: কলামিস্ট ও ফ্রিল্যান্স ফিচার লেখক
সারাবাংলা/এজেডএস