Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করতোয়া নদীর মৃত্যুপুরী থেকে আমরা কি শিক্ষা পেলাম

রাশেদুজ্জামান রাশেদ
৪ অক্টোবর ২০২২ ২২:৫৫

কবিতা আর পুতুল দুই বোন। আনন্দে উল্লাসে গোটা বাড়ি মাতিয়ে তোলেছিল। তাদের হৈ-হুল্লোড় করার বিশেষ কারণ আছে তারা দুইজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। মহালয়া দুর্গতিনাশিনী দেবী দূর্গার আগমনী বার্তা যেন বাড়িতে আসতে শুরু করেছে। তাই তো তারা বন্ধু-বান্ধবী ও আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে বাড়িতে দুর্গা পূজার নিমন্ত্রণে উৎসব করবে। শ্রী চন্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গার মর্ত্যলোকে আগমনের আমন্ত্রণ জানাবে আরও কত কী!

বিজ্ঞাপন

হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শাস্ত্রমতে, গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী ও সরস্বতী এই চার ছেলেমেয়েকে নিয়ে এবার হাতির পিঠে চড়ে বাবার বাড়ি মর্ত্যলোকে আসবেন দেবী দুর্গা, আর কৈলাশে ফিরে যাবেন নৌকাতে। দুর্গতিনাশিনীর আগমনে কাশবন ও আকাশ সেজেছে নতুন রূপে। সব ধরনের অপশক্তি দূর হয়ে পৃথিবীজুড়ে বইবে শান্তির বাতাস, এমন প্রত্যাশা সবার। কিন্তু দুঃখজনক ঘটনা কবিতা আর পুতুলের কেউ দেবী দুর্গার মর্ত্যলোকে আগমনের আমন্ত্রণ জানতে পারল না। নৌকা থেকে পানিতে পড়ে চলে গেল না ফেরার দেশে! কি অপরাধ তাদের?

বিজ্ঞাপন

এমন করে কেন হঠাৎ অস্বাভাবিক মৃত্যুকে বরণ করে নিল? মৃত্যুকে কেউ কি সহজে মেনে নিতে পারে? প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী যাদের জীবন আছে তাদের কোনো না কোনো একদিন মৃত্যুবরণ করতেই হবে। কিন্তু সেই মৃত্যু যদি হয় অস্বাভাবিক তখন প্রশ্ন তোলা স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায় যে কেমন আছে মোদের সোনালি সবুজের নদীমাতৃক দেশ? এ দেশের মানুষের ঘরে শোকের মাতম চলছে। শোকহত পাগলপ্রায় মা প্রতিমা রানী তার দুই সন্তানকে নদীর জলে ডুবে মরতে দেখে। মায়ের আহাজারি করে বলছেন, ‘আমাকে মা বলে ডাকার আর কেউ থাকল না।’

মহালয়া দিনেই পিতৃপক্ষের অবসান হয় এবং অমাবস্যার অন্ধকার দূর হয়ে আলােকময় দেবীপক্ষের শুভারম্ভ হয়। এখানে দেবী দুর্গাই হলেন সেই মহান আলয় বা আশ্রয়। কিন্তু বুকের স্নেহের মেয়ে দুটাকে হারিয়ে যেন তার ঘরে মহা শোকে পরিণত হয়েছে।
প্রতিমা রানীকে কে এনে দিবে ঘরের আদোরের দুই মেয়েকে? আর সন্তান হারানো মাকে সান্ত্বনা দিতে এসে স্বজন ও প্রতিবেশীরাও যেন স্তব্ধ।

হাঁটুজলের নদী হিসেবে পরিচিত করতোয়া এখন এক আতঙ্কের নাম। চিরপরিচিত এই নদীটি কেমন যেন অচেনা হয়ে পড়েছে। এই নদীতে কিশোরের শৈশবের গল্পটা শুরু হলো আবেগের কথায় নয় মৃত্যুপুরীর গল্প দিয়ে। এই নদীতে বৃদ্ধের যৌবন কালে কতই না প্রকৃতির সৌন্দর্যের উপভোগ করেছিল আজ সেই উপভোগ নিমিষেই ধ্বংস গেল। এই নদীতে জেলে পাড়ার মাঝির মাছ ধরে সংসারের খরচ জোগাড় করত। সেই জেলে পাড়ার মাঝিও নদীতে জীবন দিয়ে গেল। আজ নদীটি এত নিষ্ঠুর হয়ে গেল! নদীর জলের হিংস্রতা এতটাই বেড়ে গেল যে গত রবিবার ২৫ সেপ্টেম্বর বিকেলে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া ইউনিয়নের আউলিয়ার ঘাট এলাকায় করতোয়া নদীতে নৌকাডুবি ঘটনায় ৬৮ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। নিখোঁজ আছে আরও অনেক মানুষ।

মন্দিরে মন্দিরে রঙ তুলির আঁচড়ে জীবন্ত হয়ে উঠছে প্রতিমা কিন্তু অপর দিকে বন্যা নামের বধূটির হাতে মেহেদির রং পুরোপুরি মুছে যায়নি। তবে তার স্বামী হিমালয় করতোয়া নদীতে নিখোঁজ। জীবন কেড়ে নিয়ে প্রতিমা বুঝি বাহারি রঙের আলোকসজ্জায় মেতে উঠতেছে। আর চির তরে সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল বন্যা রাণীর। এ কোন সমাজে বাসকরি যে সমাজে মানুষের বিন্দুমাত্র নিরাপত্তা নেই? আরও কত শত বন্যা রাণীর মত সিঁথির সিঁদুর মুছে যায়। তখন রাষ্ট্রযন্ত্র কি করে? রাষ্ট্র কবে সচেতন হবে?

ঐ মর্মান্তিক ঘটার প্রধান করণ হলো শারদীয় দুর্গোৎসবের আগে মহালয়ায় পুণ্য অর্জনের জন্য পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের করতোয়ার পূর্ব পাড়ে বদেশ্বরী মন্দির দর্শনের উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন। তারা যেতে যেতে উলুধ্বনি দিচ্ছিল। তাদের সবার মুখ হাসিখুশি।করতোয়া নদী পাড়ি দিয়ে ওপারে মন্দিরে গিয়ে করতোয়ার পানিতেই পুণ্যস্নান করে পাপমুক্তির আশা ছিল তাদের। কিন্তু সব আশা ভরসা গুঁড়তে বালিতে পরিণত হলো। মাঝনদীতে নৌকা উল্টে সবাই হাবুডুবু খেতে থাকে পানিতে। কিছু সংখ্যক মানুষ সাঁতার কেটে নদী তীরে উঠে জীবন বাঁচায়। আর অধিকাংশ মানুষ পানিতে ডুবে মৃত্যু বরণ করে।

ফলে করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়েছিল। এ মৃত্যুর মিছিল যেন ওই অঞ্চলে আকাশ ও বাতাসে মানুষের কান্নার শব্দে আকাশ ভারী হয়ে উঠে। সারি সারি লাশের দৃশ্য। সেই লাশের সারিতে নিথর দেহ নিয়ে শিশু, কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, বুদ্ধ ও বৃদ্ধা পড়ে আছে। এমন দৃশ্য দেখে চোখের জলে বুক ভেজে যায়। এ দৃশ্য দেখে মনে পড়ে যায় রানা প্লাজার শ্রমিকের লাশের সারির কথা, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের বিস্ফরণে মানুষ আগুনে পুড়ে কয়লা হওয়ার কথা। অতীত ও বর্তমানে এত গুলো মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী কে?
কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা ও ঘাট ইজারাদারের অবহেলায় করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায় এত মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে।

গবেষণায় দেখা গেছে অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল আইন, ২০২১’ নামে একটি খসড়া আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। সেই খসড়া আইনটির ৭৩ ধারায় অপরাধ ও দণ্ডের বিষয়ে সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আইনের ৮০ ধারায় কোম্পানির পরিচালকদেরও সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দায়ী করে শাস্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় সেই আইন যেন কাগজের পাতায় সীমাবদ্ধ বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন নেই। কবে এই আইন বাস্তবায়ন হবে?

‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টির চাই’ এই স্লোগান নিয়ে প্রথম দাবি তুলেছিলেন সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ শ্রদ্ধেয় নির্মল সেন। আজও তাঁর দাবি প্রাসঙ্গিক।স্বাধীনতার ৫১ বছরের বাংলাদেশে যত গুলো অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে তার প্রত্যেকটির জন্য কর্তব্যরত কর্মকর্তার অবহেলায় প্রকাশিত হয়েছে। তাই অস্বাভাবিক মৃত্যু গুলো যেন স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। ফলে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি কে দিবে?

যতই দিন যাচ্ছে বাংলাদেশে অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলেছে। সাধারণ মানুষ খুব উদ্বিগ্ন কারণ সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু, নৌকা ও লঞ্চডুবিতে মৃত্যু, রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংঘর্ষে মৃত্যু, বিস্ফোরণে মৃত্যু, ভূমিধসে মৃত্যু, বন্যায় মৃত্যু, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে মৃত্যু, বজ্রপাতে মৃত্যু, অগ্নিদুর্ঘটনায় মৃত্যু এবং দুর্বৃত্তের হাতে মৃত্যু এদেশে বেড়েই চলেছে। দেশে যেন এক মৃত্যুর মিছিল তৈরী হয়েছে। জানতে ইচ্ছে মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়?

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর এর তথ্য মতে, দেশে গত সাত বছরে ৪,৭৯১টি নৌ দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৪,২৩৮ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও ২,৭১৪ জন। নৌপথে দুর্ঘটনাগুলোর প্রায় ৫৪ শতাংশই অন্য নৌযানের সঙ্গে সংঘর্ষ ও ধাক্কা লেগে হয়েছে। বাকি দুর্ঘটনার কারণ বৈরী আবহাওয়া, অতিরিক্ত যাত্রী বহন, লঞ্চের তলা ফেটে যাওয়া, যান্ত্রিক ত্রুটি, আগুন লাগা ও বিস্ফোরণ ইত্যাদি কারণে নৌ দুর্ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে।

জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি রাষ্ট্রকেই দিতে হবে। প্রত্যেকটি মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করে মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করতে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ লঞ্চে সার্ভে সনদ ও রুট পারমিট প্রদান বন্ধ করতে হবে। অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন বন্ধ করতে হবে। অদক্ষ চালকদের দক্ষ করতে হবে। দেশে একেকটি দুর্ঘটনায় সঠিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে তদন্ত কমিটির মাধ্যমে দুর্ঘটনার কারণ, দায়ী ব্যক্তি চিহ্নিতকরণ করতে হবে। নৌ দুর্ঘটনাসহ সবধরনের দুর্ঘটনা বন্ধে বিশেষজ্ঞরা যেসব সুপারিশমালা বিভিন্ন সময়ে প্রদান করেছেন সেসবের যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এজেডএস

করোতোয়া নদী রাশেদুজ্জামান রাশেদ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

২৪ বলে ০ রানে জাকিরের লজ্জার রেকর্ড
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৫:১৮

সম্পর্কিত খবর