Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সুইডেনের জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশীর অংশগ্রহণ, কী হলো শেষে

রহমান মৃধা
৫ অক্টোবর ২০২২ ২০:০১

মনে কি পড়ে দেশের গণমাধ্যমে বেশ সাড়া জাগানো একটি ঘটনার কথা? কিছুদিন আগে সুইডেনের জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেলো। বিশাল একটা কিছু হয়নি তবে সুইডেনের ডেমোক্র্যাট পার্টি অতীতের চেয়ে বেশি ভোট পেয়ে সংসদে দ্বিতীয় বৃহত্তর পার্টি হিসাবে যোগদান করেছে। এখন চলছে নতুন সরকার গঠনের কাজ। প্রতি চার বছর পরপর সুইডেনে জাতীয় নির্বাচন হয়। দিনটি ১১ ই সেপ্টেম্বর, জনগণ ভোট কেন্দ্রে গিয়ে যার যার ভোট যাকে খুশি তাকেই দেয়। মূলত ২৪ আগস্ট থেকে বিভিন্ন লাইব্রেরি কিংবা কাউন্সিলের নির্ধারিত ভোটকেন্দ্রগুলোতে গিয়ে আগাম ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে। যারা দেশের বাইরে থাকে তাদের জন্যও ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে, সুইডেনের ভোট শুরু হবে ২৪ আগস্ট ও শেষ দিন হলো ১১ সেপ্টেম্বর।

বিজ্ঞাপন

সুইডেনে বাই ইলেকশন বলে কিছু নেই। কোনো এমপি মন্ত্রিপরিষদের সদস্য হলে তখন তাকে তার এমপি আসনটি ছেড়ে দিতে হয়। কারণ, সরকার কোনো দলের প্রতিনিধিত্ব করে না। ওই সময় মন্ত্রীর রাজনৈতিক দলের অন্য প্রার্থী, যার নাম প্রার্থীর তালিকায় মন্ত্রীর নামের পরে ছিল, তিনি অটোমেটিক এমপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। ঠিক একইভাবে কোনো এমপি ইন্তেকাল কিংবা শারীরিক অসুস্থতার কারণে দায়িত্ব পালন করতে অক্ষম হলে প্রার্থীর তালিকা অনুসারে যে প্রার্থীর নাম এ প্রার্থীর নিচে থাকবে, তিনি এমপি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অর্থাৎ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো যে কয়টি আসন লাভ করবে, সে আসনগুলো পুরো ম্যান্ডেট পর্যন্ত সেই দলেরই কাছে থাকে। অন্যদিকে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর কোনো এমপি যদি কোনো কারণে তার দল ত্যাগ করেন কিংবা দল তাকে বহিষ্কার করে, তথাপি তিনি দলবিহীন এমপি হিসেবে পুরো সময় পর্যন্ত তার দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। কারণ, তিনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত এমপি, দলের ভোটে নয়। এই সময় এই এমপি যখন পার্লামেন্টে বক্তব্য দেন, তখন তার নামের পাশে কোনো দলের নাম থাকবে না।’

বিজ্ঞাপন

সুইডেনে নর-নারীর সমান অধিকার সত্ত্বেও এই প্রথম এক নারী যিনি দেশ পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন এবং বেশ কিছু মহিলা বিরোধী দলের নেতৃত্বাধীন নির্বাচনে অংশ গ্রহন করবেন। আমি সুইডেনের নানা বিষয়ের উপর লিখি, কথা বলি। নির্বাচন সম্পর্কে অতীতে লিখেছি, এবারের লিখাটি কিছুটা ভিন্ন এই কারণে যে, সুইডেন প্রবাসী বাংলাদেশী বংশভুত মহিবুল ইজদানী খান ডাবলুকে ভেনস্টার পার্টির স্টকহোমের জাতীয় সংসদ প্রার্থীর তালিকায় নমিনেশন দিয়েছে। এটা তার জন্য একটি বিশাল ঘটনা যে তিনি প্রথম বাংলাদেশী যে সুইডিশ রাজনীতিতে জড়িত। যা অন্যান্য বাংলাদেশীদের মগজে কিছুটা নাড়া দিবে যেমন আমাকে দিয়েছে। আমি অতীতে বলেছি লেখাপড়া আর চাকরি করা ছাড়াও যে জীবনে আরো অনেক পথ রয়েছে ক্রিয়েট ভ্যালু ফর ম্যানকাইন্ড। আশাকরি, সেটা আমরা দেখতে পাব এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে, তারপর একটি কথা মনে রাখতে হবে শুধু পাশ বা ফেলের দিকে নজর নয়। বরং, অংশ গ্রহন করা কিন্তু একটি বড় ব্যপার।

মহিবুল ইজদানী খান ডাবলু সুইডেনের রাজনীতিতে ২০০২-২০০৬ মেন্ডেট পিরিয়ডে প্রথমবার ভেনস্টার পার্টির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়ে স্টকহোম সিটি কাউন্সিলে কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একইভাবে ২০০৬-২০১০ ও ২০১৪-২০১৮ দলের কাউন্টি কাউন্সিল (গ্রেটার স্টকহোম অ্যাসেম্বলি) নির্বাচনে জয়লাভ করে মোট আট বছর কাউন্টি কাউন্সিলরের (গ্রেটার স্টকহোম অ্যাসেম্বলি) দায়িত্বে ছিলেন। এই সময় কাউন্সিলের স্বাস্থ্য পরিচর্যা বোর্ড স্টকহোম কালচারাল অ্যান্ড এডুকেশন বোর্ডের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই দীর্ঘ সময় বিরোধী দলের হয়ে যে দায়ীত্বে কাজ করেছেন যদি সেটা মনপূত হয়ে থাকে তার এলাকার মানুষের জন্য, তথা বাংলাদেশীদের জন্য তবে জাতি তাকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করবে বলে আমি মনে করেছিলাম।

সুইডেনের নির্বাচন সাধারণত প্রপোর্শনাল (Proportional) ভোটের মাধ্যমে হয়ে থাকে। পার্লামেন্টে প্রবেশ করতে হলে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে কমপক্ষে মোট ভোটের ৪ শতাংশ ভোট পেতে হয়। সমানুপাতিক এ নির্বাচনে প্রতিটি এলাকায় রাজনৈতিক দলগুলো বেশ কয়েকজন প্রার্থীর নাম প্রকাশ করে। যেসব প্রার্থীর নাম তালিকার একেবারে ওপরে থাকে, তাদের দলের মোট পাওয়া ভোটের পার্সেন্টেজ অনুযায়ী জয়লাভ করার সুযোগ থাকে। অর্থাৎ ভোটাররা ভোট দেয় দলকে কোনো প্রার্থীকে নয়। পরবর্তী সময়ে জাতীয় সংসদে এ নিয়মের পরিবর্তন আনা হয়। আর তা হলো দল যেভাবেই প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করুক না কেন, ভোটাররা চাইলে নিজেদের পছন্দনীয় একমাত্র একজন প্রার্থীর নামের পাশে ক্রস চিহ্ন দিয়ে ভোট দিতে পারবেন। একে বলা হয় ব্যক্তিগত ভোট। অর্থাৎ একজন ভোটার প্রার্থী তালিকায় যার নামের পাশে ক্রস চিহ্ন দেবেন, তার নাম যেখানেই থাকুক না কেন, এ ভোটারের ভোটে তাকে এক নম্বর হিসেবে গণনা করা হবে। এভাবে একটি নির্বাচনী এলাকায় দলের কোনো প্রার্থী যদি মোট ভোটের ৪ শতাংশ ক্রস পান, তাহলে তিনি জয়লাভ করবেন।

এ নিয়মে ছোট ছোট রাজনৈতিক দল ভেনস্টার পার্টি, গ্রিন পার্টি, ক্রিস্ট ডেমোক্রেট পার্টি, লিবারেল পার্টি ও সেন্টার পার্টি থেকে কিছুটা হলেও জয়লাভ করা সুযোগ রয়েছে। বাকি বড় তিনটি দল সোশ্যাল ডেমোক্রেট, মডারেট ও সুইডেন ডেমোক্র্যাটের ক্ষেত্রে মোট ভোটের ৪ শতাংশ ভোট একজন প্রার্থীর এককভাবে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। এসব রাজনৈতিক দল থেকে ব্যক্তিগত ভোটে পার্লামেন্টে জয়লাভ করতে হলে কমপক্ষে সাত হাজারের কাছাকাছি ভোটের প্রয়োজন হয়। সেই তুলনায় ছোট ছোট দল থেকে ব্যক্তিগত ক্রসের প্রয়োজন মাত্র চার হাজার। তা–ও নির্ভর করবে দলের মোট ভোটসংখ্যার ওপর। অনেক সময় চার হাজার কিংবা তারও কম ভোটে জয়লাভ করার সুযোগ রয়েছে। সুইডেনের বর্তমান পার্লামেন্টে কয়েকজন এমপি এই নিয়মে জয়লাভ করে দায়িত্ব পালন করছেন। এখানে উল্লেখ্য, বর্তমান সুইডিশ পার্লামেন্টে সুইডেনের বাইরে থেকে আগত মোট ২৯ দেশ থেকে পার্লামেন্ট মেম্বার থাকলেও ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তানের কেউ এখন পর্যন্ত সুইডিশ পার্লামেন্ট মেম্বার হতে পারেননি।

এসব দিক দিয়ে বিবেচনা করে আমিও আশা করেছিলাম মহিবুল ইজদানী খান সুইডিশ পার্লামেন্ট মেম্বার হয়ে সুইডেনের সঙ্গে বাংলাদেশের পারস্পরিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ভালো করতে সাহায্য করবেন। যেমন বাংলাদেশের অনেক দ্রব্য আছে, যা সুইডেনে চাহিদা আছে, ঠিক তেমনি সুইডেনে নির্মিত উচ্চমানের অনেক যন্ত্রপাতি সরঞ্জাম আছে, যা বাংলাদেশের উন্নয়নে কাজে লাগানো সম্ভব।

আমরা প্রবাসী বাংলাদেশীরা অপপ্রচার ও বাংলাদেশী রাজনীতিকে সামনে এনে নিজেদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি না করে যদি দলমত–নির্বিশেষে সবাই সমর্থন দেই, তাহলে ইনশাআল্লাহ মহিবুল ইজদানী খান জয়ী হবেন এ বিশ্বাস আমার ছিলো। স্টকহোম বসবাসরত বাংলাদেশী সুইডিশ নাগরিক তার জন্য একটি বড় শক্তি। একমাত্র বাংলাদেশী ভোটাররাই তাকে, তার এই অগ্রযাত্রাকে সফল করতে পারেন এ বিশ্বাস আমার ছিলো, কিন্তু দুঃখের বিষয় বৃহতম স্টকহোমে পাঁচ হাজার পাচশো বাংলাদেশী ভোটার থাকা সত্ত্বেও তিনি মাত্র ভোট পেয়েছে ৭৫০টি। তার অর্থ এই নয় যে ৭৫০টি ভোটই বাংলাদেশীরা দিয়েছে, কারন কিছু সুইডিশও রয়েছে এর মধ্যে।

প্রসঙ্গত মহিবুল ইজদানী খান গত চার বছর আগেও জাতীয় নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছিলেন যা আমি জানতাম না। খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি তখন বিনা ক্যানভাছে দাড়িয়ে তিনি পাঁচশো ভোট পেয়েছিলেন। এবার ঢোল ডগর, বাদ্যযন্ত্র সহ মিটিং মিছিল খাবারের আয়োজন এবং মিডিয়ার প্রচেষ্টা, সব মিলে দুইশো পঞ্চাশটি ভোট বেশি পেয়েছেন। তার রাজনৈতিক দল ভেনস্টার পার্টি সর্বমোট ২৪টে ছিট পেয়েছেন এবং তার মধ্যে বৃহতম স্টকহোম থেকে ৭টি যা গত চার বছর আগের ইলেকশনের ফলাফল থেকে কম। মহিবুল ইজদানী খান যদি বাংলাদেশীদের থেকে দুই হাজার ভোট পেতেন তবে তার পাশ করার সুযোগ ছিল, যতটুকু বুজতে পেরেছি তাতে মনে হচ্ছে বাংলাদেশীদের বেশির ভাগই কথা দিয়ে কথা রাখেনি। আমার একটি গল্প মনে পড়ে গেল, অনেকে গল্পটা শুনেছেন তবুও গল্পটি দিয়ে লিখাটি শেষ করি। একবার এক গরিব এক হুজুরের কাছে সাহায্য চাইল। হুজুর বললো ঠিক আছে যা চাও তাই পাবে তবে একটি শর্তে। তুমি যা চাইবে তোমার প্রতিবেশি তার দ্বিগুন পাবে। গরিব লোকটি ভাবনায় পড়ে গেল। সে কোন ভাবেই প্রতিবেশি তার থেকে বেশি কিছু পাবে মেনে নিতে পারছে না। শেষে হুজুরকে বললো তার একটি চোখ কানা করে দিতে, হুজুর তাই করলেন। বাড়ি গিয়ে দেখে প্রতিবেশির দুই চোখ কানা হয়ে গেছে।

লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। [email protected]

সারাবাংলা/এজেডএস

রহমান মৃধা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর