নৌপরিবহণে অব্যবস্থাপনার দায় কার
৮ অক্টোবর ২০২২ ১৬:২৫
আমাদের দেশ নদীমাতৃক। নদীর সাথে আমাদের গভীর মিতালী। তাই সড়ক,রেল ও আকাশ পথের পাশাপাশি নদীপথের উপরও আমরা অনেকটা নির্ভরশীল। মোটামুটিভাবে দেশে এখনো ৩০ শতাংশের বেশি লোক সুদীর্ঘ প্রায় ২৪১৪০ কিলোমিটার নদীপথ ব্যবহার করেন। । জনগনের এত বড় একটা অংশ যাতায়াতের জন্য নদীপথ ব্যবহার করে কিন্তু এই পথের যাত্রীরা কতটা নিরাপদে তাদের যাতায়াত করছে এটাই প্রশ্ন অনেকের।
সম্প্রতি ২৫ সেপ্টেম্বর পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়া ঘাটে করতোয়া নদীতে শতাধিক যাত্রী নিয়ে একটি নৌকা ডুবে যায়। এ সময় নৌকায় অতিরিক্ত যাত্রী ছিল। এ কারণে যাত্রী বোঝাই নৌকাটি মাঝ নদীতে পৌঁছানোর পর যাত্রীর চাপে নৌকাটি ডুবে যায়। কিছু মানুষ সাঁতরে নদীর তীরে উঠতে পারলেও অনেক যাত্রীই এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। শোকের মাতম শুরু হয়েছে এলাকাজুড়ে।
এ ঘটনায় ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬৪ জনের মৃত্যুদেহ পাওয়া যায় ও অনেক হতাহত ও নিখোঁজের খবর আসে গণমাধ্যমে। ঘটনাটি দেশের মানুষের জন্য এক মর্মান্তিক ও হৃদয় বিদারক। নদীপথে মৃত্যুর ঘটনাগুলিতে আত্মীয়-স্বজনদের আহাজারী সবচেয়ে বেশি থাকে। নিরাপদ সড়ক চাই’র (নিসচা) পরিসংখ্যান বলছে, বিগত ২০২১ সালে নৌপথে ৯০টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ১৯৮ জন, নিখোঁজ হয়েছে ১৮৬ জন ও আহত হয়েছে ৩৩৯ জন। এসব তথ্যের বাইরেও অপ্রকাশিত তথ্য ও হাসপাতালে ভর্তির পর মারা যাওয়ার সংখ্যাও রয়েছে অনেক। এমন ঘটনা শুধু যে বর্তমানে তা নয়।
চলতি বছরে ২০ মার্চ দুপুর ২টা ২০ মিনিটের দিকে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর কয়লাঘাট অংশে রুপসী-৯ নামে কার্গো জাহাজের ধাক্কায় মুন্সিগঞ্জগামী লঞ্চ এমভি আশরাফ উদ্দিন ডুবে যায়। যাত্রীবাহী লঞ্চ এবং মালবাহী কার্গোর সংঘর্ষে যে লঞ্চডুবি হয়েছিল, সে ঘটনায় ১১ জনের মরদেহ উদ্ধার হয়। প্রতিবারের মতো সেবারও লঞ্চডুবির কারণ উদঘাটন করে দায়ী ব্যক্তিদের সনাক্তে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল সরকার। ঘটনার ঘটেছিল যাত্রবাহী লঞ্চ এবং কার্গো দুটোর মাঝেই একটি প্রতিযোগীতার কারনে।
দেশে বর্তমানে প্রায় ৬ হাজারের মতো নৌপথ রয়েছে কিন্তু এর বেশিরভাগই অরক্ষিত। এসব নৌপথে বৈধভাবে প্রায় ৩ হাজার ছোট-বড় লঞ্চ, জাহাজ চললেও অনুমোদনহীনভাবে কয়েকগুণ বেশি নৌযান চলাচল করছে। যা দুর্ঘটনার জন্যে অনেকাংশে দায়ী।
নৌ পথের এমন ঘটনা কোন ভাবেই আমাদের কাম্য নয়। এ ধরনের অনাকাঙ্খিত নৌ-দুর্ঘটনা প্রতি বছরই ঘটছে। হঠাৎ করে এমন নৌপথ দুর্ঘটনা ঘটলে তৎকালীন সময় খবরটি নিয়ে জনমনে অনেক হৈচৈ হয়। এছাড়াও গণমাধ্যমগুলোও এ নিয়ে কিছুদিন লেখালেখিতে ব্যস্ত থাকে। এ ধরনের অনাকাঙ্খিত ঘটনার কারণ-প্রকৃতি, সম্ভাবনা সহ নানান দিক বিশ্লেষণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথারীতি তদন্ত কমিটি গঠন করে। উক্ত ঘটনাটির কিছুদিন পরে দেশে যদি এ ধরনের ঘটনা কিংবা আরেকটি অন্য প্রকৃতির ঘটনা ঘটে তখন ঐ চলমান ঘটনাটি নিয়ে জনগণ ও গণমাধ্যম খুব ব্যস্ত হয়ে যায়। আমাদের চোখ থাকে তখন বর্তমান বিষয় নিয়ে কিন্তু পূর্বের ওই নৌ-দুর্ঘটনার খবর আমাদের তেমন আমলে আসে না আর অনেকেই জানতে পারি না যে উক্ত ঘটনার তদন্তে কি হল,কি ব্যবস্থা নেয়া হল দোষীদের। এভাবে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন ঘটনা ঘটছে কিন্তু এ ঘটনাগুলি থেকে পরিত্রানের উপায়ের তেমন ব্যবস্থা ও নির্দেশনা নেই। তথ্য বলছে, ১৯৯৪ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়ে ছোট বড় মিলে প্রায় ৭০০টির মতো লঞ্চ দুর্ঘটনায় ৬ হাজার পাঁচশত মানুষ মারা গেছে। আহত হয়েছে অসংখ্য মানুষ। আর নিখোঁজ হয়েছে প্রায় ২ হাজারের বেশি মানুষ। এত মানুষের প্রাণহানি কেন ঘটছে,দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা কি,অন্য আইনে লঘুদন্ডের ব্যবস্থা থাকলেও তাতে দোষীদের তেমন টনক নড়ছে না। তাই ক্রমশই বেড়েই চলছে নৌপথের অনিয়ম ও অবহেলা। আর এই অবহেলার বলি হচ্ছেন সাধারণ নৌ-যাত্রীরা। দিতে হচ্ছে অনেক যাত্রীকে অকালে প্রাণ! যাত্রী নিরাপত্তা ও দোষীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনার জন্য সরকার বিভিন্ন ব্যবস্থাও নিয়েছেন ইতোঃমধ্যে।
জানা যায় ‘অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল আইন, ২০২১’ নামে একটি খসড়া আইন প্রণয়নের অপেক্ষায় রয়েছে। এই খসড়া আইনটির ৭৩ ধারায় অপরাধ ও দণ্ডের বিষয়ে সর্বোচ্চ শাস্তি ৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ৩ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। তবে এখনো এ আইনটি চূড়ান্ত হয়নি।
ক্রমাগত নৌ-পথের দুর্ঘটনা বাড়ার ফলে যাত্রীদের শঙ্কা বেড়েই চলছে। নিরাপত্তাহীনতায় নৌপথের যাত্রীরাও। নৌ-দুর্ঘটনার হাত থেকে যাত্রীদের নিরাপদ রাখতে, কর্তৃপক্ষ উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে এমনটা সময়ের দাবিতে পরিনত হয়েছে। এক বিভাগ অন্য বিভাগের উপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে দায় এড়ালে চলবে না। সমন্বিত প্রচেস্টায় নৌপথের যাত্রীদের কিভাবে নিরাপদে রাখা যায় বা দুর্ঘটনার হার কিভাবে কমিয়ে আনা যায় তার পথ খুঁজে বের করতে হবে। নৌপথ যাত্রীদের শঙ্কামুক্ত রাখতে হবে।
লেখক: আইনজীবী, জজ কোর্ট, খুলনা
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি