Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিশ্ব ডাক দিবস; ডাক ব্যবস্থার আধুনিকায়ন জরুরি

অলোক আচার্য
৯ অক্টোবর ২০২২ ১৯:২২

যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবেই পৃথিবীতে ডাক ব্যবস্থার প্রচলন শুরু হয়। ‘রয়্যাল মেইল’ নামে প্রথম ডাক বা পোষ্টাল সার্ভিস চালু হয় ১৫১৬ সালে। এটি চালু করেন রাজা অষ্টম হেনরি। এরপর ১৬৬০ সালে প্রথম সাধারণ ডাক বা জেনারেল পোষ্ট অফিস চালু করেন রাজা দ্বিতীয় চার্লস। ১৮৩৫ সালে রোল্যান্ড হিল আধুনিক পোষ্ট অফিসের ধারণা দিয়ে ‘পোষ্ট অফিস রিফর্ম’ প্রকাশ করেন। ১৮৪০ সালে ব্রিটেনে ‘ইউনিফর্ম পেনি পোস্ট’ চালু হয় যার মাধ্যমে চিঠি পাঠানো হয় আরো দ্রুততর। ১৮৫০ সালে ব্রিটেনে চালু হয় ‘পেনি ব্ল্যাক’ নামে ডাকবাক্স। এছাড়াও আরও কিছু তথ্য হলো, বিশ্বে প্রথম সমুদ্র ডাক চালু হয় ১৬৩৩ সালে। ঘোড়াগাড়ির ডাক চালু করা হয় ১৮৩৮ সালে। আর প্রথম স্ট্যাম্প চালু করা হয় ১৮৪০ সালে।

বিজ্ঞাপন

মূলত সভ্যতার শুরুতেই মানুষ যোগাযোগের গুরুত্ব উপলদ্ধি করেছিল। সভ্যতার শুরুতে যোগাযোগের জন্য মানুষ নানা উপায় অবলম্বন করতো। চাণক্যের অর্থশাস্ত্রেও দূত মারফত রাজস্বের সংবাদ আদান প্রদানের নিদর্শন পাওয়া যায়। সেই সময় কবুতরের মাধ্যমে রাজকীয় পত্র পাঠানো হতো। জমিদাররা বাহকের মাধ্যমে তথ্য আদান প্রদান করত। তবে কাগজ আবিষ্কারের পর চিঠি লেখার শুরু থেকে তা এই আধুনিক যুগেও ছিল জনপ্রিয় মাধ্যম। চিঠির জনপ্রিয়তা কমেছে খুব বেশি বছর হয়নি। সেই সাথে কমেছে ডাকবাক্সেও গুরুত্ব। ডাকবাক্স, ডাকঘর, ডাকপিয়ন বা ডাক-হরকরা এবং তাদের বিলি করা চিঠি আজকের যুগে খুব প্রয়োজনীয় না হলেও একসময় মানুষের যোগাযাগের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। দিনের পর দিন মানুষ অপেক্ষায় থেকেছে ডাকপিয়নের জন্য। তার সাইকেলের শব্দের জন্য। একটি এলাকায় সবচেয়ে পরিচিত ছিল এসব ডাকাপিয়নরা। এ যুগের ছেলেমেয়েরা হয়তো এসব শব্দের সাথে খুব পরিচিত না। কারণ এ যুগটাই আমাদের এসব শব্দ থেকে দুরে সরিয়ে রেখেছে। যুগটা যে বিজ্ঞানের। আধুনিকতার আলোতে পুরাতন সব স্মৃতিতে ঠাঁই নিয়েছে। তাই এসব আমাদের কাছে শুধুই স্মৃতি। কতশত মধুর স্মৃতি কতজনের আছে এই ডাকবাক্সকে কেন্দ্র করে তার হিসেব নেই। প্রেম, ভালোবাসা, বিরহ, কষ্ট এসব প্রকাশ পেত একটিমাত্র চিঠিতে। কালের অতল গভীরে হারিয়ে যেতে যেতে চিঠি আজ প্রায় বিলীন হয়েছে। এখন ডাকপিয়নের সাইকেলের বেলের টুংটাং শব্দ হরহামেশাই শোনা যায় না। আগে যেমন পাড়ায় পাড়ায় প্রায় প্রতিদিনই কারও না কারও চিঠি বা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে ছুটতো সেগুলো বিলি করার জন্য, আজ আর তেমনটা চোখে পড়ে না। আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তির কাছে হার মেনেছে সব। এটাই নিয়ম। প্রকৃতি কেবল নতুন কিছু গ্রহণের জন্য প্রস্তুত থাকে। অতীত থাকে বইয়ের পাতায়, স্মৃতির মণিকোঠায়। আধুনিক প্রজন্মে বেড়ে ওঠা অনেকের কাছে হয়তো ডাকপিয়ন শব্দটি কেবল বইয়ের পাতায়ই পড়েছে। বাস্তবে দেখেছে কি না সন্দেহ! আমরা যখন বড় হয়েছি তখন ‘রানার’ কবিতাটি পাঠ্য ছিল। এখনও নবম-দশম শ্রেণিতে আছে। রানার কে, রানারের দায়িত্ব কি ছিল তা নিয়েই সুন্দর এই কবিতাখানি। এতই চমৎকার কবিতার বর্ণনা যে চোখ বুজলেই আমি রানারকে দেখতে পেতাম। তার এক হাতে খবরের বোঝা ও অন্য হাতে তার লাঠি দেখতে পেতাম। চোখজুড়ে ব্যস্ততা। ঠিক সময়ে পৌছানোর ব্যস্ততা।

বিজ্ঞাপন

কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা এই কবিতার শুরুতে রয়েছে, “রানার ছুটেছে তাই ঝুমঝুম ঘন্টা বাজছে রাতে/ রানার চলেছে, খবরের বোঝা হাতে/ রানার চলেছে রানার!/ রাত্রির পথে পথে চলে কোনো নিষেধ জানে না মানার/ দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে রানার/ কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার।” রানার কবিতার কেবল এই কয়েক লাইন পড়লেই বেশ ষ্পষ্ট হয়ে ওঠে রানারের কাজ বা কঠোর দায়িত্ববোধ। ডাকব্যবস্থার শুরুর পর বহুদিন রানাররা এভাবেই মানুষের অতি দরকারি, মহামূল্যবান খবরাখবর মানুষের কাছে পৌঁছে দিত। রাত জেগে সারারাত ছুটে সেই খবর সে মানুষের জন্য বহন করে আনত। রানারের গুরুত্ব তাই অপরিসীম। যোগাযোগের অন্যতম প্রধান মাধ্যম ছিল হাতে লেখা চিঠি। হাতে লেখা চিঠির জায়গায় আজ মোবাইলের ম্যাসেজ, ম্যাসেঞ্জার, ইমেইল বা কুরিয়র স্থান দখল করে নিয়েছে। স্থান পরিবর্তনই প্রকৃতির নিয়ম। তবে এ কথা বলতে পারি চিঠিতে যে আবেগ জড়ানো থাকে আজকের আধুনিক সরঞ্জামে বহন করা ডিজিটাল সেই খবরে এত আবেগ জড়িয়ে থাকে না। থাকা সম্ভব না। একটি চিঠি লিখতে একজন প্রেমিক বা প্রেমিকার বা নববধূর যে সময়, যে শ্রম ব্যয় হতো আজ তার কিছুই হয় না। অনেকেই তার প্রিয়জনের কাছ থেকে প্রথম পাওয়া চিঠির কথা আজও মনে রেখেছে নিশ্চয়ই। এক চিঠির ভাঁজ খুলে বারবার করে পড়েছে অনেকেই। তারপর সযতনে সেই চিঠি নিজের কাছে গচ্ছিত রেখেছে। একটি চিঠি কেবল আবেগের বিষয়ই ছিল না। একটি চিঠিতে শেখার মতো অনেক কিছুও ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ব্যক্তির হাতের লেখা এবং শব্দ ও ভাষার প্রয়োগ। ছেলে যদি বাবার কাছে চিঠি লিখতো তাহলেও চিঠির যথাযথ নিয়ম মেনেই লিখতো। এতে তার যোগাযোগের সাথে সাথে লেখাপড়ার কাজটিও অনায়াসেই হতো। আজ যেমন মোবাইলে ফোন করে অনায়াসেই বলে দেয়া যায় তখন তা চিঠির মাধ্যমে জানাতে হতো। যে চিঠি লিখতো সে সবসময় চাইতো তার হাতের লেখা যেন যতটা সম্ভব সুন্দর হয়। কারণ সেটি কেউ পড়বে এই চিন্তা থাকতো তার মাথার ভেতর। আজ ম্যাসেজে দু’চার লাইনে যা জানানো যায় চিঠিতে সেই দু’চার লাইনে কিছুই প্রকাশ করা হতো না। ফলে চিঠি লিখতে গিয়ে অনেকেই অনেক কিছু শিখতে পেরেছে।

অক্টোবর মাসের ৯ তারিখ বিশ্ব ডাক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। একটি দিবস দিয়ে সেই দিবসের সবকিছু বোঝানো সম্ভব নয়। তবুও ডাক দিবসের কথা মনে হলেই ওপরের শব্দ কয়টির কথা মনে পরে। চিঠির সাথে কাটানো দিনগুলোর কথা মনে পরে। প্রথমে যত্ন করে চিঠি লেখা, তারপর সেই চিঠি হলুদ রংয়ের খামে ভরে ডাকঘরে যাওয়া এবং তারপর সেই চিঠি ডাকবাক্সে ফেলা। এ কথা স্বীকার করি যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ার ফলে মানুষের বহুবিধ উপকার হয়েছে। তাছাড়া আজকাল মানুষের কর্মব্যস্ততাও বেড়েছে। পেছনে ফেরার মতো সময় আমাদের হাতে নেই। এত সময় নিয়ে, এত ধৈর্য নিয়ে চিঠি লেখা এবং তা ডাকবাক্সে ফেলার মতো সময়ও হয়তো মানুষের নেই। তাই চট করে অতি সংক্ষেপে ম্যাসেজে জানিয়ে রাখাই উত্তম মনে করে। তা হলেও এত স্মৃতি যার সাথে জড়িয়ে আছে তা টিকে থাক আজন্মকাল। সে লক্ষ্যে ডাক পরিসেবার মান ও কার্যপরিধি বৃদ্ধি করে ও এটি আধুনিকায়ন করে যুগোপোযোগী করে গড়ে তোলা হোক যাতে তা আধুনিকায়নের সাথে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকতে পারে। ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে ডাক বিভাগকে টিকিয়ে রাখতে হবে, কাজের গতি বৃদ্ধি করতে হবে এবং ঐতিহ্য বজায় রাখতে হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

অলোক আচার্য বিশ্ব ডাক দিবস; ডাক ব্যবস্থার আধুনিকায়ন জরুরি মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

বিদেশ বিভুঁই। ছবিনামা-১
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ২৩:০০

আরো

সম্পর্কিত খবর