ছাত্র রাজনীতি কোন পথে?
১৩ অক্টোবর ২০২২ ১৪:৩৫
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ছাত্র রাজনীতি কি এবং কেন। ছাত্র রাজনীতি মূলত ছাত্রদের স্বার্থ নিয়ে, ছাত্রদের অধিকার নিয়ে, ছাত্রদের সংকট নিয়ে এবং এসব করতে গিয়ে সেই ছাত্রের মাঝে জন্ম নেয় দেশপ্রেম, ভেতরে বিস্তার ঘটে মানবতার, ঘাড়ে এসে পড়ে সমাজ তথা দেশ তথা গণমানুষের দায়িত্ব। অতীতের ইতিহাস খুললে আমরা তাই দেখি। কিন্তু আজ আমরা কি দেখছি ছাত্র রাজনীতির নামে? অতীতের ছাত্র রাজনীতির সাথে চলমান ছাত্র রাজনীতির দূরত্ব আকাশ আর পাতাল কিংবা তার থেকেও বেশি। এই দূরত্ব তৈরি করেছে বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতায় আসা ছাত্র সংগঠনগুলো। ফলে আদর্শ ধারার ছাত্র রাজনীতি আইসিইউতে।
ইডেন কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বেড়িয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর, তাক লাগানো তথ্য। সিট বাণিজ্য থেকে শুরু করে শারীরিক নির্যাতন কোনটাতে পিছিয়ে আছে তারা? শুধু ইডেনই না সারাদেশের চিত্র একই। নিজ দলের দুই গ্রুপের মারামারি কাটাকাটি তো নিত্য দিনের সংবাদপত্রের প্রধান শিরোনাম। কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে ওয়ার্ড নেতা কার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ ওঠার বাকি আছে?
সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় আজ সিট বাণিজ্যের দোকান আর টেন্ডারবাজির অফিসে পরিনত হয়েছে যার প্রমান গণমাধ্যমের খবর। এটাতো হুট করে একদিনে তৈরি হয়নি। তৈরি হয়েছে এযাবৎকালে ক্ষমতায় আসা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য দিয়ে।
আমরা যদি অতীতের ছাত্র রাজনীতির দিকে ফিরে তাকাই তাহলে ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলো দেখতে পাবো। ব্রিটিশরা যখন গোটা ভারতবর্ষকে শাসন-শোষণ করতো তখনকার স্কুল-কলেজের ছাত্ররা চুপ করে বসে থাকেনি। নেতাজী সুভাসচন্দ্র বোসের মতো ছাত্ররা সমিতি গঠন করে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে, জনগনকে সচেতন করে। বিভিন্ন শ্রেণির মানুষেরা সম্মিলিতভাবে সংগঠিত হয়ে ব্রিটিশদের হটিয়েছে। জাতির ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার পর ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য আন্দোলন, ১৯৬২ সালে শিক্ষা নীতি সংকোচনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালে সারাদেশের গণমানুষের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালে দেশের মানুষকে সবদিক থেকে মুক্তির জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলন, ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন, ২০১৮ সালের কোটা বিরোধী ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্রসমাজ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ও তাদের ভূমিকা আমরা ভুলিনি।
স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে এবং ১৯৯১ সালে তার পতন ঘটানোর ক্ষেত্রে পুনরায় ছাত্ররা ঐক্য ও শক্তির পরিচয় দেয়। কিন্তু এরপর রাজনতৈকি সরকারগুলো ক্ষমতায় এলে ছাত্রসংগঠনগুলো ক্রমেই তাদের উপাঙ্গ হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক নেতারা তাদের স্বার্থে ছাত্রনেতাদের ব্যবহার শুরু করে৷ ফলে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, সিট দখলের রাজনীতি তো আছেই; সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা ধরনের বাণিজ্য— ভর্তি, নির্মাণ, উপকরণ সরবরাহ ইত্যাদি শুরু হয়।
দেশের সংকটকালে মানুষ শেষ সম্বল হিসেবে ছাত্র সমাজের দিকে বুক ভরা আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকে এই ভেবে যে, ছাত্ররা তাদের তারুণ্যের শক্তি দিয়ে দেশের সংকট নিরসন করে আলোর পথ, প্রগতির পথ দেখাবে এবং অতীতের যুগ গুলোতে তাই করে আসছে। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম দেশ রক্ষার জন্য তার ছেলেকে বিদেশে লেখাপড়ার জন্য না পাঠিয়ে দেশের মুক্তির জন্য, দেশের মানুষের মুক্তির জন্য দান করেছেন। এই ইতিহাস আমরা ভুলিনি। কিন্তু বর্তমানে কোনো বাবা-মা তার সন্তানকে রাজনীতির সাথে যুক্ত হতে দেন না কিংবা যুক্ত হতে দেখলে বিচলিত হয়ে ভাবতে থাকে এই ভেবে যে তার সন্তান হয়তো আর লেখাপড়াটা ঠিক মতো করতে পারবে না, হয়তো নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়বে, হয়তো লিডারশীপের প্যাটানে পড়ে গ্রুপে গ্রুপে মারামারি থেকে শুরু করে জঘন্যতম অপরাধে যুক্ত হবে, হয়তো আবরারের মতো লাশ হবে, নয়তো আবরারের খুনি সাজবে। চলমান ছাত্র রাজনীতির নামে যা চলছে তাতে বাবা-মার এসব ভাবনা অপ্রাসঙ্গিক নয়।
গত চার দশকে দেশের চারটি সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন সব মিলিয়ে ১২৯ জন ছাত্র। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৪ জন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৪ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয়জন ছাত্র মারা যান।
প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা গেছে, এই সরকারের দুই মেয়াদে ছাত্রলীগের সঙ্গে প্রতিপক্ষ বা নিজেদের মধ্যে প্রায় ৫০০ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এসব সংঘর্ষে মোট ৭১ জন মারা যান৷ এর মধ্যে ৫৫ জনই নিহত হন নিজেদের কোন্দলে। বিএনপি আমলেও একইভাবে নিজেদের মধ্যে কোন্দলে জড়িয়েছিল ছাত্রদল। ছাত্রদলের মধ্যে টেন্ডারবাজিতে পড়ে বুয়েট ছাত্রী সনির গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা এখনো দেশবাসী ভুলে যায়নি। নব্বই দশকের পর থেকে যে দলই ক্ষমতায় এসেছে সেদলের ছাত্র সংগঠন সহ লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র সংগঠনগুলো ক্যাম্পাসে ত্রাস সৃষ্টি করেছে যা আদর্শ ধারার ছাত্র রাজনীতির জন্য অশনিসংকেত।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স স্টাডিজ ২০১২ সালে ছয় হাজার ৫০০ যুবকের ওপর একটি জরিপ করে। তাতে দেখা যায়, ৮০ শতাংশের অধিক যুবক ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে বিরূপ ধারণা পোষণ করেন। কিন্তু বায়ান্ন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত যে ছাত্ররাজনীতি আলোকবর্তিকা হয়ে জাতিকে পথ দেখিয়েছে, সেই ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে ৮০ শতাংশের বেশিসংখ্যক যুবক কেন বিরূপ ধারণা পোষণ করেন, সেটি রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তি থেকে শুরু করে বড় বড় নেতারাও জানেন। কিন্তু তার সমাধান মিলছে না, মেলাতে চাচ্ছে না৷ সমাধান আনা উচিত। কারণ, বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির অতীতটা যে অনেক গৌরবের।
বড় দুই ছাত্র সংগঠন ছাত্রদের ন্যায্য দাবি দাবা নিয়ে, গণমানুষের ন্যায্য অধিকার নিয়ে সর্বশেষ কবে চোখে পড়ার মতো কর্মসূচী পালন করে তা মানুষ ভুলে বসেছে। কিন্তু টেন্ডাবাজি, চাঁদাবাজি, সিট বাণিজ্য, দুই গ্রুপে মারামারি থেকে হত্যা, ধর্ষণ, গুম, খুন ইত্যাদির মতো জঘন্যতম অপরাধের খবর মানুষকে ভুলতে দেয়নি। ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলো মানুষের সরলতাকে কাজে লাগিয়ে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়ে সাম্প্রদায়িক হামলা থেকে মামলা করিয়ে নিজের স্বার্থ হাঁচিলে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
বাম প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে যখন ছাত্র-জনতার ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে ঠিক তখনি তাদের ওপর দমন-পীড়ন, হামলা-মামলা, হয়রানি করিয়ে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিছুদিন আগে বাম প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনে গোটা দেশ উত্তাল করে লং মার্চের কর্মসূচী পালন করতে গেলে পথে পথে তাদের ওপর হামলা, গাড়ি ভাংচুর করা হলো। তবে কি দেশে সুস্থ ও আদর্শ ধারার ছাত্র রাজনীতি আবার ফিরে আসবে না? আদর্শ ধারার ছাত্র রাজনীতি ছাড়া জাতীয় রাজনীতিতে ভালো মানের নেতা গড়ে ওঠবে কেমন করে? এবং আগামীতে দেশ প্রগতির পথে হাটবে কিভাবে?
ছাত্র রাজনীতির নামে যে টেন্ডাবাজি, চাঁদাবাজি, সিট বাণিজ্য, দুই গ্রুপে মারামারি থেকে হত্যা, ধর্ষণ, গুম, খুন ইত্যাদি চলছে এসবকে কি ছাত্র রাজনীতি বলে? না। ছাত্র রাজনীতির নাম নিয়ে এসব চালিয়ে দেশের আদর্শ ধারার ছাত্র রাজনীতিকে আইসিইউতে পাঠানো পরিকল্পনা করা হয়েছে যার মধ্য দিয়ে মেধাবী ছাত্রদের রাজনীতি থেকে দূরে রেখে লুটপাটের রাজ্যত্ব কায়েম করা যায়। এই পরিকল্পনা ধুলিসাৎ করার দায়িত্ব এখন জনগণের ঘাড়ে এসে পড়েছে। কারণ দেশটা চলে জনগণের ট্যাক্সের টাকায়। ছাত্র রাজনীতির বিপথগামিতা দূর করতে প্রয়োজন ছাত্র রাজনীতির দলীয় লেজুড়বৃত্তি পরিহার করা, আদুভাই ও অছাত্রদের সংগঠনে প্রশয় না দেওয়া, ছাত্র সংগঠনগুলোর নিয়মিত কাউন্সিল/সম্মেলন করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করা, একাডেমিক বিধানের বাইরে বছরের পর বছর কোনো ছাত্রকে প্রতিষ্ঠানে থাকা এবং আবাসিক হলে সিট বরাদ্দ না রাখার ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। পুঁজিবাদী শোষণমূলক সমাজে নাগরিকের স্বার্থরক্ষায় বঞ্চিত মানুষের সংগঠিত হওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
ছাত্র রাজনীতি নেতৃত্ব গুণ তৈরি করে, ছাত্র রাজনীতি সাধারণ মানুষের চাওয়া পাওয়াকে কাছে থেকে দেখতে সাহায্য করে, ছাত্র রাজনীতি বৃহদস্বার্থের মূল্য শেখায়, ছাত্র রাজনীতি শোষকের হাত থেকে শোষিতদের বাঁচানোর তাগিদ দেয়, ছাত্র রাজনীতি অধিকার সচেতনতা শেখায়, ছাত্র রাজনীতি দেশের প্রকৃত চাহিদার ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা দেয়, ছাত্র রাজনীতি নেতাদের মধ্যে নৈতিকতা তৈরি করে। ফলে ছাত্র রাজনীতিকে উপেক্ষা করার উপায় নেই।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি