বঙ্গবন্ধু ও শেখ রাসেল
১৭ অক্টোবর ২০২২ ১৮:১১
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। রাসেলের নামকরণের একটা দারুণ গল্প আছে। বঙ্গবন্ধু বার্ট্রান্ড রাসেলের লেখা খুব পছন্দ করতেন। তিনি প্রায়ই বঙ্গমাতাকে রাসেলের লেখা ব্যাখা করে শোনাতেন। এতে করে বঙ্গবন্ধুর পাশাপাশি বঙ্গমাতাও রাসেলের খুব ভক্ত হয়ে যান। যার ফলে সর্বকনিষ্ঠ পুত্রের নাম রেখেছিলেন তাদের প্রিয় দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে। রাসেলের উদার, মানবতাবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক চেতনার ছায়া পড়ুক তার সন্তানের ওপর এটাই বঙ্গবন্ধু চাইতেন মনেপ্রাণে। চাইতেন তার শেষ সন্তান যেন হয়ে ওঠে দার্শনিক রাসেলের মতো মুক্তমনা বিশাল হৃদয়ের মানুষ। বড় হয়ে শেখ রাসেল কেমন মানুষ হতেন তা দেখার সৌভাগ্য আমাদের হলো না। তার আগেই ঘাতকের বুলেট সবকিছু শেষ করে দিলো। সদা হাস্যজ্বল মুখটা চির জনমের মতো স্তব্ধ হয়ে গেলো।
বঙ্গবন্ধু এবং শেখ রাসেলের সম্পর্কটা একটু অন্য রকম ছিলো। একেতো পরিবারের সবথেকে ছোট সন্তান, তারউপর বাবার নেওটা। দেশ স্বাধীনের পর বিভিন্ন রাস্ট্রীয় সফরে বঙ্গবন্ধু সাথে শেখ রাসেল গিয়েছেন। দেশ স্বাধীনের আগে বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকা কালীন সময়েও ছোট্ট রাসেল বাবার সাথে দেখা করতে মা এবং বোনের সাথে যেতেন। যার প্রমাণ বঙ্গবন্ধুর লেখায় পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন: বার্ট্রান্ড রাসেল থেকে শেখ রাসেল
১৯৬৬ সালের ১৫ জুন বন্দি বঙ্গবন্ধু লিখেছেন- ‘সাড়ে চারটায় জেলের লোক এসে বলল-চলুন আপনার দেখা আসিয়াছে, আপনার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে বসে আছে জেল অফিসে। তাড়াতাড়ি রওয়ানা করলাম। দূর থেকে দেখি রাসেল, রেহানা ও হাচিনা চেয়ে আছে আমার রাস্তার দিকে। ১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতোই আব্বা আব্বা বলে চিৎকার করছে। জেল গেট দিয়ে একটা মাল বোঝাই ট্রাক ঢুকেছিল। আমি তাই জানালায় দাঁড়াইয়া ওকে আদর করলাম। একটু পরেই ভিতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে ‘আব্বার বাড়ি’। এখন ওর ধারণা হয়েছে এটা ওর আব্বার বাড়ি। যাবার সময় হলে ওকে ফাঁকি দিতে হয়।’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা-৯৩)। আবার দীর্ঘদিন পিতাকে কাছে না পেয়ে সন্তানের মনের অবস্থা কেমন হয় তাও ফুটে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর লেখায়।
বাংলা নববর্ষের আগে ১৪ এপ্রিল ১৯৬৭ সালে লিখেছেন, ‘জেল গেটে যখন উপস্থিত হলাম ছোট ছেলেটা আজ আর বাইরে এসে দাঁড়াইয়া নাই দেখে একটু আশ্চর্যই হলাম। আমি যখন রুমের ভিতর যেয়ে ওকে কোলে করলাম আমার গলা ধরে আব্বা আব্বা করে কয়েকবার ডাক দিয়ে ওর মার কোলে যেয়ে আব্বা আব্বা করে ডাকতে শুরু করল। ওর মাকে ‘আব্বা বলে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপার কি?’ ওর মা বলল, “বাড়িতে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কাঁদে তাই ওকে বলেছি আমাকে আব্বা বলে ডাকতে।” রাসেল আব্বা আব্বা বলে ডাকতে লাগল। যেই আমি জবাব দেই সেই ওর মার গলা ধরে বলে, তুমি আমার আব্বা। আমার উপর অভিমান করেছে বলে মনে হয়। এখন আর বিদায়ের সময় আমাকে নিয়ে যেতে চায় না।’(কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা -২২১)। একজন পিতার কাছে এটা কতোটা কষ্টের ব্যাপার তা যারা এর সম্মুখীন না হয়েছেন তারা জানেন না।
আরও পড়ুন: শেখ রাসেল শোকগাঁথার এক অনন্য চরিত্র
ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িটা আওয়ামী লীগের অফিসের মতোই ছিলেো। সবসময় লোকজন থাকতো। স্লোগান হতো। ছোট্ট রাসেল তার কিছু কিছু মুখস্থ করে ফেলেছিলেন। ২৭ শে মে লিখেছেন- ‘রাসেল আমাকে পড়ে শোনাল, আড়াই বৎসরের ছেলে আমাকে বলছে, ৬ দফা মানতে হবে, সংগ্রাম চলবে চলবে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, ভাঙা ভাঙা করে বলে, কি মিষ্টি শোনায়! জিজ্ঞাসা করলাম, “ও শিখলো কোথা থেকে?” রেণু বলল, “বাসায় সভা হয়েছে, তখন কর্মীরা বলেছিল তাই শিখেছে।” বললাম, ‘আব্বা, আর তোমাদের দরকার নাই এ পথের। তোমার আব্বাই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করুক।’ (কারাগারের রোজনামচা,পৃষ্ঠা-২৪৬-২৪৭)।
শিশু রাসেলকেও কাটাতে হয় বন্দিজীবন। অত্যন্ত কষ্টকর ছিল তার দিনগুলো। তার বন্দিত্ব সম্পর্কে বোন শেখ হাসিনা ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘ছোট্ট রাসেলও বন্দী জীবন যাপন শুরু করে। ঠিকমতো খাবারদাবার নেই। কোনো খেলনা নেই, বইপত্র নেই, কী কষ্টের দিন যে ওর জন্য শুরু হলো। বন্দিখানায় থাকতে আব্বার কোনো খবর আমরা জানি না। কোথায় আছেন, কেমন আছেন, কিছুই জানি না। প্রথমদিকে রাসেল আব্বার জন্য খুব কান্নাকাটি করত। তার ওপর আদরের কামাল ভাইকে পাচ্ছে না, সেটাও ওর জন্য কষ্টকর।’ (ইতিহাসের মহানায়ক, পৃষ্ঠা ২১)।
শেখ রাসেল হতে পারতেন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার কান্ডারী। হতে পারতেন পৃথিবীর সেরা রাষ্ট্রপ্রধান। কারণ তিনি তো সর্বক্ষণ জাতির পিতার কাছাকাছি থাকতেন। বিশ্ববন্ধুর থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার দীক্ষা নিয়ে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে শ্রেষ্ঠ জায়গায় নিয়ে যেতেন। কিন্তু আমাদের দূর্ভাগ্য, আমরা আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ নেতাকে হারিয়েছি।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি