Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শেখ রাসেল শোকগাঁথার এক অনন্য চরিত্র

মো. সাঈদ মাহাদী সেকেন্দার
১৭ অক্টোবর ২০২২ ১৮:২৪

দীর্ঘ ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় কত সংগ্রাম, কত রক্তস্রোত, কত বেদনা, জেল-জুলুম, অত্যাচার, নিপীড়ন সইতে সইতে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে রচিত হলো এদেশের বিজয়। বিজয়ের এই গৌরব আপামর জনতার সঙ্গে শিশুরাও অনুভব করছে। বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসে যে সাহস আর সংগ্রামের ঝাঁঝালো প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছে সেখানে এ দেশের শিশুরাও গৌরবের প্রতীক হয়ে মিশে আছে।

শিশুদের প্রতীক হিসেবে শেখ রাসেলের কথা বলতে পারি। তিনি বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র। তাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু এখানে-ওখানে সফর করেছেন। মানুষের দুর্দশার সঙ্গী হয়েছেন রাসেল এবং প্রত্যক্ষ করেছেন তার শৈশবে। অনেক ছবিতে দেখা যায় বঙ্গবন্ধুর সফর সঙ্গী শেখ রাসেল বঙ্গবন্ধু আঙুল ছুঁয়ে আছে। আমরা দেখতে পাই, বাঙালি ইতিহাসের এই মহানায়কের আঙুল ছুঁয়ে পায়ে-পায়ে হাঁটছে শিশু রাসেল। রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু ছুটছেন বাংলার নানা প্রান্তরে, কথা বলছেন আপামর জনতার সঙ্গে। বেঁচে থাকলে আজ ৫৯তম জন্মদিনের কেক কাটতেন শেখ রাসেল! পুরোদস্তর মধ্য বয়স্ক পার হওয়া এক পুরুষের দীপ্তিতে উদ্ভাসিত হতেন তিনি। হয়তো-রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব কাঁধে থাকত, কারণ, দেশ পরিচালনা ও রাজনীতির সৎ রক্ত যে তার শরীরে প্রবাহিত। আবার পিতার প্রিয় বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো পৃথিবী বিখ্যাত দার্শনিক ও বিজ্ঞানীও হতেন হয়তো। কিংবা নিজের ইচ্ছা ছিল আর্মি অফিসার হওয়ার, তাহলে জাঁদরেল সেনাবাহিনীর জেনারেলেই হতেন সুনিশ্চিত!

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ ‍পুত্র শেখ রাসেল ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর হেমন্তের জ্যোৎস্না-প্লাবিত রাতে ধানমন্ডির ঐতিহাসিক স্মৃতি-বিজড়িত বঙ্গবন্ধু ভবনে জন্ম তার। অনেক অনেক সম্ভাবনার স্বপ্নিল দোলা দিয়ে তিনি চলে গেছেন জীবনের শুরুর দিনগুলোতেই। যদি বেঁচে থাকতেন, হতেন পিতা বঙ্গবন্ধুর চেয়েও বয়সী।কারণ ৫৫ বছরেই প্রাণ দিতে হয়েছিল পিতা ও জাতির স্থপতিকে। বাঙালির কাছে শেখ রাসেলও বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের মতোই অন্তহীন বেদনার এক মহাকাব্য, চেতনার গভীরে চিরস্থায়ী এক তাজা ক্ষতের নাম, বুকভারি-করা এক দীর্ঘশ্বাসের নাম। যখনই ১৫ আগস্টের নির্মম, নিষ্ঠুর, বর্বর হত্যাকাণ্ডের সেই কালোরাতের কথা মনে হয়, নিষ্পাপ শিশু রাসেলের মুখটিই প্রথমে ভেসে আসে রক্তরঞ্জিত বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে সঙ্গে।

বিজ্ঞাপন

পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে রাসেল সবার ছোট। সবার চোখের মনি, ঘর আলো করা এক প্রদীপ। হাসু, জামাল, কামাল ও রেহানাসহ সবার জন্য এক আনন্দের বহমান নদী রাসেল। বঙ্গবন্ধু ছিলেন পৃথিবীবিখ্যাত দার্শনিক-চিন্তাবিদ-শান্তি আন্দোলনের সক্রিয় সংগঠক রার্ট্রান্ড রাসেলের ভক্ত। রাসেলের লেখা নিয়ে বেগম মুজিবের সঙ্গে আলোচনাও করতেন। বঙ্গবন্ধুর কাছে শুনে শুনে বেগম মুজিবও হয়ে উঠেছিলেন রাসেলভক্ত। আর সে কারণেই হয়তো কনিষ্ঠ সন্তানের নাম রেখেছিলেন রাসেল। মনে হয়তো প্রচ্ছন্ন আশা ছিল, তাদের ছোট ছেলেটিও একদিন বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো যশস্বী-মনস্বী হবে। মেধা ও মননের অপূর্ব সমাহার ছিল শিশু রাসেলের কচি মনে। তার শিশু মন ছিল মানবিকতায় ভরা। তার মনে হাজারো প্রশ্ন থাকত, সব প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইত রাসেল।

আরও পড়ুন: বার্ট্রান্ড রাসেল থেকে শেখ রাসেল

শিশু রাসেলের বেশিরভাগ সময় কেটেছে বাবাকে ছাড়াই। কারণ তার বাবা রাজনৈতিক বন্দি হয়ে কারাগারে কাটিয়েছেন জীবনের বেশিরভাগ সময়। তাই তো মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে আব্বা বলে সম্বোধন করত রাসেল। এসব নিয়ে কারাবন্দী বঙ্গবন্ধুর মনেও চাপা কষ্ট অনুভূত হত।বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানা তার ছোট ভাই সম্পর্কে উল্লেখ করেন, শেখ রাসেল আমাদের ভালোবাসা। তার একটি লেখা থেকে উদ্ধৃত করা যেতে পারে—‘আব্বার সঙ্গে আমার ও রাসেলের জাপান, মস্কো ও লন্ডন বেড়াবার সুযোগ হয়। রাষ্ট্রীয় সফর বলেই রাসেল বিদেশিদের সাথে খুব সৌজন্যমূলক ব্যবহার করত। সে ছোট্ট হলেও বুঝতে পারত কোথায়, কীভাবে চলতে শিখতে হবে। ঢাকায় ফিরে আমি যখন মা ও সবার কাছে ওর এই সুন্দর ব্যবহারের গল্প করেছি তখন সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনেছে। লন্ডনে বিখ্যাত মাদাম তুসো’র মিউজিয়ামে আমরা যখন বেড়াতে যাই রাসেলের বিস্ময় আর কাটে না। আমরা দুইজন আব্বার সাথে নাটোরের উত্তরা গণভবনেও গিয়েছি। রাসেল সেখানে মাছ ধরত, আমরা বাগানে ঘুরে বেড়াতাম। ঢাকার গণভবনেও রাসেল মাছদের খাবার খাওয়াত। ফুফাতো ভাই আরিফ তার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। তারা দুইজন একই স্কুলে পড়ত এবং একসঙ্গে খেলত। টুঙ্গিপাড়ায় তাদের একটা খুদে বাহিনী ছিল, যাদের সঙ্গে খালের পানিতে সাঁতার কাটা, ফুটবল খেলায় মেতে থাকত তারা।’

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতায় লাল-সবুজের পতাকাসহ যেখানে-সেখানে ছড়িয়ে আছে বীর বাঙালির ইতিহাস সেখানেই রাসেল। রাসেল আজ শোকগাঁথার এক অনন্য চরিত্র। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র রাসেল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর জামাতা ড. ওয়াজেদ মিয়াকে উদ্ধৃত করে লেখেন, ‘রাসেল ছিল বঙ্গবন্ধুর কলিজার টুকরা। তিনি রাসেলকে এ দেশের সমস্ত শিশুর মডেল হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। প্রতিটি শিশুই তার পিতা-মাতার কাছে বড় আদরের। এখানে জাত-পাত, ধনী-গরিবের ভেদাভেদ নেই। আমাদের নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশটাকে ভালো করে গড়তে হলে এই শিশুদের সঠিকভাবে গড়তে হবে। ওদের তাজা রক্তে দেশপ্রেম ঢুকাতে হবে। ওদের ভালোমতো গড়তে পারলেই আমি সার্থক।

‘কারাগারের রোজনামচা’য় শেখ রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন ‘৮ ফেব্রুয়ারি ২ বছরের ছেলেটা এসে বলে, ‘আব্বা বালি চলো’। কী উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম, ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, ‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো। ’ ও কি বুঝতে চায়! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলে-মেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শিখেনি। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।’

‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইয়ের ২১ পৃষ্ঠায় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার বিষয়ে শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘আব্বার সঙ্গে প্রতি ১৫ দিন পর আমরা দেখা করতে যেতাম। রাসেলকে নিয়ে গেলে ও আর আসতে চাইত না। খুবই কান্নাকাটি করত। ওকে বোঝানো হয়েছিল যে, আব্বার বাসা জেলখানা আর আমরা আব্বার বাসায় বেড়াতে এসেছি। আমরা বাসায় ফেরত যাব। বেশ কষ্ট করেই ওকে বাসায় ফিরিয়ে আনা হতো। আর আব্বার মনের অবস্থা কী হতো, তা আমরা বুঝতে পারতাম। বাসায় আব্বার জন্য কান্নাকাটি করলে মা ওকে বোঝাতেন এবং মাকে আব্বা বলে ডাকতে শেখাতেন। মাকেই আব্বা বলে ডাকত।’

রাসেলকে নিয়ে ‘কারাগারের রোজনামচা’র ২৭ শে মে এবং ২৮ শে মে ১৯৬৭ সালের স্মৃতিচারণায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘রাসেল আমাকে পড়ে শোনাল, আড়াই বৎসরের ছেলে আমাকে বলছে ৬ দফা মানতে হবে- সংগ্রাম, সংগ্রাম- চলবে চলবে-পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ভাঙা ভাঙা করে বলে কি মিষ্টি শোনায়! জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ ও শিখল কোথা থেকে। রেণু বলল, বাসায় সভা হয়েছে তখন কর্মীরা বলেছিল, তাই শিখেছে’।

আরও পড়ুন: বঙ্গবন্ধু ও শেখ রাসেল

ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বলে কথা! ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মাত্র ১১ বছরের কচি বয়সে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে ঘাতকদের হাতে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় শেখ রাসেল। মা, বাবা, দুই ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, চাচার লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে সবার পর সবশেষে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয় শেখ রাসেলকে। তার আগে সে বারবার বলেছিল, ‘মায়ের কাছে যাব’। তৃষ্ণার্ত হয়ে পানি খেতেও চেয়েছিল। মায়ের কাছে নেওয়ার নাম করেই হত্যা করা হয় শিশু রাসেলকে।পৃথিবীতে যুগে যুগে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে কিন্তু শিশু রাসেলের মতো এমন নির্মম, নিষ্ঠুর এবং পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড কোথাও ঘটেনি।

শেখ রাসেলের ছিল স্বল্পায়ু জীবন। এতটুকু জীবনেই প্রাণোচ্ছল শিশু রাসেল মানুষকে ভালোবাসতে শিখেছিল, বঙ্গবন্ধুর আনন্দের সঙ্গী ছিল আর বাঙালির চিরন্তন পারিবারিক সম্পর্কের বন্ধনে তার অনাবিল উচ্ছ্বাস ছিল অফুরন্ত। ছোট্ট শিশুটি যে প্রচণ্ড নিষ্ঠুরতার নির্মমতম শিকার হয়েছিল, তা এখনো বিশ্ব মানবতাকে বিচলিত করে।ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ঘাতকদের সেই অপচেষ্টা শতভাগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। শহীদ শেখ রাসেল আজ বাংলাদেশের শিশু-কিশোর, তরুণ, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের কাছে এক ভালবাসার নাম। অবহেলিত, পশ্চাৎপদ, অধিকারবঞ্চিত শিশুদের আলোকিত জীবন গড়ার প্রতীক হয়ে গ্রাম-গঞ্জ-শহর তথা বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ জনপদ-লোকালয়ে শেখ রাসেল এক মানবিক সত্তায় পরিণত হয়েছে। মানবিক চেতনা সম্পন্ন সকল মানুষ শেখ রাসেলের মর্মান্তিক বিয়োগ বেদনাকে হৃদয়ে ধারণ করে বাংলার প্রতিটি শিশু-কিশোর তরুণের মুখে হাসি ফোটাতে আজ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। জন্মদিনে শেখ রাসেলকে স্মরণ করি গভীর আবেগ, শূন্যতা ও ভালোবাসায়। অঙ্গীকার করি রাসেলের মতো প্রতিটি শিশুর কল্যাণের জন্য। আর প্রতিজ্ঞবদ্ধ হয়ে উচ্চারণ করি, বাংলাদেশ হোক সকল শিশুর জন্য নিরাপদ আবাসস্থল।

লেখক : সাবেক সহ-সম্পাদক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

মুক্তমত মো. সাঈদ মাহাদী সেকেন্দার শেখ রাসেল শোকগাঁথার এক অনন্য চরিত্র

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর