Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত: মৃত্যুঞ্জয়ী মহাপ্রাণ

শিবলী সাদিক
২ নভেম্বর ২০২২ ১৯:৫৭

সে ছিল ইতিহাসের অগ্নিযুগ। সেই যুগের অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র ও অগ্রগামী মহাপ্রাণ মানুষ ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮৬-১৯৭১)। ইতিহাসের সূর্যসন্তান, অবিস্মরণীয় আত্মপ্রত্যয়ী ও আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্বর অগ্নিযুগের মৃত্যুঞ্জয়ী মহান পুরুষ, সর্বকালের অন্যতম সেরা বাঙালি ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সর্বাংশ জুড়ে ছিল কেবল বাংলা, বাঙালিত্ব আর মাতৃভূমির প্রতি নিখাদ ভালোবাসা। চিন্তা-চেতনায়, মেধায়-মননে, অস্থি-মজ্জায় খাঁটি বাঙালি।

এক কথায়, প্রগতিশীল দেশপ্রেমিক আপাদমস্তক খাঁটি বাঙালি বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন তাই। আমৃত্যু তিনি গভীর দেশপ্রেমের পরিচয় ও পরীক্ষা দিয়ে গেছেন। ইতিহাসের প্রতিটি পর্বে নিজের বিশ্বাস ও কর্মের জন্য চরম মূল্য দিয়েছেন। সর্বাধিক মূল্য দিয়েছেন ১৯৭১ এর মার্চে। ৭ই মার্চ ১৯৭১ সালে তিনি স্বহস্তে কুমিল্লার নিজ বাড়িতে উত্তোলন করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা এবং বলেছিলেন- ‘আমি নিজ হাতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিয়ে গেলাম, আমার রক্তের উপর দিয়ে এই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে। হয়ত তখন আমি থাকব না। তবে আমার পতাকা ওড়ানো বৃথা যাবে না।’ তার ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। আর তাই বাংলাদেশ বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে।

মাতৃভূমির প্রতি তার ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম, প্রগাঢ়, তুলনাহীন। দেশপ্রেমের নিদারুণ সত্তা বুকে ধারণ ও লালন করে কবি ডি এল রায়ের- ‘এই দেশেতে জন্ম আমার যেন এই দেশেতে মরি’ এই অমর বাণীকে স্বীয় জীবনে রূপায়িত করেছেন। তাইতো ১৯৪৭ এর মধ্য আগস্টে দেশ বিভাগের সময় কংগ্রেস নেতা কিরণশংকর রায়, সর্বত্যাগী গান্ধীবাদী নেতা ড: প্রফুল্ল ঘোষসহ আরও অনেকের মতো নিজেদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির শঙ্কায় দেশত্যাগ করেননি। বরং দেশমাতৃকার প্রতি গভীর ভালোবাসায় তিনি হয়তোবা মনে মনে এও বলে থাকবেন- ‘তোমার যেখানে সাধ চলে যাও/আমি রয়ে যাব এই বাংলায়।’ সেই থেকে তিনি রয়ে গেলেন যার সাঙ্গ হলো সেই ‘৭১’ এ তার আত্মাহুতির মাধ্যমে। বাংলাদেশের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতনের মধ্যেও দেশের মানুষের প্রতি তাঁর আস্থা ছিল অবিচলিত। পাবলো নেরুদার মতো আজীবন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, ‘সুদিন আসবে, একদিন আমাদের সব হবে আর সুখে থাকবে সবাই।’ এই দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সংকল্প। বহুবিধ প্রতিকূলতা ও অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার অনাগত সাফল্য সম্পর্কে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণরূপে আশাবাদী। বঙ্গবন্ধুর ন্যায় তিনিও বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশ একদিন স্বাধীন হবেই।

ইতিহাস সাক্ষী ধারাবাহিক আন্দোলন বিকাশের পাকিস্তানপর্বের গোড়াতেই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অঙ্কুরোদ্গম হয়েছিল বাঙালির ভাষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে। ভাষা আন্দোলন নামক এই মহতি উপাখ্যানের মুখপাত্র হিসেবে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সমগ্রভাগে ছিলেন সমানভাবে সক্রিয়। নানা প্রতিকুলতা ও বিপদসংকুল বৈরী পরিবেশের মধ্যেও এই আন্দোলনে তাঁর অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বদান বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অত্যুজ্জ্বল যুগান্তকারী ঘটনা।

বাঙালি জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠার ইতিহাসের ঊষালগ্নে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র সাড়ে ৫ মাসের মাথায় ১৯৪৮ সালের ২৩ শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধি হিসেবে বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে তিনি দুটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং ২৫ শে ফেব্রুয়ারি সুনিপুণ দক্ষতায় ও অসীম সাহসিকতার সঙ্গে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার পক্ষে নানা যুক্তির অবতারণাপূর্বক বলিষ্ঠ বক্তব্য উপস্থাপন করে বলেন, ‘সমগ্র পাকিস্তানের ৬ কোটি ৯০ লক্ষ লোকের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লক্ষ লোকেরই ভাষা বাংলা। সুতরাং পাকিস্তান গণপরিষদের আলোচনায় বাংলাকে স্থান তো করিতেই হইবে। বাংলাকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকার করিয়া লওয়া উচিত।’

সেদিন গণপরিষদে বাংলার পক্ষে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে সহমত পোষণ করে আরও বক্তৃতা করেন কংগ্রেস দলীয় সদস্য প্রেমহরি বর্মণ, ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত ও শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। পাকিস্তান গণপরিষদকর্তৃক এ দাবী প্রত্যাখ্যাত হলে ভাষার জন্য শুরু হয় দুর্বার আন্দোলন। আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন পূর্ববঙ্গের ছাত্র, শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী সমাজ। ১৯৪৮ এর ১১ মার্চ পূর্ব বাংলায় ধর্মঘট ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকায় তদানীন্তন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, যুবনেতা শামসুল হক। মোগলটুলীর শওকত আলী, রণেশ দাশগুপ্তসহ সারা প্রদেশের অসংখ্য নেতা-কর্মী কারাবরণ করেন। বগুড়ায় মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মনীষী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। ফলস্বরূপ পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাভাষার স্বীকৃতি। ১৯৪৮ এ যার শুরু এবং ১৯৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারিতে ব্যাপ্তি ও প্রচণ্ড বিষ্ফোরণ। এই প্রচ- বিষ্ফোরণের শক্তিশালী ধাক্কায় ধ্বসে পড়তে শুরু করে ইসলাম ধর্মের ধ্বজাধারী পাকিস্তান নামক যুক্তিহীন জোড়াতালির রাষ্ট্রের অচলায়তন।

জন্মই যার আজন্ম পাপ সে ছিলো পাকিস্তান। অর্থাৎ পাকিস্তানের জন্ম আর নামকরণের ইতিবৃত্তের মধ্যেই নিহিত ছিল বাঙালিদের আজন্ম পাপী পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র বিসর্জনের সকরুণ ইঙ্গিত। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকদের হাত থেকে স্বাধীন হওয়ার পূর্বে ‘পাকিস্তান’ শব্দটির কোনে অস্তিত্ব ছিলনা। ১৯৪৭ এর আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষকে ভাগ করে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি দেশের সৃষ্টি করা হয়। পাকিস্তান শব্দটি তৈরি করা হয়েছে বর্তমান পাকিস্তানের কয়েকটি প্রদেশের নাম থেকে। যেমন পাঞ্জাব, আফগানিয়া, কাশ্মীর, ইরান, সিন্ধ, তুকারিস্তান, এবং আফগানিস্তান ও বেলুচিস্তান এর সাথে ‘স্তান’ শব্দটি যুক্ত করা হয়েছে, তা হিন্দি ও পারস্য ভাষায় কোন দেশ বা এলাকাকে বুঝায়। সবমিলিয়ে ‘পাকিস্তান’ শব্দের অর্থ হলো ‘পাক’ অর্থাৎ ধর্মীয়ভাবে শুদ্ধ ও পরিষ্কার। লক্ষ্যণীয় যে, পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের সময় পূর্ব পাকিস্তান নামে ১,৪৪,০০০ বর্গমাইল এলাকাবিশিষ্ট যে প্রদেশটিকে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করা হয়েছিল, পাকিস্তান নামকরণের ক্ষেত্রে তাকে একেবারেই বিবেচনা করা হয়নি। বৈষম্যের শুরু কিন্তু এখান থেকেই।

বাংলা ও বাংলাদেশের অন্যতম ইতিহাসনির্মাতা বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক ও রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের জন্ম ভারতীয় উপমহাদেশের আত্মপ্রকাশিত প্রথম রাজনৈতিক দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের এক বছর পর ১৮৮৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার রামরাইল গ্রামে। পূর্ব পুরুষ ছিলেন জমিদার ও ত্রিপুরার মন্ত্রী। তবে পিতা জগৎবন্ধু দত্ত ছিলেন মুন্সেফ আদালতের সেরেস্তাদার। ১৯০৮ সনে বিএ এবং ১৯১০ সনে আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পরবর্তীতে তিনি যোগ দেন আইন পেশায়।

মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯২১ সনে সমমনা ব্যক্তিবর্গের সহযোগে তিনি কুমিল্লায় ‘মুক্তিসংঘ’ নামে একটি সংস্থা গঠন করেন। ১৯২২ সনে ত্রিপুরা জেলার প্রতিনিধি হিসেবে কংগ্রেসের গয়া অধিবেশনে যোগ দেন। ১৯২৯ সনে কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ‘সর্বভারতীয় আইন অমান্য আন্দোলনের’ অংশ হিসেবে আইন অমান্যের দায়ে কারাবরণ করেন। ১৯৩০ সনের ২ জুলাই কুমিল্লায় জেলের অভ্যন্তরে অনুষ্ঠিত প্রহসনমূলক বিচারে তিনি তিন মাসের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে ১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে তিনি বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য হোন। ১৯৪০ সালে বেঙ্গল লেজিসলেটিভের সভ্য নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কংগ্রেস দলের নেতা হন কিরণশঙ্কর রায় এবং ডেপুটি লিডার নির্বাচিত হন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ১৯৪৭ ও ১৯৫৮ সালে দুই দফায় তিনি আতাউর রহমান খান-এর মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। এ সময়ে চিকিৎসা, গণস্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রি হিসেবে তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠা ও দক্ষতার সাক্ষর রাখেন।

ঐতিহাসিক সত্য এই যে, বাঙালি বীরত্বের সর্বোত্তম ও মহোত্তম প্রকাশ ঘটে ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি। আর তার প্রাণপুরুষ এবং পুরোধা ব্যক্তিত্ব বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। বাংলা ভাষার প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনকর্তাদের অপরিসীম ঘৃণা ও অবহেলার কারণেই সূত্রপাত হয় ভাষা আন্দোলনের। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ এই ভাষা আন্দোলনেরই সুদূরপ্রসারী ফলশ্রুতি। ‘৪৮ থেকে ৫২’ বীর বাঙালি ইতিহাসের পথ ধরে এগিয়ে চললো প্রতিবাদ প্রতিরোধ, আন্দোলন, মুক্তি-সংগ্রামের পথে। সেই পথ ধরেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ‘৭১’ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, জাতীয় সঙ্গীত এবং পতাকা অর্জন।

বাংলা মায়ের কৃতী সন্তান, কীর্তিমান বাঙালি ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের জীবনদৃষ্টি ছিল সুদূর প্রসারিত। ব্যক্তিস্বার্থ অন্ধত্ব, মোহ, পাপ, লোভ ইত্যাদি তাঁর চরিত্রে ছিল না। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক, সৎ, বিনয়ী, সদালাপী, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও পরহিতব্রতী, মহান পুরুষ।

বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের গোড়াতেই ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ গভীর রাতে কনিষ্ঠ সন্তান দিলীপ দত্তকেসহ এই মহাপ্রাণ বাঙালিকে কুমিল্লা সেনানিবাসে ধরে নিয়ে যায় বর্বর পাকবাহিনী। তার ওপর চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন। তাঁর হাঁটু ভেঙে দেওয়া হয়, চক্ষু উৎপাটন করে নেওয়া হয়। নির্মম নির্যাতনের ফলে ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল তার মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। তবে ‘কীর্তিমানের মৃত্যু নাই’— এ যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দেহত্যাগ করলেও বেঁচে আছেন। বেঁচে থাকবেন প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে যতদিন বাংলা থাকবে, থাকবে বাংলাদেশ।

লেখক: অধ্যক্ষ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজ, ধানমন্ডি, ঢাকা

সারাবাংলা/একে

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাভাষা


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

বাংলাদেশ-ভারত টেস্টে হামলার হুমকি!
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২১:৩৫

সম্পর্কিত খবর