কপ-২৭; আশা-নিরাশার সম্মেলন
৬ নভেম্বর ২০২২ ১৬:২৭
কপ সম্মেলনে পৃথিবী এখন পর্যন্ত কতটুকু লাভবান হয়েছে তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তারপরও পৃথিবীকে রক্ষার আশায় বিশ্ব নেতারা একত্রিত হয়। কারণ পৃথিবীর সবচেয়ে দুশ্চিন্তার কারণ হলো জলবায়ু পরিবর্তন। কিছু সিদ্ধান্ত হয়। এ বছরের কপ-২৭ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে আজ (নভেম্বর-৬) থেকে। কনফারেন্স অফ দ্যা পার্টি বা সংক্ষেপে কপ হলো বিশ্বের নেতাদের জলবায়ু বিষয়ক সম্মেলন। ২০১৫ সালের আগে বিভিন্ন দেশ এবং বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর গুরুত্বারোপ করলেও একত্রিতভাবে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। অবশেষে জলবায়ু পরিবর্তন এবং তার লাগাম টেনে ধরতে প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়নে বিশ্ব নেতারা একত্রিত হন। একত্রিত হলেও কার্যত খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি। এর পেছনেও রয়েছে নানা কারণ। উন্নত হওয়ার দৌড়ে কেউ থামতে রাজী নয়। আর এখন জ্বালানীর বড় অংশই আসে জীবাশ্ম জ্বালানী থেকে। এ বছর আগামী ৬ নভেম্বর থেকে মিসরে কপ-২৭ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এটা যেখানে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সেই মিসর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তেল এবং গ্যাস উত্তোলন করে রপ্তানি বাড়াচ্ছে। কায়রোতে সবুজ গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। অথচ এসবই জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় মূল চ্যালেঞ্জিং বিষয়। স্বাভাবিকভাবে এই সম্মেলন ঘিরে পৃথিবীর প্রত্যেকেই আগ্রহ থাকে। কারণ এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জলবায়ু পরিবর্তন। করোনা অতিমারী গত দুই বছরে যে ক্ষতি করেছে তার চেয়ে দ্রুত গতিতে এবং ভয়ংকর ক্ষতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে সমগ্র মানবজাতি শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। এক গবেষণায় জানা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীতে বেড়েছে খরার প্রবণতা। বিশেষত উত্তর গোলার্ধে এই প্রবণতা বেড়েছে ২০ গুণ। ইউরোপের তাপমাত্রা চলতি বছর তো রেকর্ড ভেঙেছে অতীতের সব ইতিহাসের। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের এই কপ-২৭ সম্মেলন সত্যিকার অর্থেই গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ কার্বন নিঃস্বরণ।
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির কারণে প্রায় ১০০ কোটি শিশু বর্তমানে অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। আর জাতিসংঘের নতুন একটি গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃস্বরণ হ্রাসে বিশ্বে দেশগুলোর সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতি উষ্ণায়নকমানোয় একেবারেই যথেষ্ট অগ্রগতি না হওয়ায় এ শতাব্দীতে তাপমাত্রা গড়ে ২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাওয়ার মুখোমুখি হয়েছে বিশ্ব। জানা গেছে, এবারের জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্ব উষ্ণায়ন প্রাক-শিল্প স্তরের তুলনায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামিয়ে এনে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে বজায় রাখার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতিতে পৌছার চেষ্টা চলবে। গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, গত বছরের কপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলনের পর থেকে বিশ্বের দেশগুলোর সরকারের কার্বন নিঃস্বরন কমানোর পরিকল্পনায় দুঃখজনকভাবে অগ্রগতি হয়নি। এ পরিস্থিতিতে জরুরিভিত্তিতে সমাজে রুপান্তর ঘটানো গেলেই কেবল বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব। গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, গত জলবায়ু সম্মেলনে দেওয়া প্রতিশ্রুতি মোতাবেক নতুন করে কার্বন নিঃস্বরন কমানোর যে চেষ্টা শুরু হয়েছে তাতে ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমবে ১ শতাংশেরও কম। অথচ বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখতে হলে গ্রীন হাউজ গ্যাস নিঃসারণ ৪৫ শতাংশ কমা দরকার। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ভেতর বাংলাদেশ, মালদ্বিপ রয়েছে চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে।
প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে এই সম্মেলনে কতদূর অগ্রসর হতে পারবে তা নিয়েই থাকবে প্রধান আলোচনা। প্যারিসে হওয়া জলবায়ু চুক্তি প্রথমবারের মতো বিশ্বকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপরীতে একত্রিত করেছে। কিন্তু এর বাস্তবায়ন হওয়াই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্যারিস চুক্তিতে রয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি দুই ডিগ্রী সেলসিয়াসের কম করা, গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ মাত্রা কমিয়ে আনা, ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলিকে সাহায্য করা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি করা ইস্যুগুলো। এর পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলিকে আর্থিক সাহায্য করার প্রসঙ্গও থাকবে। বিশ্বের ১৯৬টি দেশের সমর্থনে করা প্যারিস জলবায়ু চুক্তির বাংলাদেশের মত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোকে আর্থিকভাবে সহায়তা করার যে সিদ্ধান্ত ছিল তা বাস্তবায়িত হলে দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কার্যকর দীর্ঘস্থায়ী পদক্ষেপ নিতে পারে। কমতে পারে দেশের অভ্যন্তরে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের সংখ্যা। কারণ উন্নত বিশ্বের অতিমাত্রায় শিল্পায়নের কারণেই বিশ্বে কার্বন নিঃস্বরণের মাত্রা বেশি। কিন্তু ক্ষতির স্বীকার বাংলাদেশের মতো দেশগুলোই বেশি হচ্ছে। প্রকৃতিক দুর্যোগে একের পর এক বিপর্যস্থ হচ্ছে। ঋতুর বদলে যাওয়ার দৃশ্য এবং প্রকৃতির রুদ্র রুপ আমাদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির যে প্রবণতা তার জন্য সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ার মত হুমকী বহন করছে। ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটাতে পারে। তাছাড়া এর জন্য আমাদের মত নিচু দেশগুলির একটা বিরাট অংশ সাগরের পানিতে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার বিষয়ে বিজ্ঞানীদের হুশিযারী রয়েছে। লবণাক্ততার বিরুপ প্রভাব পড়বে ফসল উৎপাদনে। যা খাদ্য ব্যবস্থার জন্যও ভযাবহ ফলাফল বহন করতে পারে।
জলবায়ু পরির্তনের বিরুপ প্রভাব মোকাবেলায় বিশ্ব নেতাদের দায় স্বীকার করলেও সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নে অনীহার কারণেই জলবায়ু সম্মেলন পৃথিবীকে সুরক্ষা দেওয়ার কাজে আসছে না। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট এখন পৃথিবীর জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। এর থেকে মুক্তি পেতে কার্বন নিঃস্বরণ কমানো ছাড়া বিকল্প পথ নেই। ফলে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়নে সারাবিশ্ব একমত। বিজ্ঞানীরা টেকসই ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে আমাদের জীবনযাপনের ধরনে পরিবর্তন আনতে পরামর্শ দিয়েছেন। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের তাপমাত্রা ১ দশমিক ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে। শিল্পের যাতাকলে পৃথিবীর অবস্থা আজ অত্যন্ত দুর্বিষহ। কেবল উন্নয়নের দোহাই দিয়ে পৃথিবীর অস্তিত্তকে হুমকির মুখে ফেলে তা থেকে পরিত্রাণের উপায় না খোঁজাটা বড় ধরনের বোকামি। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে পৃথিবী প্রাণীকুলের বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পরছে। টিকে থাকা রীতিমত হুমকিতে পরিণত হচ্ছে। জলবায়ু স্বাভাবিক মাত্রায় ফিরিয়ে আনতে ২৭তম জলবায়ু সম্মেলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশ্ব তাকিয়ে থাকবে বিশ্ব নেতাদের দিকে যে তারা পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী করার জন্য কি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তা দেখারা জন্য। যদি তারা এবারও ব্যর্থতার পরিচয় দেন বা অসহযোগীতামূলক মনোভাব প্রদর্শন করেন তাহলে পৃথিবীর অস্তিত্ত্ব মূলত আরও বেশি সংকটাপন্ন অবস্থায় চলে যাবে। যেখান থেকে ফিরে আসা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে। এক কথায় বলা যায়, ব্যর্থ হলে পৃথিবী নামক এই গ্রহের ধ্বংস অনিবার্য। তখন হয়তো বিলুপ্তি খাতায় মানুষের নামও উঠে যাবে।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিষ্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি