জননেতা আমির হোসেন আমু: আন্দোলন-সংগ্রামের সাহসী প্রেরণা
১৫ নভেম্বর ২০২২ ১১:১০
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জীবন্ত ইতিহাসের সাক্ষী ও ছাত্রজীবন থেকে নানা সংগ্রামে, ঘাত-প্রতিঘাতে গড়ে ওঠা কিংবদন্তী এক জননেতার নাম আমির হোসেন আমু। প্রজ্ঞা আর সাহসিকতায় অনবদ্য নেতৃত্ব দিয়ে তিনি ছাত্র জীবনেই পেয়েছেন বঙ্গবন্ধুর স্নেহ ও ভালোবাসা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্তের উত্তরসূরি, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে দলের নেতৃত্বে আনা থেকে তার নেতৃত্বের প্রতিষ্ঠায় বিশ্বস্ত সহচরের ভূমিকা পালন করেছেন আমির হোসেন আমু। জীবনের বাঁকে-বাঁকে জেল নির্যাতন সহ্য করে, আন্দোলন-সংগ্রামে অসীম সাহসিকতায় নিজেকে পরিণত করেছেন রাজনীতির মহীরুহতে। ছাত্রনেতা থেকে যুবনেতা, যুবনেতা থেকে আওয়ামী লীগের নেতা হয়ে আজ তিনি জননেতা। অনেক নেতার ভাষায় তিনি নেতার নেতা।
স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের দাপুটে নেতা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সর্বাপেক্ষা বিশ্বস্ত আমির হোসেন আমুকে বলা হতো মিস্টার ডিসিশন। এমন এক সময় গেছে তার ঢাকাস্থ ৪২ নিউ ইস্কাটনের বাসা ছিল আওয়ামী লীগের অঘোষিত উপ-কার্যালয়। জাতীয় রাজনীতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসতো রাজনীতির এই কিং মেকার আমির হোসেন আমুর এই বাসায় মিটিং করার পর।
মূলত ৭৫ পরবর্তী সময়ে ৮০ দশকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে কিং মেকার হয়ে উঠেছিলেন আমির হোসেন আমু। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সবচেয়ে বিশ্বস্ত হওয়ার কারণে তার যে কোনো সিদ্ধান্ত গুরুত্ব পেতো দলীয় ফোরামে। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে নীতি নির্ধারণী ফোরামে প্রবীণ নেতাদের এমন যে কোন সিদ্ধান্তের বিরূদ্ধে সব সময় প্রতিবাদী ও সোচ্চার ছিলেন তিনি। আমির হোসেন আমু ছিলেন নেতা বানানোর কারিগর। শুধু আওয়ামী লীগের নয়, ছাত্র লীগের নেতৃত্ব নির্বাচনেও তার পছন্দকেই অধিকতর গুরুত্ব দিতেন শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী নেতা আমির হোসেন আমু একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের একাধিক জেলা ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বরিশাল ও ঝালকাঠি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি থাকাকালীন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও আওয়ামী-যুবলীগের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
আওয়ামী-যুবলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। ১৯৫৮-১৯৬১ বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের আহবায়ক এবং ১৯৬২-১৯৬৪ পর্যন্ত বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি থাকাকালীনই পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৩ ও ১৯৬৪ সালে পরপর দু’বার বরিশাল বিএম কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হওয়ায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের রাজনীতির শীর্ষ নেতৃত্বের আলোচনায় স্থান পায় তার নাম।
আন্দোলন-সংগ্রামে পোড় খাওয়া এই নেতা ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচারে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে কারাবরণ করেন। তিনি ১৯৫৯ সালে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ভাষা দিবস উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক মনোনীত হন। ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণ আন্দোলন, স্বেরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনসহ এদেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতাকর্মীদের সাহস আর অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন আমির হোসেন আমু। ছিলেন মিছিল আর নেতৃত্বের প্রথম কাতারে।
১৯৪১ সালে ১৫ নভেম্বর ঝালকাঠির এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৬৫ সালে বরিশাল বিএম কলেজ থেকে বিএ এবং ১৯৬৮ সালে বরিশাল আইন মহাবিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।
আমির হোসেন আমু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর পাঠ শেষ করে আইন পেশার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের জাতীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ এর আগে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা ছিল তার। ১৯৬৫ সালে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক ও ১৯৬৭ সালে কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। যখন ছয় দফাভিত্তিক আন্দোলন চাঙ্গা হয়ে উঠছিল। বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি ছাত্রলীগেরও সাবেক অনেক নেতা কারাগারে। ১৯৬৮ সালে ছাত্রলীগের সম্মেলনকে ঘিরে শেখ মনি-সিরাজুল আলম খান গ্রুপ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে মুখোমুখি অবস্থান গ্রহণ করলে সরাসরি নেতৃত্ব নির্বাচনের বিষয়টি ভোটে দেয়া হয়।
ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাকের ভাষ্যমতে, আমির হোসেন আমুই সভাপতি পদে জয়ী হতো যদি তিনি এবং মনি ভাই (শেখ ফজলুল হক মনি) কারাগারে না থাকতেন। আব্দুর রউফের কাছে মাত্র তিন ভোটে হেরে যান প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে খ্যাত বিএম কলেজের ছাত্র রাজনীতি থেকে গড়ে ওঠা এই তরুণ ছাত্রনেতা।
উদ্যমী আমির হোসেন আমু থেমে থাকার মানুষ নন। পরবর্তী রাজনীতিতে সেটাই ফুটে উঠে। তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বরিশাল কোতোয়ালি আসনে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। মুজিব বাহিনীর আঞ্চলিক প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন বৃহত্তর বরিশাল, খুলনা, যশোর ও ফরিদপুর জেলার।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এ সংগঠক আমির হোসেন আমু ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদের নির্বাচনে বরিশাল কোতোয়ালির আসনের স্থলে ঝালকাঠি-রাজাপুর আসনে থেকে নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে ঝালকাঠি জেলার গর্ভনর ও ঝালকাঠি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর আমির হোসেন আমুকেও গ্রেফতার করা হয়। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত কারাগারে কাটান তিনি। সহ্য করেন অনেক অমানুষিক নির্যাতন। কারামুক্ত হয়েই আওয়ামী-যুবলীগের চেয়ারম্যান এবং আওয়ামী লীগের যুব সম্পাদক নির্বাচিত হন।
যুবলীগের চেয়ারম্যান থাকাকালীন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে প্রথম বিবৃতি দেন আমির হোসেন আমু। এর সপক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে তার নির্দেশনায় যুবলীগ নানা প্রতিকূলতার মধ্যে লিফলেট বিতরণ করে।
বাংলাদেশ আওয়ামী-যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মণি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটে নিহত হলে স্বভাবতই বাধাপ্রাপ্ত হয় যুবলীগ। এ সময়ে সংগঠনটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আমির হোসেন আমু যুবলীগকে সারাদেশে একটি শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত করতে রাখেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের রূপকার বলা হয় তাকে। তিনি ১৯৮১ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক এবং এরপর ২০০৯ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৯৯ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী ঐতিহ্যবাহী সংগঠন গণমানুষের দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৫০ বছর- সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দলটির এই প্রবীণ নেতা।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন মেয়াদে ভূমি, খাদ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে সফলতা ও সততার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন আমির হোসেন আমু।
২০২০ সালে করোনা সংক্রমণকালে ১৪ দলের মুখপাত্র জননেতা মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুর পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্রের দায়িত্ব পান আমির হোসেন আমু।
মুক্তিযুদ্ধের বীর সংগঠক ও মুজিব বাহিনীর অন্যতম আমির হোসেন আমু একজন আপাদমস্তক রাজনীতিবিদের চরিত্রই ধারণ ও লালন করেন। ভোগ-বিলাসহীন গণমুখী চরিত্রই তাকে জননেতায় পরিণত করেছেন। করোনাকালে নিজ জেলার মানুষের নিয়মিত খোঁজ-খবর রেখেছেন, বাড়িয়ে দিয়েছেন সহায়তার হাত। এই বয়সেও প্রতি মাসে কমপক্ষে দুই দফায় চার/পাঁচ দিনের কর্মসূচি নিয়ে এলাকায় ছুটে যান। বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের পাশাপাশি ৫ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া নিজ নির্বাচনী এলাকা ঝালকাঠি-নলছিটির নেতাকর্মীদের সাথে সময় কাটান। এই কর্মীবান্ধব চরিত্র তাকে যেমন জনপ্রিয়তা দিয়েছে, তেমনি প্রখর চিন্তাশক্তি ও দূরদর্শীতায় তিনি আলোকিত করেছেন রাজনৈতিক অঙ্গনকে। একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হলেও রাজনৈতিক জীবনে সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক আমির হোসেন আমু। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তার বক্তব্যে ও ব্যক্তিজীবনের আচার-আচরণে। নেতৃত্ব নির্বাচনে যোগ্যতাকে সব সময় গুরুত্ব দেন তিনি। স্থানীয় অনেক নেতার বিরোধিতার পরেও অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতিকৃতি আমির হোসেন আমু আজ থেকে ২২ বছর আগে ২০০০ সালে ঝালকাঠি সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে আমাকে ভিপি মনোনয়ন দিয়েছিলেন। সেই থেকে তার রাজনৈতিক প্রেমে পড়া আমার। এ এক অন্যরকম ভালোবাসা, যা আজ পরিণত হয়েছে অনেকটা পিতা-পুত্রের সম্পর্কের মতো। শুধু আমার বেলাতেই নয়, হাজারো নেতাকর্মী একবার যে আমির হোসেন আমুকে বুঝতে পেরেছে, জানতে পেরেছে, পেয়েছে তার ভালোবাসা, স্নেহ ও শাসন। জননেতা আমির হোসেন আমু সম্পর্কে তাদের প্রতিক্রিয়া হয়তো আমারই মতো হবে।
ব্যক্তিজীবন স্বল্পভাষী আমির হোসেন আমুকে বাইরের রূপে অনেক গম্ভীর মনে হলেও ভেতরটা দারুণ আন্তরিকতায় পরিপূর্ণ। বাহ্যিকভাবে তিনি যতটা কঠিন, ভিতরে তার পুরোপুরি উল্টো। আবেগের বশবর্তী না হয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন আমির হোসেন আমু। যখনই কোনো সংকট দেখা দেয় কিংবা স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠে তাদের প্রতিরোধে নিজের বয়স ও স্বাস্থ্যের কথা না ভেবে রাজপথে আগের মতে সক্রিয় হয়ে উঠেন আওয়ামী লীগের এই প্রবীণ নেতা। তার দিক-নির্দেশনামূলক সাহসী বক্তব্য আগামী দিনের আন্দোলন-সংগ্রামের প্রেরণা হোক এই প্রত্যাশায় শুভ জন্মদিনে শ্রদ্ধাভাজন পিতৃতুল্য জননেতা আমির হোসেন আমু’র জন্য নিরন্তর শুভকামনা। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অবিরাম।
লেখক: ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ সভাপতি ও বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
জননেতা আমির হোসেন আমু: আন্দোলন-সংগ্রামের সাহসী প্রেরণা মানিক লাল ঘোষ মুক্তমত