Wednesday 27 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘টেক ব্যাক’ নাকি ‘গো এহেড’— কোন পথে যাবে বাংলাদেশ?

এস এম রাকিব সিরাজী
১৫ নভেম্বর ২০২২ ১৬:৫৪

এক সময়ের দারিদ্রপীড়িত, দুর্নীতিতে টানা পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন কোনো একটি দেশের সেই সময়ের শাসকগোষ্ঠী যখন পুনরায় দেশটির ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্য স্লোগান দেয় ‘টেক ব্যাক বাংলাদেশ’, তখন দেশের নাগরিক হিসেবে বিশেষ করে তারুণ্যে উজ্জীবিত নতুন প্রজন্মের নৈতিক দায়িত্ব হয় যে, দেশের দায়ভার তাদের হাতে তুলে দেওয়ার আগে অন্তত একবার তাদের এজেন্ডাটি পরখ করে দেখা।

তরুণ প্রজন্মের নৈতিক দায়িত্ব হয় খোঁজ নিয়ে দেখা যে, বিএনপি-তারেক রহমান গংরা যে বাংলাদেশকে ব্যাকে (অতীতে) ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন, বাংলাদেশের সেই ব্যাক বা অতীতটি কেমন ছিল?

বিজ্ঞাপন

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা যখন আজ অনুন্নত দেশের তালিকা থেকে নিজেদের তুলে এনেছে উন্নয়নশীল দেশে এবং ধারাবাহিকভাবে উন্নত দেশের পথে দৌড়াচ্ছে; তখন তরুণ প্রজন্মের কাছে প্রশ্ন জাগে ওরা দেশকে পেছনে কেন নিয়ে যেতে চায়? পেছনের ইতিহাসটা তবে কী?

দেশের মানুষের কাছে এ পর্যায়ে যখন অতিদারিদ্র-অনাহার কেবলই অতীত; দুর্যোগপূর্ণ ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের ব-দ্বীপে যখন আজ পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, শত শত মহাসড়ক, পাতাল সড়কের মতো অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো দৃশ্যত বাস্তব— ঠিক তখনই দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া তারেক রহমান ও তার দল বিএনপি দেশকে এমন কি দিতে চায় যা তারা অতীতে দিয়েছিল?

আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে— তবে কি তারেক রহমানরা আবারো হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টানদের সংখ্যালঘু আখ্যা দিয়ে নির্যাতন করে দেশ ছাড়া করতে চায়? তবে কি তারেক রহমানরা শেখ হাসিনার একদিনে একসঙ্গে ১০০ সেতু উদ্বোধনের পরিবর্তে একদিনে একসঙ্গে ৬৩টি জেলায় বোমা ফাটিয়ে জঙ্গিবাদকে লালনের রাষ্ট্রীয় উৎসব করতে চায়? তারেক রহমানরা কি ‘তুমি কে আমি কে? বাঙালি বাঙালি’; ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’র পরিবর্তে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে দিয়ে ‘আমরা হবো তালেবান, বাংলা হবে আফগান’ স্লোগান দেওয়াতে চায় আবারো?

বিজ্ঞাপন

টেক ব্যাক বাংলাদেশের নামে তারেক রহমান কি তবে পুনরায় ১০ ট্রাক অস্ত্র ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে তুলে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু প্রতিবেশী এই রাষ্ট্রটির অখণ্ডতাকে খণ্ড খণ্ড করে বাংলাদেশকে বিপদে ফেলতে চায়? বিসিএসসহ চাকরির পরীক্ষাগুলোতে যখন সম্পূর্ণ স্বচ্ছতার ভিত্তিতে তরুণদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তখন এই চাকরিপ্রত্যাশী লাখ লাখ তরুণ কি আবারো ‘বিসিএস ক্যাডার’ হওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে ‘ছাত্রদলক্যাডার’ হওয়ার যুগে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ? এমপি আহসানুল্লাহ মাস্টার, শাহ এ এম এস কিবরিয়া, মঞ্জুরুল ইমাম, স্বপন জোয়ারদারদের মতো মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের লোকদের আবারো দিনে-দুপুরে প্রকাশ্যে গুলি করে মারার জন্যই কি টেকব্যাক চায় তারেক রহমান ? অপারাশেন ক্লিন হার্টের নামে বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে নির্যাতনের মাধ্যমে পঙ্গু করে দিতে চায়? বিএনপির শাসনামলকে বিশ্লেষণ করে নতুন প্রজন্ম খুব গভীরভাবে জানতে চায়, টেক ব্যাক বাংলাদেশ স্লোগানের অন্তর্নিহিত অর্থ আসলে কী!

২০০১-২০০৬ সালের বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলকে যে কোনো দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেই বোঝা যায় বিএনপি ও দুর্নীতি যেন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ । যদিও সেসময় দুর্নীতি সূচকে বাংলাদেশের ঈর্ষনীয় অগ্রগতির(!) দুঃসংবাদ দেশের সংবাদ মাধ্যমে প্রচারের সুযোগ খুব একটা দেয়নি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য বিদেশীদের কাছে নালিশ করা পার্টি বিএনপি ।

বিএনপির পরিবারতান্ত্রিক কাঠামোবদ্ধ দুর্নীতির উদাহরণ হয়ে এখনো টিকে আছে আরাফাত রহমান কোকোর সিমেন্সের দুর্নীতি , তারেক রহমানের হাওয়া ভবনের নামে দুর্নীতি উৎসব ভবন। যেখানে সিমেন্স গ্রুপের পক্ষ থেকে তৎকালীন সরকার প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে ঘুষ প্রদানের বিষয়ে স্বীকারোক্তি পাওয়া যায়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালে বিভিন্ন সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে মার্কিন বিচার বিভাগ কোকোর কয়েকটি ব্যাংক হিসাব উল্লেখ করে বাজেয়াপ্ত করার জন্য মামলা করে। এই ব্যাংক হিসাবগুলোতে অভিযোগ অনুযায়ী কোকোর সিমেন্স এবং চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কাছ থেকে ঘুষ বাবদ নেওয়া ৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার গচ্ছিত ছিল। পরবর্তীতে সেখানের বেশ কিছু টাকা বাজেয়াপ্তও করা হয়। আর জিয়াতন্ত্রের দুর্নীতি সবচেয়ে বড় মাস্টারমাইন্ড হিসেবে উইকিলিকসে বিশ্বের সাড়া জাগানো দুর্নীতিবাজদের পাশে উঠে আসে তারেক রহমানের নাম।

তারেক রহমানের মানি লন্ডারিং-এর ফিরিস্তি পাওয়া যায় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে। সেখানে উঠে আসে তারেক ও তার সহযোগী গিয়াস উদ্দিন আল-মামুনের সিঙ্গাপুরের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নির্মাণ কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের পরিচালক এবং চীনের হারবিন ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশনের এক দেশীয় প্রতিনিধির কাছ থেকে টঙ্গীতে ৮০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের টেন্ডার পাওয়ার জন্য প্রায় সাড়ে ৭ লাখ মার্কিন ডলার ঘুষ নিয়েছিল। সাড়া জাগানো আরও একটি দুর্নীতি মামলার অন্যতম নাইকো দুর্নীতি মামলা। যেখানে তৎকালীন সরকারের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যায়– ‘নাইকো বাংলাদেশ থেকে তাদের ঠিক করা দামে গ্যাস কিনতে পারবে, তা বিক্রি করতে পারবে’ এই শর্ত বাস্তবায়নের বিনিময়ে কানাডিয়ান ১ লাখ ৯০ হাজার ৯৮৪ ডলারের একটি গাড়ি হাতিয়ে নিয়েছিলেন মন্ত্রী। আর এর পাশাপাশি সচরাচর আলোচিত জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি, খাম্বা-কাণ্ড, বড়পুকুরিয়া দুর্নীতি কিংবা গ্যাটকো দুর্নীতির মতো ঘটনাগুলোতো আছেই।

এখন প্রশ্ন হলো কী বিশ্বাসের বলে তরুণ প্রজন্ম আবার দুর্নীতি ব্যবসায়ীদের হাতে দেশকে তুলে দিবে? দেশকে এই “সেবা”(!) করার বদলে আর কি-ই বা করার যোগ্যতা আছে তাদের? করোনার মধ্যে ভঙ্গুর বিশ্ব অর্থনীতিতে জিডিপির সচল চাকা, দারিদ্র দূরীকরণের চাক্ষুষ একের পর এক দৃষ্টান্ত আর দেশের কোনায় কোনায় শতভাগ বিদ্যুতায়নের বিকল্প হিসেবে তবে কেন তরুণ প্রজন্ম আবার পাতালপুরে ফিরে যেতে চাইবে?

ক্ষমতা থেকে বিচ্যুত হয়ে বিএনপির কী ও কেমন গুণগত পরিবর্তন এসেছে তরুণ প্রজন্ম তাও দেখেছে তাদের ২০০৯ পরবর্তী আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে। গদি টিকিয়ে রাখতে ব্যবহার করা ধর্মভীরু জনতার আবেগ বিক্রির পুরনো অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে একেরে পর এক সমর্থন যোগাতে দেখা যায় শাপলা তাণ্ডবের মতো আন্দোলনগুলোতে। আন্দোলনের নামে অগ্নিসন্ত্রাস করে কত শত মানুষের জীবনকে থামিয়ে দিয়েছে শুধুমাত্র ক্ষমতায় গিয়ে দুর্নীতি করার জন্য । এসবকিছু বিশ্লেষণ করলে পরিষ্কার হয়ে যায় শাইখ আবদুর রহমান ও বাংলা ভাইদের উত্থানের পেছনের কলকাঠি। ক্ষমতায় থাকাকালীন ‘জজ মিয়া নাটক’ সাজিয়ে বিরোধী দলকে বিশেষ করে বাংলাদেশের শেখ পরিবারকে সমূলে ঘায়েলের চেষ্টায় মগ্ন থাকা দলটি রাতারাতি দেশের স্বাধীনতা সর্বোভৌমত্বের তোয়াক্কা না করে “গণতন্ত্র”-এর বুলি আওড়িয়ে বেড়ায় দূতাবাসে দূতাবাসে। আর আন্দোলনের সবচেয়ে দৃশ্যত দিক হয়ে দাঁড়ায় ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচার চলাকালে তাদের বিরোধিতা, ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন প্রতিরোধ করতে কোরআন শরিফ পুড়ানো, ২০১৫ সালে বেগম জিয়া ঘোষিত “অবরোধ কর্মসূচি”-এর নামে জামায়াত-বিএনপির সশস্ত্র বাহিনীর দেশব্যাপী চালানো অগ্নিসন্ত্রাস ইত্যাদি।

কোমলমতি স্কুলগামী শিশু থেকে শুরু করে শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ এ সময় সারা দেশে প্রায় দেড় শতাধিক মানুষ নিহত হয়। সামনে আসে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াসহ শীর্ষ নেতাদের টেলিফোনযোগে বিএনপি-জামাত নেতাকর্মীদের মানুষ হত্যার নির্দেশনার রেকর্ড। টানা ১৩ বছরের বেশি সময় বিরোধী দলে থেকে অগ্নিসন্ত্রাস, স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতি, আর উগ্রবাদীদের উস্কানি দিয়ে ক্ষমতায় আসতে চাওয়া দলটিকে আমরা তরুণ প্রজন্ম ঠিক কী কারণে চাইব— এর পক্ষে যৌক্তিক কোনো বক্তব্য আমাদের কাছে নেই।

একটি দেশকে এগিয়ে যেতে হলে জনসাধারণের সামনে একটি স্বপ্ন ও একটি মডেল থাকা জরুরি। বর্তমানে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের স্বপ্ন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’। যেখানে একটি আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে থাকবে না দুর্নীতি, অবিচার, অশিক্ষা, রক্ষণশীলতা, ক্ষুধা ও দারিদ্র। আর বাস্তবিক মডেল হিসেবে সামনে হাজির হয়েছে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’। যেখানে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ আর গ্রামের স্কুলগুলোতে পর্যন্ত মাল্টিমিডিয়া সেবা পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে জানান দিয়েছি—চাইলে আমরাও পারি । অতএব এখন এদেশের তরুণদের সামনে পথ পরিষ্কার। তারা দুর্নীতি, উগ্রবাদ, দরিদ্র আর পশ্চাৎপদতায় পর্যুদস্ত কোনো দেশে ফিরে যেতে চায় না। এদেশের তরুণদের চোখে মুখে বুকে এখন শুধুই এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। তাই ‘টেক ব্যাক’ নয়; শত-সহস্র তারুণ্যের উদ্দীপ্ত স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’—বিনির্মাণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য তনয়া দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তরুণ প্রজন্মের স্লোগান এখন ‘গো এহেড বাংলাদেশ’।

লেখক: সহসম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ
বিতার্কিক ও সাবেক সভাপতি, ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর