বিশ্বকাপ ফুটবল: আবেগ ভালো, আতিশয্য নয়
১৬ নভেম্বর ২০২২ ১৩:৫৩
আর মাত্র কয়েকদিন পরেই শুরু হতে যাচ্ছে ফুটবল বিশ্বকাপ। কয়েকদিন দেরি থাকলেও চারপাশের অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে খেলা শুরু হয়ে গেছে। ফুটবল নিয়ে বিশ্বজুড়ে আবেগের অন্ত নেই। সেই আবেগ সম্ভবত বাঙালি মুলুকেই বেশি। এমন সব ঘটনা ঘটে যে হাসি থেকে তা রীতিমতো কান্নার কারণ হয়। সেই আবেগের বাড়াবাড়ি মাত্রাতিরিক্ত। প্রিয় দলের বিশেষত আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের খেলা হলে পিকনিকের আমেজ তৈরি হয়। আবার কখনো উভয় পক্ষের সমর্থকরা মুখোমুখি অবস্থানেও থাকেন। আবার কেউ কারও মুখ দর্শনও করেন না! অবশ্য খেলা শেষ হলেই এই উন্মাদনার শেষ হয়! এই উন্মাদনা আমাদের এ উপমহাদেশে তৈরি হয়েছে মূলত দুই কিংবদন্তীর খেলাকে কেন্দ্র করে। আর্জেন্টিনার দিয়েগো ম্যারাডোনা এবং ব্রাজিলের পেলে যিনি কালো মানিক নামে পরিচিত। এই দুই খেলোয়াড় ফুটবলকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। কে শতাব্দির সেরা খেলোয়াড় তা নিয়ে বিতর্ক আজও থামেনি। ম্যারাডোনার ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে করা সেই নান্দনিক গোল সমর্থকদের কাছে আজও স্মরণীয়। আবার পেলের খেলাও দুর্দান্ত। আবার হালের মেসি বা নেইমার বিতর্কও একভাবে চলছে। তা চলুক। তবে এসব বিতর্ক যেন খেলার মাঝেই সিমাবদ্ধ থাকে, ব্যক্তিগত আক্রমণে না যায়। আমাদের বোঝা উচিত এটা বিনোদনের জন্য, কাউকে আঘাত করার জন্য না। খেলা এখনও শুরু হয়নি অথচ সমর্থকদের কথার বাগবিতন্ডা শুরু হয়ে গেছে। ফেসবুকে তো রীতিমতো একদলের সমর্থক অন্যদলের সমর্থকদের নিয়ে নানা ধরনের স্ট্যাটাস দিচ্ছে। আমাদের সেই বাড়াবাড়িতে মারামারি পর্যন্ত ঘটে। এমনটা কাম্য নয়। অল্প কয়েকদিনের আবেগ দিয়ে কারও ক্ষতি যেন না হয়। এশিয়ার বাইরের দেশে এমন সমর্থন হয় কি না জানা নেই। বিশ্বজুড়ে উন্মাদনার নাম ফুটবল। ইতিমধ্যেই গ্রামেগঞ্জে আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের পতাকায় ছেয়ে গেছে। রীতিমতো পতাকা টাঙানোর প্রতিযোগীতা শুরু হয়েছে। কোন দলের সমর্থকরা কত বড় পতাকা বানাবে সেই প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। জমি বিক্রি করেও বিশালাকার পতাকা তৈরি হচ্ছে! এসব বাড়াবাড়ি একটু আশ্চর্যই বটে!
অনেকে বলবেন এসবই আবেগ। আবেগ থাকা ভালো কিন্তু আবেগে এমন কোনো কাজ করা উচিত নয় যা ক্ষতির কারণ হতে পারে। বিয়ে বাড়ির প্যান্ডেল সাজছে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের পতাকায়। একজন দেখলাম লাখ লাখ টাকা খরচ করে কোরিয়ার পতাকা তৈরি করেছে। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্যি এদের অনেকেই দেশের পতাকাটা কোনোদিন আবেগ নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেনি। অনেকেই জাতীয় পতাকার সঠিক ব্যবহারও জানে না। পতাকা নিয়ে সেভাবে আগ্রহও নেই। এই পতাকা পাওয়ার জন্যই কিন্তু একদিন পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরেছিল। বিদেশের পতাকা নিয়ে ঝাপাঝাপির জন্য না! নিজের পতাকাট একদিন বুকের মাঝে নিয়ে দেখবেন এর চেয়ে অনেক বেশি শান্তি লাগছে। জার্সিপাড়া এখন ব্যাপক ব্যস্ত। পৃথিবীতে যত ধরনের খেলাধুলা রয়েছে তার মধ্যে ফুটবলই একমাত্র খেলা যা অধিকাংশ দেশেই জনপ্রিয় খেলার তালিকায়। মূলত অল্প সময়,খেলার ধরন,গ্রহণযোগ্যতা, নান্দনিকতা, খেলার গতি প্রভৃতি কারণে ফুটবলের সমান জনপ্রিয় খেলা নেই। যদিও এ উপমহাদেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা গত কয়েক দশক ধরে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে কয়েকটি দেশের মধ্যেই তা সিমাবদ্ধ। কিন্তু ফুটবল আছে প্রতিটি দেশে। আমাদের দেশেও ফুটবল খেলা আছে তবে তার উজ¦লতা অনেকটা নিভু নিভু করছে। ১৯৩০ সালে এই প্রতিযোগীতা উরুগুয়েতে শুরু হয়ে আজ পর্যন্ত একইভাবে জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে। ফুটবলের জন্মদাতা দেশ ইংল্যান্ড।
প্রতি চার বছর পর পর ভিন্ন ভিন্ন দেশে এই খেলা অনুষ্ঠিত হয়। খেলার সময়,গতি এবং প্রকৃতির কারণেই এই খেলা বিশ্বব্যাপী তুমুল জনপ্রিয়। শুরু হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনো আসর বাদ যায়নি। কেবলমাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯৪২ সালের ও ১৯৪৬ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়নি। জাতি, ধর্ম, বর্ণ সব পার করে এই খেলা সবার মাঝে সমান উন্মাদনা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। আন্তর্জাতিক ফুটবল সংস্থা (ফিফা) এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে। ফুটবলই একমাত্র খেলা যা প্রায় প্রতিটি দেশেই খেলা হয়। বাংলাদেশের ফুটবলেও একসময় রমরমা অবস্থা ছিল। এখানেও আবাহনী এবং মহামেডানের সমর্থকরা দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। এই দুই দলের খেলা থাকলে সেদিন বিশ্বকাপের আমেজ পাওয়া যেতো। যদিও দেশের ফুটবলের সেই দিন এখন আর নেই। যাই হোক, এখন বাড়িতে বাড়িতে উড়তে দেখা যাবে আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিলের পতাকা। অন্যদেশের পতাকাও থাকে। জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড এবং অন্যান্য দেশেরও পতাকা থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা তৈরি হয় মূলত আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিল সমর্থকদের মধ্যে। মাঝে মধ্যেই এই দুই দেশের সমর্থকদের মধ্যে হাতাহাতি, মারামারি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায়। পত্রিকা, টেলিভিশনের শিরোনাম হয়। যদিও এসব হয় আবেগ থেকে কিন্তু অতি আবেগে ভাসা কোনো ভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। ফুটবল নিয়ে আবেগ ভালো, তবে আবেগের আতিশয্য ভালো না। সেসব দেখে চলাই উত্তম।
লেখক: কলামিষ্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি