Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শিশু নির্যাতন: ‘জাতির ভবিষ্যৎ’ সুরক্ষায় কেউ কি ভাবছে?

ইমরান ইমন
২৬ নভেম্বর ২০২২ ১৩:৪৯

বর্তমানে দেশে শিশু নির্যাতন উদ্বেগজনক মাত্রায় পৌঁছেছে। শিশু নির্যাতনের ঘটনাকে তাই প্রায় গণমাধ্যমের খবর হতে দেখা যায়। সম্প্রতি চট্টগ্রামে সাত বছরের ছোট্ট একটি শিশুকে ছয় টুকরো করে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনা মানুষকে মর্মাহত করেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, শিশুরা অপরিচিত ব্যক্তিদের চেয়ে পরিচিতদের দ্বারাই বেশি নির্যাতিত হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ ঘটনাগুলো অপ্রকাশিত থেকে যায়। লোকলজ্জা ও সামাজিকতার কারণে বিষয়গুলো পরিবারের মধ্যেই মিটমাট করে ফেলার চেষ্টা করা হয়।

বিজ্ঞাপন

গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের ৮৪ শতাংশ শিশু পারিবারিক গণ্ডিতে ধর্ষণ থেকে শুরু করে অনাকাঙ্ক্ষিত শারীরিক স্পর্শসহ নানা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে থাকে। এসব নির্যাতন বন্ধে দেশে ইতিবাচক আইন ও নীতিমালাও আছে। কিন্তু আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও সচেতনতার অভাবে এখনো দেশে শিশু নির্যাতনের পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক।

জাতিসংঘ শিশু সনদ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সী সবাই শিশু। সে অনুযায়ী দেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশই শিশু। প্রবাদ প্রচলিত আছে, আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাই এই ভবিষ্যৎ কর্ণধারদের সুরক্ষা খুবই জরুরি।

প্রতিবছর শত শত শিশু নানাভাবে নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হচ্ছে। শিশুরা ঘরে বাইরে কোথাও নিরাপদ নয়। নিম্ন, মধ্য বা উচ্চবিত্ত কোনো শ্রেণির শিশুই নিজের ঘর, বাহির বা বিদ্যালয়ে নিরাপদ নয়।

শিশুরা নানা রকম নির্যাতন শিকার হয়। বিশেষ করে শিশুদের প্রতি শারীরিক ও মানসিক সহিংসতা, শিশুবিবাহ, শিশুমাতৃত্ব ও যৌন হয়রানির ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। শিশুদের প্রতি যৌন হয়রানির ঘটনা সবচেয়ে বেশি ভয়াবহ। দেখা গেছে, নির্যাতিত শিশুরা পরবর্তী জীবনে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভোগে। কেউ কেউ নিপীড়কও হয়ে ওঠে। দেশে শুধু মেয়েশিশুই যৌন নির্যাতনের শিকার হয় এমন নয়; আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে পুরুষশিশু যৌন নির্যাতনের ঘটনাও। আবার যৌন নির্যাতক কেবল পুরুষ নয়, নারীও হতে পারেন যৌন নির্যাতক।

অন্যদিকে শিশুবিবাহের ফলে শুধু ওই শিশু একা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রসহ সকলেই। যে শিশু তার পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্পদে পরিণত হতে পারত, শিশুবিবাহের ফলে তা ব্যাহত হচ্ছে। কাজেই শুধু শিশুদের জন্য নয়, রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে শিশু নির্যাতন বন্ধ করা একান্ত জরুরি।

বিজ্ঞাপন

দেশে দারিদ্র্য আছে, তবে এটি একমাত্র সমস্যা নয়। সে ক্ষেত্রে দেশের ১০ লাখ পথশিশুর সমস্যাই বলে দেয়, এখানে অন্যান্য কারণও আছে। বিশেষ করে, পারিবারিক নির্যাতন একটা বড় সমস্যা, যা অনেক সময়ই পারিবারিক বন্ধন ভেঙে দেয়। ফলে অনেক শিশু তাদের পরিবার ছেড়ে পথে চলে আসে। বর্তমানে দেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ১৭ লাখের বেশি। তারা বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে তাদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতনের কথা। অনেক ক্ষেত্রে তাদের হত্যাও করা হয়। অথচ এসব শিশুর উন্নয়নে যথাযথ প্রকল্প গ্রহণপূর্বক বাস্তবায়ন করা হলে এরাই সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ উন্নয়নে কাজ করতে পারত। বলা চলে, শিশুদের অধিকার যদি বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে শিশুরা স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠবে না। এ অবস্থায় দেশও তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ করতে পারবে না।

২০২০-২১ সালে পরিচালিত ‘ইনসিডিন বাংলাদেশ’ নামের একটি বেসরকারি সংগঠনের জরিপ থেকে জানা যাচ্ছে, ৯৫ দশমিক ৮ শতাংশ শিশু নানাভাবে ঘরেই নির্যাতনের শিকার হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার হয় মা-বাবা ও অভিভাবকদের দ্বারা। আর এসব নিপীড়ন চালানো হয় নিয়মানুবর্তিতা শেখানোর অজুহাতে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের গবেষণা বলছে, শহর এলাকায় ৮৬ দশমিক ১ শতাংশ মা-বাবাই তাদের সন্তানকে শারীরিক নির্যাতন করেন, মানসিক নির্যাতন করেন ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। কর্মজীবী শিশুদের শতভাগই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়।

অন্য একটি গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গ্রামীণ এলাকার ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সের ৩৫ শতাংশ শিশু সাইবার জগতে উৎপীড়ন, উপহাস, গুজব কিংবা অপমানের শিকার হয়। ইন্টারনেটের মাধ্যমে যৌন নিপীড়নের শিকার হয় শহর ও গ্রামের নবম-দশম শ্রেণিতে পড়া ৫৬ শতাংশ কিশোর এবং ৬৪ শতাংশ কিশোরী।

এ তথ্যগুলো খুবই উদ্বেগের। বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি জনসংখ্যার ৪০ ভাগ, অর্থাৎ প্রায় ৬ কোটির মতো শিশু। বলা হয়ে থাকে, শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। নিপীড়ন-নির্যাতনের মধ্যে বেড়ে ওঠা এই ‘ভবিষ্যৎ’ কেমন হবে, সেটা সহজেই অনুমেয়।

শিশুদের সুরক্ষায় দেশে আইন থাকলেও শিশু নির্যাতনের কারণে সাধারণত মামলা হয় না; তাই বলা যায়, আইন সেভাবে শিশুদের সুরক্ষা দিতে পারছে না। শিশুদের জন্য জরুরি প্রয়োজন পরিবারের সদস্যদের সংবেদনশীলতা। শিশুদের প্রতি কেমন আচরণ করা উচিত, আর কেমন করা উচিত নয়, সে বিষয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

তাই সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে শিশুদের যথাযথ অধিকার, শিক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। এ লক্ষ্যে শিশুদের জীবনের মান উন্নয়নে অবৈতনিক শিক্ষার প্রচলন, উপবৃত্তি প্রবর্তন, বিনামূল্যে বই বিতরণ, নারী শিক্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন হচ্ছে। সরকার জাতীয় শিশুনীতি ও নারী উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন করেছে। গৃহীত এসব পদক্ষেপের ফলে বাল্যবিবাহ, নির্যাতন উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেলেও এখনো প্রত্যাশিত হারে কমেনি। তাই শিশুদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে নিরাপদ ও সুষ্ঠু পরিবেশ, মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা এবং নির্যাতন ও নিপীড়নমুক্ত সমাজব্যবস্থ্যা। সেই সঙ্গে শিশুর প্রতি আপনজনসহ সবাইকে মানবিক আচরণ করতে হবে পাশাপাশি শিশুর নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চায় বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। ঘরে বাইরে সব জায়গায় শিশুরা নিরাপদ থাকুক—এটাই প্রত্যাশা।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

ইমরান ইমন মুক্তমত শিশু নির্যাতন: ‘জাতির ভবিষ্যৎ’ সুরক্ষায় কেউ কি ভাবছে?

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

২৪ বলে ০ রানে জাকিরের লজ্জার রেকর্ড
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৫:১৮

সম্পর্কিত খবর