Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জিপিএ-৫ পাওয়া না পাওয়া এবং সমাজের মূল্যায়ন

ইমরান ইমন
২৯ নভেম্বর ২০২২ ১৩:৩৬

সম্প্রতি এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। যারা জিপিএ-৫ পেয়েছে তাদের অভিনন্দন। পাশাপাশি যারা জিপিএ-৫ না পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে তাদেরও অভিনন্দন। দেখা যায়, যারা জিপিএ-৫ পায়নি পরিবার থেকে আশপাশের পরিবেশ থেকে তাদের অনেক নিগৃহীত হতে হয়। এতে অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়—যা প্রতি বছরই পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর আমরা দেখে থাকি। তাই যারা জিপিএ-৫ পেয়েছে তাদের পাশাপাশি এবং যারা জিপিএ-৫ না পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে তাদেরও অভিনন্দন জানান। পরিবর্তন আসুক আমাদের অসুস্থ মানসিকতায়।

বিজ্ঞাপন

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায় যে, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর কাঙ্ক্ষিত রেজাল্ট না আসাতে অনেক শিক্ষার্থী জীবনের মায়া ভুলে গিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়, যা পত্রপত্রিকা বা সংবাদমাধ্যমে আমরা দেখতে পাই।

আজকে যারা জিপিএ-৫ পাওনি বলে হা-হুতাশ করছো, ওমুকে পেয়েছে আমি কেন পেলাম না! ওমুক-তমুকের সাথে নিজেকে তুলনা করে নিজেকে অযোগ্য ভাবছো, অনেকে আবার অতি আবেগপ্রবণ হয়ে আত্মহত্যার মতো মহাপাপের সিদ্ধান্ত নিচ্ছো তাদের জন্য বলি—জীবনে সফল হতে শুধু জিপিএ-৫ বা ভালো রেজাল্ট মুখ্য নয়। একটা পাবলিক পরীক্ষায়ও জিপিএ-৫ না পেয়ে তুমি জীবনে সফল মানুষদের কাতারে নিজের নাম লিখাতে পারবে। তোমার ভেতরে কী আছে, কতটুকু তুমি অর্জন করেছো সেটাই গুরুত্বপূর্ণ এবং দিনশেষে সেটাই তোমাকে সফলতার চূড়ায় নিয়ে যাবে।

কেবল দুই একটা পরীক্ষার রেজাল্ট তোমার জীবন নির্ধারণ করতে পারে না। পৃথিবীতে যারা আজ সফলতার চূড়ায় আরোহণ করেছেন তাদের জীবনী অনুসন্ধান করে দেখো, তাদের একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড ছিলো ব্যর্থতা আর গ্লানিতে পরিপূর্ণ। কিন্তু দিনশেষে তারা সফল।

কেননা তাঁরা ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তাদের মধ্যে ছিলো নিজের প্রতি প্রচন্ড বিশ্বাস, ছিলো কাজের প্রতি ভালোবাসা, সততা ও নিষ্ঠা। যারা নিজেকে চিনে নিতে পেরেছে, যাদের রয়েছে নিজের প্রতি প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস, সেই সাথে রয়েছে সততা ও নিষ্ঠা-দিনশেষে তারা সফলতা ছিনিয়ে আনবেই।

তোমার নিজের প্রতি যদি নিজের আত্মবিশ্বাস থাকে, কাজকে যদি তুমি ভালোবাসতে পারো, তোমার নিজের মধ্যে যদি সততা থাকে তাহলে বিশ্বাস করো পৃথিবীতে তোমাকে আর কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না। দিনশেষে তুমি সফলতার চূড়ায় পৌঁছে যাবাই।

বিজ্ঞাপন

আমার নিজের কথাই বলি—আমার কিন্তু এসএসসি ও এইচএসসি কোনটাতেই জিপিএ-৫ ছিলো না। জিপিএ-৫ পেতে পেতেই পাওয়া হলো না। আমার প্রতি আমার শিক্ষক, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবার আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিলো আমি অবশ্যই জিপিএ-৫ পাবো। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আমার জিপিএ-৫ জুটে নি বা হয়তো আমি যোগ্য ছিলাম না। কিন্তু জিপিএ-৫ না পাওয়াতে আমার কোনো আক্ষেপ ছিল না, আমি বিন্দুমাত্রও হতাশ হইনি।

পরীক্ষার রেজাল্টের পর আমাকে নিয়ে অনেকেই অনেক বিরূপ মন্তব্য, নেতিবাচক সমালোচনা করেছে। আমি দাঁতে দাঁত চেপে সেসব হজম করেছি। অনেক দিন লুকিয়ে লুকিয়ে বাথরুমে ঢুকে ঝর্ণা ছেড়ে দিয়ে কান্না করেছি। আত্মচিৎকার করেছি গড়িয়ে পড়া পানির সাথে।

তবুও হতাশ হইনি, দমিয়ে যাইনি। বরং হতাশাকে হতাশ করে দিয়ে আমি নিজের সাথে নিজে শপথ করেছি—সফল‌ আমি হবোই। নিজের প্রতি আমার ছিলো প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস। আমি নিজেকে চিনে নিয়েছি আসলে আমি কে! কতটুকু যোগ্যতা আমার রয়েছে। আমি জানতাম—’আমি পারবোই, আমি সফল হবোই’। হ্যাঁ, আমি এখন সফল‌। নিজের একনিষ্ঠ পরিশ্রম,সততা দিয়ে এক এক করে সব স্বপ্ন পূরণ করে নিচ্ছি।

আমার প্রতি যাদের বিশ্বাস ছিল,আশা আকাঙ্ক্ষা ছিলো সেসব মানুষদের আমি হতাশ করিনি।

কম সিজিপিএ নিয়ে, সমালোচনার তুমুল ঝড় ভেঙে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার মতো স্নায়ুযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মেধাবীকে ডিঙিয়ে, শীর্ষস্থান দখল করে আমি দেশের স্বায়ত্তশাসিত শীর্ষ একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, শীর্ষ একটা সাবজেক্ট নিয়ে পড়তে পেরেছি।

শুধু একাডেমিক পড়াশোনার গন্ডিতে আমার জীবন সীমাবদ্ধ নয়। স্কুলজীবন থেকেই আমি একাডেমিক পড়াশোনার বাইরে সব ধরনের এক্সট্রা-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজে এ দাপিয়ে বেড়িয়েছি। এখনও দাপিয়ে বেড়াচ্ছি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক সংগঠনের সাথে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছি।

লেখালেখি করে যাচ্ছি আপন গতিতে। কখনো সাহিত্য, কখনো সমাজ, কখনো বা দেশকে রাঙিয়ে তুলতে চেষ্টা করি লেখনিতে। দেশের শীর্ষ জাতীয় বাংলা এবং ইংরেজি দৈনিক পত্রিকাগুলোতে আমার লেখা হয় আলোচিত টপ অফ দ্যা কলাম। পত্রিকার সম্পাদকরা যখন বলেন—”তুমি বেশ ভালো লিখো, লেখার মান খুব ভালো। তোমার সময়ে তোমার ধারেকাছেও কেউ নেই। লেখালেখি চালিয়ে যাও, অনেক বড়ো হতে পারবে।” এখানেই জীবনের সফলতা নিহিত। এসব শুনে আমি উল্লাসিত হই না, অভিভূত হই। আমি শক্তি পাই, সাহস পাই।

জীবনের সার্থকতা এখানেই। এক জীবনে চাইলে মানুষ অনেক কিছু হতে পারে। দরকার শুধু কাজের প্রতি ভালোবাসা, সততা, একনিষ্ঠ পরিশ্রম আর লেগে থাকা। যারা বলেছিল তোমাকে দিয়ে হবে না, একসময় যারা তোমাকে অযোগ্য বলে তিরষ্কার করেছিল, মূল্য দেয়নি তাদেরকে কাজের মধ্য দিয়ে অবাক করে দিতে পারা—এটা পৃথিবীর সেরা সুইট রিভেঞ্জ, সেরা সফলতা।

আমার জিপিএ-৫ বিহীন অনেক বন্ধু-বান্ধবও দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, ভালো সাবজেক্ট নিয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছে। দেখিয়ে দিয়েছে নিজের যোগ্যতা। কই জিপিএ-৫ এর অভাবে বা জিপিএ-৫ না পাওয়াতে তাদের জীবন তো থেমে থাকেনি‌! দেখা গেছে, এমন ভুরি ভুরি জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই কোথাও চান্স পায়নি।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চান্স পাওয়া অধিকাংশ শিক্ষার্থীরই এসএসসি ও এইচএসসি কোনটাতেই জিপিএ-৫ থাকে না। জীবনে সফলতার চূড়ায় আরোহণ করতে হলে, সফলতার ছোঁয়া পেতে হলে জিপিএ-৫ মূখ্য বিষয় নয়। সামান্য দুই এক পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়ে একজন মানুষকে কখনোই বিচার করা যায় না, তার সম্পর্কে ধারনা নেওয়া যায় না। কিন্তু আমাদের অভিভাবকরা মেনে নিতে চায় না এ অমোঘ বাস্তবতা। তারা তাদের সন্তানকে ওমুক তমুকের সাথে তুলনা করে, রেজাল্ট নিয়ে মানসিক চাপের মুখে রাখে। ফলে অনেক শিক্ষার্থী ঘুরে দাঁড়ানোর মনোবল হারিয়ে ফেলে। অনেকে জীবনের মায়া হারিয়ে ফেলে চরম হতাশার অন্ধকারে ডুবে থাকে, বেঁচে নেয় আত্মহত্যার মতো জঘন্য পাপের।

আপনি একজন মা/বাবা? আপনার ছেলেমেয়ে তো আপনারই DNA! তারা সাইন্টিফিক্যালি আপনারই। কিন্তু যখন তাদের বলেন— ‘তোরে দিয়ে কিচ্ছু হবে না!” অজান্তেই—You are destroying your DNA!

অভিভাবকদের প্রতি অনুরোধ, সামান্য দুই এক পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়ে ছেলেমেয়েদের বিচার করবেন না, তাদের সুযোগ দিন এবং সঠিক পথে পরিচালিত করুন। আপনি বিশ্বাসও করতে পারবেন না— আপনার সন্তানের মাঝে হয়তো লুকিয়ে আছে আইনস্টাইন, নিউটন, শেক্সপিয়ার, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, স্টিভ জবস, ইলন মাস্ক ও মার্ক জাকারবার্গ।

কোনো মানুষই অযোগ্য নয়। প্রতিটা মানুষের মাঝেই রয়েছে অপার সম্ভাবনা। কেননা পৃথিবীতে মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। প্রতিটা মানুষই এক একটা হীরার খনি। দরকার শুধু সে খনি থেকে মনি মুক্তা বের করে আনার। প্রতিটা মানুষই আলাদা বিশেষগুণে গুণান্বিত। তাই নিজেকে চিনে, নিজের মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করে সততা ও নিষ্ঠার সাথে আপন পথে দৌড়াও। কেউ তোমাকে দমিয়ে রাখতে পারবে না। সফলতার পর্বত একদিন তুমি ছুঁবেই।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

ইমরান ইমন জিপিএ-৫ পাওয়া না পাওয়া এবং সমাজের মূল্যায়ন মুক্তমত

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

সিটিকে রুখে দিল নিউক্যাসেল
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২০:০৮

সম্পর্কিত খবর