সমাবেশে লোক বাড়ানোর রাজনীতি বনাম ভোটের রাজনীতি
১ ডিসেম্বর ২০২২ ১৫:৩৫
বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে রাজনীতির একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। নির্বাচন এলেই আমাদের রাজনীতির মাঠ গরম হয়। ২০২৩’এর শেষে কিংবা ২০২৪’এর শুরুতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা, সেই নির্বাচনকে ঘিরে এখনই রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় শুরু হয়েছে। শুরু হয়েছে সভা সমাবেশের রাজনীতি। চলছে সভা-সমাবেশে লোক সমাগমের প্রতিযোগীতা। বিএনপি তাদের সমাবেশে লোক বাড়ানোর ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়। তাদের জেলা এবং বিভাগীয় শহরে সমাবেশে শত বাধা পেরিয়ে বহু লোকের সমাগম ঘটাচ্ছেও। আওয়ামী লীগও তাদের শক্তি প্রদর্শণে বিভিন্ন সভা সমাবেশে লোক প্রদর্শনের প্রতিযোগীতায় নেমেছে।
কী দেখছি আমরা? জনগনও সকল দলের সভা সমাবেশেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। সভায় বেশি বেশি লোক দেখিয়ে ভোটের পাল্লা কার কতটা ভারি তা নির্ণয়েই হয়তো এ প্রতিযোগিতা। রাজনৈতিক শক্তির পার্থক্য কতটা? কার লোকবল বেশি, কার কত শক্তি তা দেখাতেই এখন দেশের রাজনৈতিক দলগুলো উঠে পরেও লেগেছে।
প্রশ্ন হলো যারা সমাবেশে আসছেন তারা সবাই কী ঐ দলকে সমর্থন করেন? কিংবা ওই দলের প্রতিকে ভোট দিয়ে তাদের জয়যুক্ত করবেন? আজকাল সমাবেশে লোকজন কিভাবে বাড়াতে হয় সে সক্ষমতা সব দলেরই আছে বোধ করি। কেন্দ্রীয় নেতারা নির্দেশ দেন- ‘সমাবেশে এত লোকের সমাগম চাই’। মাঠ পর্যায়ের নেতাদের নিদৃষ্ট হারে লোক আনার নির্দেশনা থাকে। নেতারাও নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখতে সভা সমাবেশে ভাড়ায় লোকজন আনে। পত্র-পত্রিকা, টিভি মিডিয়ায় সেসব হাস্যকর সংবাদ পরিবেশনও করা হয় দেখি। একটু ষ্পষ্ট করে বলি- এদেশের বহু মানুষ এখন সমাবেশে ভাড়া খাটেন। তাদের কাছে দল কোন বিষয় না। সেটা বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগ তা যাই হোক। কটা টাকা হলে দু-এক বেলা খাবার মিললেই হলো। তারা আজ এ দলের সমাবেশে যাচ্ছেন তো কাল যাচ্ছেন তাদেরই বিরোধী দলের সমাবেশে। দল বুঝে শ্লোগানও দিচ্ছেন বেশ। ওদের চলনেবলনে মনে হবে তারা কখনো সাচ্চা আওয়ামী লীগার কিংবা বিএনপির ঘোর সমর্থক। এ অবস্থায় সমাবেশে কার কত লোক হলো তাতে কি কোন ভোটের হেরফের হবে? জনতার ভোট অন্য এক বিষয়। মনের আর ভালো লাগার ব্যাপার স্যাপার। ভাড়াটে কথিত এই রাজনৈতিকরা পেটের দায়ে যে দলের সমাবেশেই যাক না কেন যদি সঠিক ভোট হয় এরা কিন্তু ভোটটা দেবেন নিজের মতো করেই!
সমাবেশে লোক বাড়ানোর রাজনীতিতে রাজনৈতিক সংঘাত বাড়ছে তা এখন দৃশ্যমান। দেশ এবং জনস্বার্থে এ সংঘাত এড়াতে হবে। তা মোটেও হয়তো সম্ভব হচ্ছে না। আগত নির্বাচন নিয়ে সরকার ও বিরোধী দল ১৮০ ডিগ্রি বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও আন্দোলন সামনে রেখে মাঠে গড়িয়েছে রাজনীতি। রাজপথের কর্মসূচিকে ঘিরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত। নানা পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামছে ক্ষমতাসীনরা। সরকারি দলের নেতারা বলছেন, সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতারা সাফ্ জানিয়ে দিয়েছেন, বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। নির্বাচনের আগে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। তাই সংঘাতের দিকেই যাচ্ছে দেশ। নেতাদের মাঠ গরম করা বক্তৃতা-বিবৃতিতে কর্মীদের মধ্যেও নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এই প্রতিক্রিয়ায় রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করছে। দলীয় সংঘাত বাড়ছে। মিথ্যা মামলা গ্রেফতার বাড়ছে। এক দলের কর্মীরা আরেক দলের কর্মীদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। খুনখারাবি হচ্ছে। তা মহা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্বস্তির একটা দিক আছে, অতীতে বিএনপি কিংবা বিরোধী দল সমাবেশের মোটেই অনুমতিই পেত না। এখন পাচ্ছে। সরকারের এ সিদ্ধান্ত ইতিবাচক বলেই ধরে নিতে পারি আমরা। মন্দ দিকও আছে। বিএনপি যেখানেই সমাবেশ করেছে, সেখানেই কোন একটা অজুহাতে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকেরা আকস্মিক ধর্মঘট পালন করেছে। কখনো তারা নিরাপত্তার অজুহাত তুলেছেন, কখনো মহাসড়কে নছিমন-করিমন বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন। এতে যে কেবল সমাবেশগামী মানুষই ভোগান্তিতে পড়েছে তা নয়, সাধারণ মানুষও সীমাহীন হয়রানির শিকার হয়েছে। কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে এ ধরনের অনাকাঙ্খিত ঘটনা বন্ধ হওয়া জরুরি।
বিভাগীয় গণসমাবেশ শেষ করে বিএনপি ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে। নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে অন্যান্য দলও। ইতোমধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠন যুবলীগ, ছাত্রলীগও রাজপথ দখলে রাখার ঘোষণা দিয়েছে এবং নানা উপলক্ষে মহাসমাবেশের কর্মসূচি নিয়েছে। আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল হবে ২৬ ডিসেম্বর। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন ৩ ডিসেম্বর। যুবলীগের সমাবেশের দিন ধার্য হয়েছে ১১ নভেম্বর। এসব কর্মসূচি কিছুটা সংঘাতের আভাস দেয়তো বটেই! এসব সভা সমাবেশ নিয়ে দেশের রাজনীতির ময়দানে বড় ধরনের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি রাজপথে এমনকি কথার সংঘাতে জড়িয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে রাজপথে ঠেকাতে ব্যাপক তৎপর ছিল আওয়ামী লীগ। বিএনপির বিক্ষোভ ঠেকাতে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও। এসব দেশের জন্য অশান্তির বার্তা দেয় কি?
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে রাজপথের অনিবার্য় রক্তপাত এড়াতে কয়েকটি উপায় আছে। প্রথমত, বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসে আগামী সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও স্বচ্ছ করার বিষয়টি ফয়সালা করতে পারে চলতি সরকার। দ্বিতীয়ত, কোনো আলাপ-আলোচনা ছাড়াই সরকার জাতীয় সংসদে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থার অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি বিল উত্থাপন ও পাশ করে বিরোধীদলীয় আন্দোলন নিষ্প্রভ করে দিয়ে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করতে পারে। এটি করতে সরকারি দলের হয়তো কোন অসুবিধা হবে না। তা না করলে হয়তো সংঘাতের দিকেই দেশ যেতে পারে।
ডিসেম্বর জুড়ে নানা পরিকল্পনা রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর। মাঠের জবাব মাঠেই দেবে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে এখন রাজপথে বিএনপি। তাদের আন্দোলন বা সভা-সমাবেশের বিপরীতে নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠ দখলে রাখার পরিকল্পনা ক্ষমতাসীনদের। এ লক্ষে দল ও সহযোগীদের সম্মেলন, দিবসভিত্তিক কর্মসূচি এবং নির্বাচনি সভা-সমাবেশে বড় জনসমাগমের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন নেতারা। এসব কর্মসূচিতে বড় শোডাউনের মধ্য দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের আবহ তৈরি ও নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করার পাশাপাশি বিএনপির সমাবেশের জবাবও সরকার দল দিতে চায়। বিভাগীয় জনসমাবেশ শুরুর পর থেকেই এর সাফল্য নিয়ে বিএনপি নেতারা বেশ দ্বিধান্বিত ছিলেন। কিন্তু চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে সমাবেশে জনসমাগম দেখে তারা এখন বেশ উচ্ছ্বসিত। বাধা বিপত্তি পেরিয়ে দলটির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের ব্যাপক উপস্থিতি তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে। সমাবেশে বাধা আসবে এমন আশঙ্কা থেকে দলের নেতারা এখন ভিন্ন কৌশলে সামনে এগোনোর কথা ভাবছেন।
এদিকে ‘বিএনপির সমাবেশে যাতে জনসমাগম কম হয় সে কারণে তারা ইতোমধ্যে সারাদেশে মিথ্যা মামলা দেওয়া শুরু করেছে। সবচেয়ে বেশি গায়েবি মামলা দিচ্ছে। বিনা কারণে রাতের বেলায় অভিযান চালিয়ে নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। এমন অভিযোগ বিএনপি মহাসচিবের। তিনি বলেন- ‘যেসব জায়গায় সমাবেশ হয়েছে সেখানে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনী সমস্যা সৃষ্টি করছে, হয়রানি করছে, মিথ্যা মামলা দিচ্ছে, গ্রেফতার করছে।’
যেকোন দেশের রাজনৈতিক দলের শান্তিপূর্ণ সভাসমাবেশ করা গণতান্ত্রিক অধিকার। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের কর্মসূচি ও পরিকল্পনার কথা দেশবাসীকে জানাতে পারে। সেসব সমাবেশে সরাসরি কিংবা ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে বাঁধা সৃষ্টি শান্তিকামী মানুষকে উদ্বিগ্ন না করে পারে না। যেকোন দলের রাজপথে ফয়সালা কিংবা রাজপথ দখল করার হুমকি-ধমকি কোনোভাবে কাম্য নয়। এমনিতেই দেশে অর্থনৈতিক সংকট চলছে। বাজার অস্থির। মানুষের পণ্য কেনার ক্ষমতা কমছে। এ অবস্থায় বিএনপি কিংবা অন্য কোন দলের অস্থির পরিস্থিতি তৈরি করা মোটেও ঠিক হবে না। অন্য দিকে সরকারও যেন কোনভাবে সংঘাতের পথে পা না বাড়ায় তা দেশের জন্য মঙ্গলকর।
পরিশেষে বলতে চাই, দলে দলে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হয় এমন কাজ থেকে সবাইকে দূরে থাকতে হবে। প্রতিপক্ষকে রাজপথে মোকাবিলা কিংবা ফয়সালার পরিণাম; সেসঙ্গে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে দেশের অভ্যন্তরেও কিংবা বহিবিশ্বে সংঘাত তৈরি করার চেষ্টা কখনো মঙ্গলজনক হবে না। এপথ থেকে সকল দলকে এখনই বেরিয়ে আসতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সমাজ গবেষক
সারাবাংলা/এজেডএস