গবেষণায় বাংলাদেশ এবং একটি দীর্ঘস্থায়ী বিনিয়োগ
৯ ডিসেম্বর ২০২২ ১৮:২৭
ছোটবেলায় কমবেশি সবাইকেই একটা প্রশ্ন করেছে বাবা-মা, আত্মীয় স্বজন অথবা শিক্ষকরা যে বড় হয়ে কি হতে চাও। আমরাও উত্তর দিয়েছি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট ইত্যাদি। কেউ কখনো বলেনি আমি গবেষক হতে চাই। কেননা ছোটবেলাতে আমাদের চিন্তার জগৎ গড়ে দিয়েছেন আমাদের আশেপাশে বাস করা প্রিয়জনরা। তারা ওইসব পেশার সুযোগ-সুবিধা সম্মানি নিয়ে আমাদের বলে মনকে নাড়িয়ে দিতো। কিন্তু তাদের গবেষণা নিয়ে ধারণা না থাকার কারণে সেভাবে আমাদের জানাতে পারেননি। অনেকের ব্যবসায় প্যাশন, আবার কেউ করতে চায় মানবজাতীর অনেক সমস্যার সমাধান। এজন্য গবেষণায় মনোনিবেশ করতে চায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকের ৩য় বা ৪র্থ বর্ষে প্রায় সবার মনোগ্রাম/ ডিজার্টেশন থাকে। মাস্টার্সে থাকে থিসিস বা প্রজেক্ট। কিন্তু এগুলো করতে গিয়ে সুপারভাইজারের বকা খেতে হয় কিছু না জানার কারণে। এই কোর্সগুলো পুরোটাই রিসার্চ নির্ভর। রিসার্চে সঠিক জ্ঞান না থাকায় অনেকেরই অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। আমাদের দেশে এবং দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমানোর হার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। সম্প্রতি ৪০তম বিসিএসের গেজেট প্রকাশিত হলো। সার্কুলার দেয়া থেকে গেজেট হওয়া পর্যন্ত একজন বিসিএস ক্যাডারকে অপেক্ষা করতে হয়েছে চার বছর দুইমাসের মতো। এই সময়ে একজন ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রাজুয়েট হতে পারে কিংবা দুইটা মাস্টার্স ডিগ্রী নিতে পারে। অনেকে তো তিনবছরে পিএইডডি ডিগ্রীও লাভ করেন। এতো দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় যাতে না থাকতে হয় এজন্য কেউ কেউ ভিন্ন কিছু ভাবার প্ল্যান করেন। কেউ কেউ মাস্টার্স বা পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করতে চান। ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ পাওয়া যায় গবেষণা পত্র থাকলে। আর ছাত্রাবস্থায় রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট ও অ্যাসোসিয়েট হিসেবে রয়েছে কাজ করার বিশাল সুযোগ ।
এইতো কদিন আগে জাতীয় দৈনিকগুলোর প্রধান শিরোনাম হয়েছিলো এক সরকারি প্রতিষ্ঠান গবেষক খুঁজে পাচ্ছে না। নূন্যতম যোগ্যতা দিয়েও কাউকে নিয়োগ দেয়া যাচ্ছে না। এই হচ্ছে আমাদের দেশে গবেষণার অবস্থা। অনেকদিকে অনেক চাকরির সুযোগ কিন্তু কোথাও যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যায় না। এজন্য বাড়ছে বেকারত্ব। একটা দেশ তখনই উন্নতি করে যখন সেই দেশ গবেষণা করে নিত্যনতুন প্রযুক্তি বা মানবজীবনে কল্যাণকর এমন কিছু আবিষ্কার করে। এই গবেষণার জন্যেই পৃথিবী আজ এতো উন্নত। আজ ইউরোপ আমেরিকা এমনি এমনি এতো উন্নতি করে নি। তারা গবেষণায় গুরুত্ব দিয়েছে জন্যেই আজ তারা বিশ্ব নন্দিত।
অন্যান্য দেশের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে গবেষণায় দেশকে এগিয়ে নিতে। এজন্য প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে গবেষণায়। যদিও এই পরিমাণ নগণ্য। তবুও এগিয়ে যাচ্ছে এই ব্যাপারে সাধুবাদ জানানো যেতে পারে। এই যে নিয়োগ দিচ্ছে তার জন্যে প্রয়োজন হচ্ছে তরুণ গবেষকদের। অনেক বৃত্তি দেয়া হচ্ছে, ফেলোশিপ প্রদান করছে, বিভিন্ন সেমিনারের আয়োজন করছে যা গবেষণায় উন্নতি করার লক্ষ্যই প্রকাশ করে। আন্তর্জাতিক কিউএস র্যাংকিং একটা তালিকা প্রকাশ করেছে যে এশিয়ার শীর্ষ ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নেই বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়, অথচ ভারত পাকিস্তান মিলে প্রায় ১০ টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে সেই সেরা ১০০ এর তালিকায়। এই তালিকা করা হয়েছে তার কিছু মানদন্ড ছিলো যেমন- শিক্ষকদের গবেষণায় সুনাম, পিএইচডি আছে কিনা এবং বিদেশী শিক্ষার্থীর সংখ্যা এসব মানদণ্ড মিলে। আমাদের দেশে যা দেখা যায় শিক্ষক হতে গেলে মাস্টার্স ডিগ্রী হলেই হয় যার পরিপ্রেক্ষিতে অন্যকোনো দেশে নিয়োগ দেয়া হয় না। এজন্য গবেষণা শেখা বা নামিদামী জার্নালে বাংলাদেশি গবেষকদের আনাগোনা তুলনামূলক কম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্লাস নেয়ার পাশাপাশি অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে গবেষনা করা এবং শিক্ষার্থীদের ডিজার্টেশন/ মনোগ্রাম/ থিসিস/ প্রজেক্ট পর্যবেক্ষণ করা। গবেষণায় দক্ষতা না থাকলে সেই শিক্ষকদের থেকে ছাতছাত্রীদের জানার এবং শেখার অনেক গ্যাপ থেকে যাবে যা একটি জাতীর পিছিয়ে পড়ার জন্য যথেষ্ট। কদিন আগে কোনো গবেষক গবেষণা করে দারুণ কিছু আবিষ্কার করলেন যা মানবদেহের অশনি সংকেত হতে পারে কিন্তু তাকে ঠিক সম্মান না দিয়ে আরো বিস্তর গবেষণা না করে পুরো দেশের কাছে তুচ্ছ করা হলো। এই পরিবেশ যতদিন না পরিবর্তন হচ্ছে ততদিন কেউ আর নতুন কিছু গবেষণা করতে আসবে না, কেননা নতুন কিছু আবিষ্কার করে কেউ সেধে সমাজের কাছে ছোট হতে চাইবে না।
আমাদের দেশের পরিবেশটা এমন হতে পারতো যে ভালো মানের জার্নালে গবেষনাপত্র প্রকাশ হলে তাকে পুরষ্কৃত করা হবে। যদি এমন হতো তাহলে গবেষকের সংখ্যা অবশ্যই বাড়ত। বুয়েট এমন একটি উদ্যোগ নিয়েছিলো যে কোনো শিক্ষক যদি কিউ-১ জার্নালে গবেষনা প্রকাশ করাতে পারেন তাহলে তিনি সম্মানী হিসেবে ১ লক্ষ টাকা পুরষ্কার পাবেন যা অতি প্রশংসনীয়। এমন দিনবদলের অঙ্গীকার নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে নতুন কিছুর সন্ধানে। বর্তমান পরাশক্তি আমেরিকা কিংবা রাশিয়া তারা দুদেশই গবেষণায় নিজেদের কৃতিত্ব দেখিয়েছে এবং দেখাচ্ছেও। চাঁদ, মঙ্গল বা অন্যকোনো গবেষণাতে তাদের পদচারণা প্রশংসনীয়। কিন্তু আমরা এখনো গবেষণার ঠিক গুরুত্বটা উপলব্ধিই করতে পারছি না। এখানে কেউ গবেষক শুনে বাঁকা চোখে তাকান। ঠিকমতো বরাদ্দের অভাব যেমন আছে, তেমন আরো অনেক প্রতিকূলতা সৃষ্টি করে রেখেছি যা অন্যদেশের কেউ ভেবে হয়তো শিহরিত হবেন। এই অবস্থার দ্রুত উন্নতি করা না গেলে জাতীর জন্য দৈনতা থেকে যাবে যার পরিণতি ভয়ংকর। মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণার জন্য বাড়াতে হবে বরাদ্দ। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো তাদের বাজেটের কমপক্ষে ৬% রাখে শিক্ষা ও গবেষণার জন্য। এতে উন্নত মানের ল্যাব যেমন হয়ে যায় এবং উন্নত সবধরনের প্রযুক্তির যোগান দেয়া সম্ভব হয়। আমাদের বাংলাদেশে এই ৬% বরাদ্দ রাখা হয় না। ফলে গবেষকরা ঠিকমতো বরাদ্দ না পাওয়ায় তাদের সর্বোচ্চ দিয়ে হলেও ঠিক আউটপুট টা আসলে পান না। এজন্য অনেকেই পাড়ি জমান উন্নত ল্যাব সুবিধা সম্বলিত দেশে এবং ওখানেই থেকে যান। এতে ক্ষতিটা আসলে দেশেরই হয়। ভালো মানের ফোন, ল্যাপটপ বা কাপড় যাই হোক না কেন কিনতে যেমন একটু বেশি অর্থ লাগে ঠিক তেমনই ভালো গবেষণা পেতেও লাগে ভালো মানের বরাদ্দ। এখন খাদ্যে ভেজাল পাওয়া আজকাল নিত্যদিনের ঘটনা। এমনকি ক্যান্সার সৃষ্টি করা হেভি মেটাল। যা বেশিদিন ভক্ষণ করলে হতে পারে মরণব্যধী। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে গবেষণায় গুরুত্ব দিতে হবে। কোন সবজিতে কোন ধরণের জীবাণু বা রোগ সৃষ্টিকারী মেটাল পাওয়া যায় তা একমাত্র গবেষণা করেই বের করা সম্ভব। এজন্য কৃষি ক্ষেত্রে গবেষণায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে। উন্নত দেশগুলো কোথায় বিনিয়োগ করে এটা জানতে খুব বেশি মাথা খাটানোর দরকার পড়বে না। তারা সবসময় শিক্ষা ও গবেষণায় বিনিয়োগ করে থাকে। এতে দক্ষ একটা জনশক্তি তৈরী যেমন হয় তেমনই উন্নত হয় তাদের অর্থনীতি। নতুন নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কারের ফলে অন্য দেশে তা রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে তারা। আমেরিকা কিভাবে আজ সুপার পাওয়ার হলো ? অনেক গুলো কারণের মধ্যে গবেষণা সবার থেকে এগিয়ে থাকাও একটি কারণ।
স্ট্যাটিস্টার এক রিপোর্ট অনুযায়ী গবেষণায় আমেরিকার ২০২২ সালে ৬৭৮ বিলিয়ন ডলার ছিল বরাদ্দ করেছিলো। যেখানে বাংলাদেশের মোট জিডিপি ৪৬০.৭০ বিলিয়ন ডলার। ভাবা যায় শুধু গবেষণায় আমেরিকা যেই পরিমান টাকা খরচ করে তা সারা বাংলাদেশের সম্পদের থেকে ২০০ বিলিয়নেরও বেশি। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বাৎসরিক গবেষণার বাজেট ৬৫.২ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশকে শক্তিশালী করতে দুর্নীতি নির্মুলের পাশাপাশি , গবেষণায় ব্যাপক গুরত্ব দিতে হবে। গবেষণা খাতের প্রবৃদ্ধি ছাড়া সব দেশের জন্য বাণিজ্যের সুফল, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা, অটোমেশনের মাধ্যমে দ্রব্য ও সেবার উৎপাদন বৃদ্ধিসহ মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন অসম্ভব। দীর্ঘমেয়াদে সম্পদ সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে গবেষণা খাতে বিনিয়োগের বিকল্প নেই। স্বল্প মেয়াদেও অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও অন্যান্য সংকট মোকাবিলায় গবেষণার বহুল প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সামান্য ব্যতিক্রম বাদ দিলে গবেষণা খাতে যেসব দেশের বিনিয়োগ বেশি সেসব দেশগুলোর উদ্ভাবন উদ্যোগ বেশি । একথা আজ স্পষ্ট যে গবেষণায় বিনিয়োগ সেরা এবং দীর্ঘস্থায়ী বিনিয়োগ।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ফিচার, কলাম এন্ড কন্টেন্ট রাইটার্স
সারাবাংলা/এজেডএস