কোমলমতি শিশুদের হত্যা নয়, বাঁচতে দিন
১৪ ডিসেম্বর ২০২২ ১৭:০৬
সারা দেশে একের পর এক শিশু ধর্ষণ কিংবা হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটছে। শুধু ধর্ষণ করে ক্ষান্ত থাকছে না পাষণ্ডরা, ধর্ষিত শিশুটিকে হত্যা করতে পর্যন্ত দ্বিধা করছে না। বাড়ির আঙিনায়, মাদরাসা, বাসে-লঞ্চে, পথে-ঘাটে-মাঠে বা স্কুলের চার দেয়ালে- শিশুর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা কোথাও নেই আজ। শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চল কোথাও না কোথাও প্রায় প্রতিদিনই শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেই চলছে। এসবই তে জড়িয়ে আছে বড়দের স্বার্থ। বিরামহীন ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধিতে মানুষের নীতিনৈতিকতা ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের বিষয়টিই যে সামনে এসে পড়ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আজ যারা শিশু, ভবিষ্যতে তারাই হবে দেশ গড়ার কারিগর। একটি শিশু পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে স্নেহ, ভালোবাসা, আদর-সোহাগ, বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা আর সুন্দরের প্রত্যাশা নিয়ে। শিশুকে দেখলেই কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছে করে সবার। সেই শিশুর জীবনই যদি নিরাপদ না হয়, তাহলে গোটা সমাজই বিপদের সম্মুখীন হবে একসময়। তবে শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তা হীনতায় ভুগছেন কন্যাশিশুরা। প্রতিনিয়ত আমাদের সমাজের কিছু নরপিশাচদের ছোবলের শিকার হচ্ছেন কোন না কোন মেয়ে। এর থেকে রক্ষা পাননি কন্যাশিশুরাও। তারা পরিবার ও পরিবারের বাইরে বিভিন্ন নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে অহরহ। পরিবারের কেউ না কেউ, আত্মীয় স্বজন কিংবা পাড়া প্রতিবেশীর দ্বারা যৌন হেনস্থা ও ধর্ষণ নয়, নৃশংস হত্যার শিকার হচ্ছে আমাদের কন্যা শিশুরা। অথচ তারা এসবের কিছুই বুঝেন না। বুঝে উঠার আগেই দুনিয়ার কিছু হিংস্র মানবজাতির নৃশংস কর্মকাণ্ড কন্যাশিশুদের সুন্দর পৃথিবী দেখার স্বাদ এক নিমিষেই বিলীন করে দেয়।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া চট্টগ্রাম নগরীর ইপিজেডে অপহরণের পর পাঁচ বছরের শিশু আয়াতকে হত্যা করে ছয় টুকরা করে সাগরে ভাসিয়ে দেয়ার ঘটনা সমাজে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। আর্তনাদে ভারি হলো চট্টগ্রামের বাতাস। আয়াতের ছয় টুকরার মধ্যে প্রথমে দুই টুকরা পা উদ্ধার করলেও মা-বাবার সেই ছোট্ট আয়াতের মাথাটি দেখতে আর্তনাদ করেন। এছাড়াও গত ১০ নভেম্বর নওগাঁয় ইব্রাহিম নামে ছয় বছরের এক শিশু নিখোঁজ হয়। এক পর্যায়ে শিশু ইব্রাহিমের বাবার শোবার ঘরে জানালার পাশে একটি চিঠি পাওয়া যায়। চিঠিতে বলা হয়- একটি সিম এবং একটি মোবাইল কিনে বাবুর দোকানের সামনে চুলার মধ্যে রেখে যেতে। একই সঙ্গে আরও ছয় লাখ টাকা প্রস্তুত রাখতে বলা হয়। এরপর ২৬ নভেম্বর শিশুর বাবাকে একটি অজ্ঞাত মুঠোফোন থেকে ফোন করে মুক্তিপণ দাবি করা হয়।
অপরাধী বুলবুলের দেয়া তথ্য মতে, তিনি গত ১০ নভেম্বর দুপুরে তার দোকানে গিয়ে শিশু ইব্রাহিম পাঁচ-ছয়টি বেলুন ফাটায়। শিশুটিকে দোকান থেকে চলে যেতে বলা হলেও চলে না গিয়ে আরও বেলুন ফাটাতে চায়। তাই রাগ করে শিশুটিকে গলা টিপে হত্যা করে চা স্টলের পিছনে ছাইয়ের স্তূপের মধ্যে বস্তাবন্দী করে পুতে রাখে। ১৮ নভেম্বর বালতিতে করে শিশুটির অর্ধগলিত মরদেহ পাশে আত্রাই নদীতে পুঁতে রেখে একটি বড় কংক্রিটের বস্তা দিয়ে চাপা দিয়ে রাখে। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এলাকার লোকজনের উপস্থিতিতে শিশুটির অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। শিশু আয়াত আর ইব্রাহিমের মত অসংখ্য শিশুকে ধর্ষন কিংবা হত্যাকান্ডের মত এমন কাজ আমাদের সমাজে হয়ে থাকে প্রতিনিয়ত। সমাজের বিভিন্ন প্রতিশোধের বলি হচ্ছেন অনেক মা বাবার আদরের অবুঝ শিশুকে।
এসব ঘটনায় নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরা কতটা বিচার পেয়েছে, তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। পত্রিকার পাতা উল্টালেই এর কিছু না কিছু আমরা দেখতে পাই। তবে বারবার ঘটে যাওয়া এই ঘটনাগুলো এটাই প্রমাণ করেছে, আমাদের বিচার-প্রক্রিয়া এবং আইনি তৎপরতার দুর্বলতার কারণে উপযুক্ত শাস্তি থেকে বেঁচে যায় অপরাধীরা। এই পার পেয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া সমাজে আরো অনেককে একই ধরনের অপরাধ সংঘটনে উৎসাহিত করে। আগামীর শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে আগে পরিবারের সদস্যরা। তাদেরকে স্কুলে যাওয়া থেকে শুরু করে ঘরে থাকার সময়ে যত্নশীল হতে হবে। শিশুর সামান্য ক্ষতি হতে পারে এমন কোনো ব্যক্তির কাছে যেতে না দেয়াই ভালো। শিশুকে বাসায় একা রেখে কোথাও যাওয়া উচিত নয়। যথা সম্ভব মেয়ে শিশুকে স্কুলে আনা নেওয়ার ক্ষেত্রে মা বাবার ভূমিকা থাকতে হবে ব্যাপক। সেই সাথে ধর্ষণ রোধে মনিটরিং বা নজরদারি জোরদার করতে হবে আমাদের সমাজের সকল স্তরের মানুষের। পরিবারকে তাদের সন্তানের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। মূল্যবোধ ও নীতি নৈতিকতার চর্চার অভাবে দেশে দিন দিন বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বৃদ্ধি হচ্ছে। মানুষের ভেতরে নৈতিকতাকে জাগ্রত করতে হবে। সমাজের সকল স্তরের মানুষের মাঝে নৈতিকতার বহিঃপ্রকাশ করতে হবে। পারিবারিক বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা প্রদান করতে হবে। নৈতিকতার সঠিক চর্চা সমাজের নৈতিক অবক্ষয় রোধ করতে পারে। তবে কন্যা শিশুর পাশাপাশি ছেলেশিশুকেও ধর্ষণ ও যৌন হয়রানিবিরোধী মূল্যবোধ শেখাতে হবে। যেন বড় হয়ে ভবিষ্যতে সে এ ধরণের আচরণ থেকে বিরত থাকে। সবশেষে শিশুদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে আমাদের।
লেখক: সমাজকর্মী ও লেখক
সারাবাংলা/এজেডএস