Wednesday 11 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভিনদেশী সংস্কৃতির প্রাধান্য এবং নৈতিকতার স্খলন

অলোক আচার্য
১৪ ডিসেম্বর ২০২২ ১৮:৪৪

অন্যসব ক্ষেত্রের সাথে সাথে দেশে সংস্কৃতিরও দূষণ ঘটছে। এই দূষণ আজ থেকে শুরু হয়নি। পশ্চিমা সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকতে ঝুঁকতে আজ পশ্চিমা সংস্কৃতির সাথে হিন্দি সংস্কৃতির মিশ্রণে বাংলাকেই অপাঙতেয় বলে মনে হয়। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন শব্দটি ইদানিংকালে খুব বেশি শোনা যাচ্ছে। এর কারণ বাংলাদেশি সংস্কৃতিতে বিদেশি সংস্কৃতি মিশে এক মিশ্র সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। এর প্রভাব এতটাই যে মাঝে মাঝে স্বকীয়তা খুঁজে বের করতেই কষ্ট হয়।

বিদেশি সংস্কৃতি ভালবাসতে গিয়ে নিজের সংস্কৃতি হারাতে বসেছি। আজকাল তাই নিজের দেশের দিবস পালনের চেয়ে ভিনদেশে চালু থাকা দিবস পালনে একটু বেশি আগ্রহ দেখা যায়। তাতে অবশ্য ক্ষতি কিছু নেই। আবার নিজ সংস্কৃতিকে ভুলে যাবার মূঢ়তার ভেতর আনন্দেরও কিছু নেই। বরং তা খানিকটার লজ্জার।

আমরা আজ শুধু নামেই বাঙালি। আমাদের পোশাক-পরিচ্ছেদ, আহারে-বিহারে,রুচি-ফ্যাশনে সবর্ত্রই ভিনদেশী। তবে নির্দিষ্ট কোনো দেশের নয়, সব দেশেরই কিছু না কিছু আছে। আমাদের জীবনে যার প্রভাব পরছে। এমনকি আমাদের ভাষাও দূষণে ভুলে ভরে গেছে। তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ভুলটাই সবর্ত্র চলছে। অথচ বিদেশীরা আমাদের সংস্কৃতি চর্চা করছে না। তারা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত আছে। তাদের সংস্কৃতি তারা ঠিক বয়ে চলেছে, হারায়নি। আমরা হারাতে বসেছি আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য।

আজ সাংস্কৃতিক আগ্রাসন নিয়ে তুমূল হৈ চৈ হচ্ছে। কিন্তু এই আগ্রাসন কি আজ শুরু হয়েছে। নাকি এর সূত্রপাত আরও অনেক আগে। একসময় আকাশ সংস্কৃতি নামে একটা শব্দ খুব প্রচলিত ছিল। আকাশ সংস্কৃতির শুরুতে বয়স্ক স্থানীয়রা চোখ বন্ধ করে ছি ছি করতো। আর আমরা ভাবতাম একটুখানি ওসব বাইরের নাচ গান বা তাদের ষ্টাইল ফলো করলে ক্ষতি আর এমন কী হবে। এতে এতটা ভাবার কিছু নেই। আর এখন কি তাই করে। সময়ের সাথে সাথে ওসব অনেকটা গা সওয়া হয়ে গেছে। গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে যখন টিভি পর্দার সামনে বসে ভারতীয় বাংলা বা হিন্দী চ্যানেল দেখে আবার কথা বার্তায়, পোশাকে-আশাকে, খাবার দাবারে বাঙালী সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়ে সেদেশে সংস্কৃতিকে আকড়ে ধরে থাকি তখন শুধু আগ্রাসন শব্দটি বেমানান মনে হয়। ইতোমধ্যেই সেগুলো আমাদের গ্রাস করে ফেলেছে। এখন তো বিসর্জন বাকি। তবে সেটুকুও যাবার পথে। আমাদের আরও আগেই সতর্ক হওয়ার দরকার ছিল। কারণ গ্লোবাল ভিলেজের যুগে সতর্ক না হলেই বিপত্তি।

আমাদের ভাষায়, আমাদের পোশাকে, আচার আচরণে, সৌহার্দ্যবোধে যেন বিদেশি সংস্কৃতি অনুসরণ করাই মূল কাজ। নিজেদের অনেক কিছু ভুলতে ভুলতে এতটাই ভুলে গেছি যে অনেক কিছুই কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। ভারতীয় চ্যানেল এবং সেখানে প্রচারিত নাটক নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে তুমূল সমালোচনা হয়। সেসব নাকি আমাদের পারিবারিক কলহ সৃষ্টি করছে। তখন মনে হয় আমরা অনেকেই নিজের সংস্কৃতিটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই। আবার বিপরীতে কেউ কেউ সেগুলো টেনে আনার পক্ষে। কিন্তু ঠিক কোথায় আমরা অসহায়।

আজকাল হাতে হাতে মোবাইল। ইন্টারনেটের বদৌলতে আমরা পৌছে যাই পরিচিত হই ভিন্ন দেশের সংস্কৃতির সাথে। ঠিক সেরকমভাবে কিন্তু সেসব দেশের মানুষও আমাদের সংস্কৃতি আমাদের রুচি বোধ বিষয়ে জানতে পারে। কিন্তু আমরা যেভাবে বিদেশি আচার নিজের ভেতর ধারণ করে নিজেরটা ভুলতে থাকি অন্যদেশের কেউ তা করে কি। আমি নিশ্চিত করে না। কারণ আমরা শুধু পরিচিত হয়েই খুশি থাকি না। আমাদের রুচির পরিবর্তন ঘটেছে এটা ঠিক। কিন্তু তাই বলে তা নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার পর্যায়ে যায়নি। আমরা আজও বাঙালিপনাকেই শ্রদ্ধা করি।

যেসব সিরিয়ালগুলো প্রচার হয় সেগুলো খুব জনপ্রিয় এবং প্রচুর দর্শক সেগুলো দেখছে। এই ডাবিংকৃত সিরিয়াল দেখার জনপ্রিয়তা কিন্তু আজকের নতুন না। সেই বহুবছর আগেই বিদেশি সিরিয়াল ছিল জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। অথচ বহু বছর ধরেই আমরা নিজেদের সংস্কৃতি ধ্বংস করেছি।

বাংলা সিনেমাতে সত্তর আশির দশকে যে দর্শক ছিল তা হঠাৎ করেই মুখ ফিরিয়ে নিল। সস্তা জনপ্রিয়তা টানতে গিয়ে চলচ্চিত্রে নোংরামি ঢুকিয়ে দিয়েছে। তারপর একসময় এই নোংরামি মানুষ ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করলো। পরিবারের সবাই মিলে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখার যে পরিবেশ ছিল তা আর নেই। আজ সিনেমা হলের কথা শুনলেই সেই নোংরা ছবির দৃশ্য ভেসে ওঠে। সিনেমা হলগুলো সব মার্কেট হয়েছে। মাঝখানে কেউ কেউ সিনেমা হলে দর্শক ফেরানোর চেষ্টা করে ভালো মানের ছবি নির্মাণ করেছে। কিন্তু সিনেমা হলের সেই পরিবেশ আর ফেরেনি। ফেরানোর জন্য খুব চেষ্টাও দেখিনি। হলগুলো ভেঙে সেখানে মার্কেট হয়েছে। কারণ লোকসান তো বছরের পর বছর টানা যায় না। কেনো সিনেমা চলে না বা কোথায় সমস্যা সেটা খুঁজে বের করে তা সমাধান করতে কতজন এগিয়ে এসেছে? সুস্থ ধারার সিনেমা যে একেবারে হচ্ছে না তা কিন্তু নয়। তবে তা হাতে গোণা। সেগুলোই দর্শক বিভিন্ন মাধ্যমে দেখছে। তবে হলমুখী হচ্ছে না।
সংস্কৃতি রক্ষায় একটি ইতিবাচক আন্দোলন খুব জরুরি। যেখানে বাংলা ভাষা, বাংলা পোশাক, বাংলা সিনেমা মোট কথা বাঙালির সবকিছুকে ধরে রাখতে হবে। বাঙালির সংস্কৃতি তো দরিদ্র নয়। বাঙালির সংস্কৃতি পরিপূর্ণ। সেখানে সবকিছুই নিজস্ব। কিন্তু আমরা এমনভাবে বিদেশিদের ওপর নির্ভর করতে শুরু করেছি যে শুধু পরিচয়টাই বাঙালি, বাকিসব যেন ভিন্ন ভিন্ন দেশের। কেউ ইংরেজি বলছেন বা সন্তানদের বলাচ্ছেন, পোশাক পরছেন, খাওয়া-দাওয়া করছেন বাইরের দেশের মতো। হিন্দি সিরিয়ালের কথা তো বাদই দিলাম। সেসব সংসারে সংসারে বাসা বেঁধেছে। আজ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হালকা হয়ে গেছে। বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা বাড়ছে। এসব তো বাঙালির ঐতিহ্য নয়। একটি সুন্দর একান্নবর্তী সমাজই বাঙালির ঐতিহ্য। লক্ষ্য রাখতে হবে কোনোভাবেই যেন মিশ্র ভাষা প্রবেশ না করে। আমাদের যে অন্য কোনো ভাষার দরকার নেই বিষয়টা এমন নয়। তবে বাংলাকে বাদ দিয়ে নয়।

আমরা ডিস্কো নাচতে পারি তবে তা আমাদের ঐতিহ্যবাহী নাচ বাদ দিয়ে নয়। পোশাকগুলো পশ্চিমা ধাঁচে পরা শুরু হয়েছে বহু বছর আগেই। সে প্রথা এখন গেঁথে গেছে। তবে চাইলেই আমরা বাঙালির পোশাক ফিরিয়ে আনতে পারি। আবার ভাষার কথা বললে একটু শুদ্ধ করে বলা, লেখা শিখতে হবে। নিজের ভাষাই যদি শুদ্ধভাবে না লিখতে বা বলতে পারি তাহলে অন্য ভাষা শেখা যায় না। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনটা কোথা থেকে শুরু হবে সেটা ঠিক করতে হবে। নিজস্বতা রক্ষা করতে এই আন্দোলন জরুরি। যদিও কাজটি বেশ কঠিন। হাতে হাতে ফেসবুক, টুইটারের যুগে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন ব্যাপার। তবে চাইলেই সম্ভব। আজ যদি বাংলা সংস্কৃতি বিদেশি সংস্কৃতির কাছে বিকিয়ে দেই তাহলে দেশটা স্বাধীন করে লাভটা কি হলো? নিজেদের অস্তিত্ত¡ই তো রক্ষা করতে পারছি না। একটি সুস্থ সাংস্কৃতিক আন্দোলন যদি নতুন প্রজন্মের মধ্যে দেওয়া যায় তাহলে আবার বাঙালির নিজস্বতা ফিরে আসবে। সমাজে আদব-কায়দা ফিরবে। শৃঙ্খলা ফিরবে। আর তা না হলে আমরা নিজস্বতা হারিয়ে পরাধীন সংস্কৃতির মানুষ হবো।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এজেডএস

অলোক আচার্য ভিনদেশী সংস্কৃতির প্রাধান্য


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

গণপরিবহনে ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য চলছেই
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২১:০০

সম্পর্কিত খবর