এইখানে এক নদী ছিল…
৮ জানুয়ারি ২০২৩ ১৬:৫৯
‘এইখানে এক নদী ছিল, জানলো না তো কেউ…।’ হ্যাঁ, তাই তো কালক্রমে আধুনিকায়নের উদাসীনতায় নাব্য হারাতে বসেছে আমাদের ঐতিহ্যবাহী বুড়িগঙ্গা। এক সময় এই নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল রাজধানী ঢাকা। সে সময় বুড়িগঙ্গার ছিল ভরা যৌবন, যা আজ ক্রমান্বয়ে বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে। ঢাকার চারশ’ বছর পেরিয়ে আজ মৃতপ্রায় বুড়িগঙ্গা।
বাংলাদেশের প্রায় সব নদ-নদীর পানি প্রবাহের মূল উৎস সীমান্ত নদী। দক্ষিণ-পূর্ব পাহাড়ি অববাহিকা বাদে গঙ্গা, পদ্মা, যমুনা ও মেঘনা এই চার নদীর অববাহিকায় বাংলাদেশের অবস্থান। ভারতের একতরফা পানি আগ্রাসনে দেশের সবক’টি অববাহিকার নদ-নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে মরুভূমিতে পরিণত হবে। মূলত প্রধান দুটি কারণে নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে। একভাগে রয়েছে পার্শ¦বর্তী দেশের একের পর এক নদীমুখে বাঁধ নির্মাণ ও অপরদিকে রয়েছে নদী ভরাট করে নগরায়ণ শিল্প কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ নদীতে ফেলা। এভাবেই নদীগুলো মৃত্যুর প্রহর গুনছে। যে নদীতে একসময় অথৈ জলের ঢেউ খেলা করত আজ সেখানে ছোট-খাটো ধু ধু বালুর মরুভূমি নজরে পড়ছে। এ থেকে পরিত্রাণ পায়নি ঢাকার নদীগুলোও দখলে-দূষণে মৃতপ্রায় ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ চার নদী।
বুড়িগঙ্গা মূলত ব্রহ্মপুত্রের উপনদী ছিল। কালের বিবর্তনে তার নাম হয় ধলেশ্বরী। কিন্তু তার পরও বুড়িগঙ্গা নাম হয় কেন? এ নিয়ে বয়সী মহলে তর্কবিতর্কের শেষ নেই। তবে পুরাকালের কিংবদন্তি থেকে জানা যায়, ক্ষত্রীয় নিধনকারী পরশুরামের কুঠার তার হাত থেকে ফেলার জন্য তৈরি হয় ব্রহ্মপুত্র নদ। জন্মের পর থেকেই তুমুল গর্জনে ছুটে চলা। চলার পথে তার কানে এলো অপরূপ মোহনী রূপের বর্ণনা। সে আরো শুনতে পায় যে, আমাবশ্যা-পূর্ণিমা রাতে শীতলক্ষ্যা হয়ে উঠবে নব যৌবনা। ব্রহ্মপুত্র তার তীর ভেঙে ছুটে আসতে থাকে শীতলক্ষ্যার দিকে। তার ছুটে আসার খবর পেয়ে ভয়ে ও লজ্জায় শঙ্কিত হয় শীতলক্ষ্যা। এই দুর্দান্ত, ক্ষিপ্ত ও দুর্জয় বরকে বরণ করে নিতে নিজেকে কোনো মতেই রাজি করতে পারল না শীতলক্ষ্যা। তাই নিরুপায় হয়ে ভীত শীতলক্ষ্যা মন্ত্রপাঠ করে এবং বুড়ি রূপ ধারণ করল। অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্র এসে ডাকল কোথয় শীতলক্ষ্যা? জবাবে শীতলক্ষ্যা বলল, আমি বুড়ি হয়ে গেছি। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র নাছোড়বান্দা। সে বলল, আমি তোমাকে বিয়ে করব। এরপর তাদের বিয়ে এবং মিলন হলো। পরবর্তীতে শীতলক্ষ্যার কিছু অংশকে মানুষ বুড়িগঙ্গা বলে ডাকতে লাগল। অন্যদিকে ঐতিহাসিক তথ্যে বলা হয়েছে, গঙ্গার একটি ধারা প্রাচীনকালে ধলেশ্বরী হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। পরবর্তীতে গঙ্গা বাঁক বদল করে অন্য পথে চলে যায়। প্রাচীন গঙ্গা এই পথে প্রবাহিত হতো বলেই এর নাম হয় বুড়িগঙ্গা।
বুড়িগঙ্গা কি সত্যিই বুড়ি হয়ে যাবে? ঢাকার প্রাণ বলে খ্যাত বুড়িগঙ্গা নদীর অবস্থা ক্রমান্বয়ে অবনতি হচ্ছে। বুড়িগঙ্গার এই মরণদশার বড় কারণ হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প-কারখানা। এগুলোতে প্রতিদিন প্রায় ২২ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য ও ১০ টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। যার প্রায় পুরোটাই নানাভাবে বুুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়ছে। অন্যদিকে প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক মদদপুষ্ট গোষ্ঠীর অবৈধ নদী দখল তো আছেই। ক্রমান্বয়ে নদীগুলো ছোট হয়ে আসছে। আর বর্জ্য অব্যবস্থাপনার কারণে নদীর পানি যেমন দূষিত হচ্ছে তেমনিভাবে কলকারখানার রাসায়নিক দ্রব্য ও বর্জ্যে পানি দূষিত হয়ে বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছে গেছে। ফলে নদীগুলোর পানি এতটাই বিষাক্ত হয়ে উঠেছে, যা পরিশোধন করে ব্যবহারও অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
যে পানিতে জীববৈচিত্র্য জন্মায়, বেঁচে থাকার জন্য কমপক্ষে প্রতি লিটার পানিতে ২.৫ মি.লি. অক্সিজেন থাকা আবশ্যক। আর ব্যবহারের জন্য অক্সিজেন প্রয়োজন হয় প্রতি ১ লিটারে ৫ মি.লি.-এর বেশি। সেই পানিকে দূষণমুক্ত রাখতে হলে প্রতি লিটারে ৮ মি.লি. অক্সিজেন থাকতে হবে। কিন্তু এখন তা আর নেই। শিল্প কলকারখানার বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য পদার্থ সেই অক্সিজেন ধ্বংস করে ফেলেছে । তাই নতুন করে মাছ, কীটপতঙ্গ কিংবা জীববৈচিত্র্যেরও জন্ম দিতে পারছে না। বুড়িগঙ্গায় একসময় মেঘ দেখলেই শুরু হতো ঢেউয়ের তোলপাড়। কিন্তু সেই খরস্রোতা বহমান বুড়িগঙ্গা আর নেই।
সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর দখল-দূষণ মুক্ত করতে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হলেও তা কাজে আসছে না। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌকর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নথিপত্রে ওই চারটি নদীর দখল-দূষণমুক্ত করতে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফিরিস্তি থাকলেও বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন দেখা যায়। নদীগুলো প্রত্যক্ষ করলে বোঝা যায় সংশ্লিষ্ট কোনো বিভাগই নদী রক্ষায় আন্তরিক নয়। এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে নদীগুলোর অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়বে। গুরুত্বপূর্ণ এই নদীগুলোকে দখল-দূষণমুক্ত করতে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে খুবই সামান্য। প্রকল্পের কয়েকটিতে নামমাত্র কিছু কাজ করে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে মোটা অঙ্কের অর্থ। দখলমুক্ত করতে প্রায়ই অভিযান চালানো হলেও ওই অভিযানে কোনো লাভ হচ্ছে না। কারণ, অভিযান পরিচালনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আগের অবস্থানে ফিরে আসছে। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ নদীর তীরে গড়ে ওঠা শিল্প-কারখানার বর্জ্য, গৃহস্থলি ট্যানারি, হাসপাতাল ও ডায়িং কারখানার বর্জ্য থেকে নদীগুলো প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে। যার ফলে মাছ ও জলজ প্রাণী বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠেছে। প্রাণিবিজ্ঞানীদের মতে, মাছ ও জলজ প্রাণীর বসবাসের জন্য প্রতিলিটার পানিতে দ্রবীভূত হাইড্রোজেনের পরিমাণ ৫ মিলিগ্রাম বা তার বেশি থাকা প্রয়োজন। দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা কম পক্ষে ৭ মিলিগ্রাম থাকা উচিত। কিন্তু বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ নদীর পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ প্রায় শূন্যের কোটায়। নদীগুলোর পানি এতটাই দূষিত যে, যারা সরাসরি পানি ব্যবহার করছেন তারা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রাকৃতিক কারণে অন্যেরাও হচ্ছেন ক্ষতির সম্মুখীন।
সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস সিইজিআইজিএস থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, ছোট ছোট আরো শত শত নদীর হিসাব না পাওয়া গেলেও গত ৪০ বছরে শুধু তিনটি প্রধান নদী পদ্মা, মেঘনা, যমুনাতেই বিলীন হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমি। আর তার বিপরীতে নতুন ভূমি জেগেছে মাত্র ৩০ হাজার হেক্টর। এভাবে প্রতিবছর কোনো না কোনো নদীর শাখা ধীরে ধীরে পলি পড়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো নদী দখল হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী দিনগুলোতে আরো দ্রুত হারে নদী বিলুপ্ত হতে থাকবে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন নগরগুলোর দিকে তাকলে দেখা যায় সবগুলো নগর গড়ে ওঠার পেছনে নদীর ভূমিকা অপরিসীম। তাই নদীকে নগরের প্রাণ বলা হয়। তাই শিগগির বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে না পারলে ঢাকাকে বাঁচানো যাবে না। তখন দেখা যাবে, সদরঘাট থাকবে কিন্তু লঞ্চ থাকবে না। ফলে, নৌযোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। কাজেই এই ব্যাপারে সরকারের সময়োচিত পদক্ষেপ এবং জনসচেতনতাই পারে বুড়িগঙ্গাকে তার হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে দিতে। আমাদের আরো ভালোভাবে ভাবতে হবে, হতে হবে সচেতনও, রাজধানী ঢাকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা এবং মানুষের বাসযোগ্য পরিবেশের স্বার্থে নদীদূষণ রোধে পদক্ষেপ নেওয়া এবং নদী রক্ষায় সবার সহযোগিতা এখন সময়ের দাবি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি