বন্ধু রাষ্ট্রের সীমান্তে মানুষ হত্যা বড় উদ্বিগ্নতা
২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৪:৪৪
বাংলাদেশ-ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বেশ পুরনো। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই প্রতিবেশী দেশ ভারতের নামটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে। আমরা স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর সুবর্ণজয়ন্তী পালন করেছি তবে স্বাধীনতা যেমন আবেগ ও আনন্দের স্মৃতি ঠিক তেমনি স্বাধীনতার জন্য লড়াই সংগ্রামের এক করুণ ইতিহাস বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের জন্ম যখন হয়নি তখন আমরা পাকিস্তান দেশের নাগরিক আর এ ভূখন্ডের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান।
তৎকালিন পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে শাসন ও শোষণযন্ত্র তৈরী করেছিল। পূর্ব পাকিস্তানিরা অর্থাৎ নির্যাতি, নিপীড়িত, বঞ্চিত বাঙালি পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণযন্ত্র ভাঙার প্রত্যয় নিয়ে দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। ত্রিশ লক্ষ মানুষের আত্মদান, দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আর কোটি মানুষের দেশান্তর তথা শরণার্থী জীবন গ্রহণের মধ্য দিয়ে আজ আমরা স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করছি। ভারতের জনগণ ও ভারত সরকার সর্বোচ্চ মানবিকতা দেখিয়েছে বাস্তুচ্যুত শরণার্থীদের আশ্রয়, খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিল।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ভারতের সীমান্ত উন্মুক্ত করে দিয়ে বাংলাদেশের নির্যাতিত মানুষের পাশে তারা যেভাবে দাঁড়িয়েছিলো তা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরেই লিখা থাকবে। যে দেশ তার নিরাপত্তার কথা চিন্তা না করে সীমান্ত উন্মুক্ত করে আমাদের আশ্রয় দিয়েছিলো সেই দেশের সীমান্তরক্ষীদের হাতে এখন কেন বাংলাদেশের মানুষের লাশ পড়বে? ভারত রাষ্ট্র আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র না কী শত্রু রাষ্ট্র তা নিয়ে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার জায়গায় তৈরী হয়েছে। ভারত শক্র রাষ্ট্র এই কথা বলে বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে জীবন দিতে হয়েছে। আবরার ফাহাদের কথা স্মরণ হলেই চলে আসে ভারতীয় আগ্রাসনের কথা।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বাংলাদেশীদের লাশ পড়ে থাকে কেন? ভারত সীমান্তে গেলেই বিচার বিশ্লেষণ না করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) বাংলাদেশিকে কেন পাখির মত গুলি করে? পাকিস্তানের সাথেও ভারতের সীমান্ত আছে। সীমান্ত নানা সমস্যা আছে। কিন্তু সেখানে তো ভারত এভাবে গুলি চালায় না। আমরা বাংলাদেশি বলে আমাদের জীবনের কোনো মূল্য নেই। ভারত থেকে গরু, ফেনসিডিল, মাদক এবং অবৈধ অস্ত্রও নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে পৌঁছের পূর্বে বিএসএফ বা ভারত প্রশাসন কি দেখতে পায় না। আর গরু তো শুধু পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসে না। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আসে। সেখানে কেন আটকানো হয় না? আর তা না বিএসএফ দেখা পেলেই গুলি করে হত্যা করে। প্রথমে ধরে নিলাম যারা অবৈধ ভাবে চোরাচালান করে তারা অপরাধী।
আর অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আইন ও আদালত আছে। কিন্তু অপরাধীর বিচার না করে মানুষকে পাখির মত গুলি এ কেমন রাষ্ট্রের চরিত্র! নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যা একটি সভ্য দেশের কাজ হতে পারে না। এরকম অমানবিক কাজের অবসান দুই রাষ্ট্রকেই করতে হবে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৪,০৯৬ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে, যা পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম স্থল সীমান্ত। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং মিজোরাম রাজ্যের সীমান্ত রয়েছে। সীমান্তে মানুষ হত্যার পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে কেমন সম্পর্ক ভারত – বাংলাদেশ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮ সালে ৬২ জন, ২০০৭ সালে ১২০জন, ২০০৬ সালে ১৪৬, ২০০৫ সালে ১০৪, ২০০৪ সালে ১৩৫, ২০০৩ সালে ৪৩, ২০০২ সালে ১০৫ ও ২০০১ সালে ৯৪ জন বাংলাদেশি নিহত হয়। ২০১৮ সালে পরিস্থিতি কিছুটা ভালো ছিলো। তারপরও ওই বছর বিএসএফ সীমান্তে মোট ১৪ বাংলাদেশিকে হত্যা করে। এরমধ্যে গুলি করে আটজনকে হত্যা করা হয়। অপহরণ করা হয় ১৩ জনকে এবং আহত হন ১৫ জন। ২০১৯ সালে বিএসএফ-এর হাতে নিহত হয়েছেন ৪৩ জন। এরমধ্যে গুলিতে ৩৭ জন এবং নির্যাতনে ছয়জন। অপহরণ করা হয়েছে ৩৪ জনকে। আহত হয়েছেন ৪৮ জন। ২০২০ সালে মোট ৪৮ জন নিহত হয়েছেন। গুলিতে ৪২ জন এবং নির্যাতন চালিয়ে ছয় জনকে হত্যা করেছে বিএসএফ। অপহরণ করা হয়েছে ২২ জনকে। আহত হয়েছেন ২৬ জন।
এই পরিসংখ্যান থেকে নেই যত দিন যাচ্ছে ততই সীমান্তে মানুষ হত্যা বেড়েই চলছে। আমাদের দেশের লালমনিরহাট সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে দুই বাংলাদেশি নাগারিক নিহত হওয়ার পর সীমান্ত হত্যা আবার আলোচনায় এসেছে। এমন কী ভারতীয়রাও এটা নিয়ে কথা বলছেন। সে বছর নভেম্বর মাসেই বিএসএফ-এর হাতে চারজন বাংলাদেশি নিহত হন। দিন পর দিন সীমান্তে মানুষ হত্যার খবর আলোচনায় আসলে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আমাদের দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেন,”সীমান্ত হত্যা ভারতের জন্য লজ্জার। দুই দেশের মধ্যে সিদ্ধান্ত হয়েছে সীমান্তে কোনো ধরনের প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হবে না। গুলি করা হবে না। কিন্তু এটা হচ্ছে।
তাই এটা ওদের জন্য লজ্জার। আর আমাদের জন্য দুঃখের, আমরা জীবন হারাচ্ছি।” সবচেয়ে বড় লজ্জার বিষয় আমাদের রাষ্ট্রের ভূমিকা দেখে কারণ সীমান্ত হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি শুধুই মুখের কথা। সীমান্ত হত্যা নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারিনি সরকার। আর ভারতের আন্তরিকতার কী প্রমাণ এখন পর্যন্ত রেখেছে? ২০১১ সালের জানুয়ারিতে নয়াদিল্লীতে গৃহকর্মীর কাজ করা ফেলানী খাতুন নামে ১৫ বছর বয়সী কিশোরী সেদিন তার বাবার সঙ্গে বাংলাদেশে ফিরছিল। অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করার সময়, ফেলানীর পোশাক কাঁটাতারের বেড়ায় জড়িয়ে যায়।
আতঙ্কিত হয়ে সে চিৎকার শুরু করে। ভারতের সীমান্ত রক্ষা বাহিনী (বিএসএফ) সেই চিৎকারের জবাব দেয় তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে। সেখানেই ফেলানী মারা যায়। নরপশুদের দল তবুও ক্ষান্ত হয়নি মধ্যযুগীয় কায়দায় তার প্রাণহীন দেহটি প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে উল্টোভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। এবং প্রমাণ করে দিয়ে ভারত কত শক্তিশালী একটি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র। ১২ বছরেও শেষ হয়নি ফেলানী হত্যার বিচার বাংলাদেশ পেল না।তার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় নি।
২০১৮ সালে দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে বলা হয়েছিল, সীমান্ত অতিক্রমের ঘটনায় প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার না করার ব্যাপারে দুই দেশই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে মৃতের খবর ছাপানো হচ্ছে তাহলে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির কার্যকারিতা কোথায়? ফলে সীমান্তে আর কোনো মানুষের মৃত্যু দেখতে চাই না। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারত বন্ধু না শত্রু এই বিতর্কিতের অবসান করতে হলে ওই মুক্তিযুদ্ধের বন্ধুত্বের পরিচয় দিতে সীমান্তে হত্যাকাণ্ড শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। দুই দেশের বন্ধুত্বও আরও দৃঢ়তর হোক।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
বন্ধু রাষ্ট্রের সীমান্তে মানুষ হত্যা বড় উদ্বিগ্নতা মুক্তমত রাশেদুজ্জামান রাশেদ