বাংলা ভাষাকে হৃদয়ে ধারণ করতে হবে
৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৪:৫৭
বাংলা ভাষা। আমার মায়ের ভাষা। আমার প্রাণের ভাষা। তাঁজা রক্ত দিয়ে কেনা আমাদের মুখের ভাষা। যে ভাষার অধিকার আদায় করতে গিয়ে সালাম, বরকত, রফিক, জাব্বারসহ কত নাম না-জানা ভাই শহিদ হয়েছে তার হিসেব নাই। তাই এ ভাষা আমার কাছে প্রাণের ভাষা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বুকের তাঁজা রক্ত দিয়ে যারা আমাদের বাংলা ভাষাকে করেছে মর্যাদাপূর্ণ তাদের জানাই সালাম, শ্রদ্ধা।
রক্ত দিয়ে কেনা আমাদের এই ভাষা আজ আর্ন্তজাতিকভাবে স্বীকৃত। এরপরও আমরা কেন জানি এই ভাষার সম্মান আর মর্যাদা ধরে রাখতে পারছি না। ৫২’র ভাষা আন্দোলনে বুকের রক্ত দিয়ে এ ভাষাকে যারা মহান করেছে আজ আমরা যেন তাদের সেই সম্মানটুকুও দিতে পারছি না। রাখতে পারছি না বাংলা ভাষার মান। আমরা এখন বাংলা ভাষাকে অপমান আর অপদস্ত করছি প্রতিনিয়ত। আমার দেশে কিছু কিছু অতিশিক্ষিত রয়েছে যারা বাংলার মাঝখানে ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলতে পছন্দ করে। কথায় কথায় কয়েকটা ইংরেজি বলে বাংলাকে যেমন ছোট করা হয়, তেমনি যারা বলে তারা নিজেকে বড় মনে করে। আমরা ফেসবুকে এখন বাংলায় লিখি না। লিখি ইংরেজিতে বাংলা। যার নাম দিয়েছে বাংলিশ। ঘুরেফিরে তাদর লেখার অক্ষর থাকে ইংরেজি। আমরা আ, ই, ক, খ এখন ভুলে গিয়েছি। ধ ন প ফ আমাদের কাছে এখন পরিচিত শব্দ। এখনও অনেক লোক রয়েছে যারা বাংলা ভাষায় কয়টি অক্ষর রয়েছে সেটিও জানে না। জানলেও বলতে পারে না। বাংলায় যুক্ত বর্ন লিখতে পারে না অথচ ইংরেজিতে অনেক কঠিন শব্দ লিখে ফেলে সহজেই। বাংলা বানান সম্পর্কে আমাদের ধরণা না থাকলেও ইংরেজি গ্রামার সম্পর্কে আমাদের ধারণা প্রচুর। এটাই হচ্ছে আমাদের বাঙ্গালিত্ব।
আজ মনে হড়ে যাচ্ছে ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের সেই কবিতাটি। যেখানে তিনি বলেছেন, ছেলে আমার খুব ‘সিরিয়াস’ কথায়-কথায় হাসে না / জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসেনা। / ইংলিশে ও ‘রাইমস’ বলে ‘ডিবেট’ করে, পড়াও চলে / আমার ছেলে খুব ‘পজেটিভ’ অলীক স্বপ্নে ভাসে না / জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না।
আসলে এমনই হয়ে পড়েছে আমাদের ভাষা। যেখানে আমরা নিজেরাই এখন অন্যভাষাকে প্রাধান্য দিচ্ছি। ভাবতে খুব কষ্ট হচ্ছে, এই আমাদের জন্যই কি ৫২’র ভাষা আন্দোলন হয়েছিলো? আসলেই আমরা বড় অদ্ভুত এক জাতি। আজ আমরা আমাদের নিজস্ব ভাষা ভুলে যেতে বসেছি।
শুধু তা-ই নয়, আমরা এখন আমাদের সংস্কৃতিটাও পরিবর্তন করে ফেলেছি। বাংলা ভাষার সংস্কৃতি, বাংলা সিনেমা, বাংলা নাটক, বাংলা গান, বাংলা গল্প, বাংলা কবিতা, বাংলা উপন্যাস এমনকি বাংলা প্রবন্ধও আমাদের কাছে এখন বিরক্ত লাগে। আমরা ইংরেজি আর তামিল সিনেমা দেখি। আর বেশি আধুনিক হলে হলে হলিউড ছাড়া কিছুই দেখি না। আর রবিন্দ্রনাথ, নজরুলের চাইতে আমাদের কাছে শেক্সপীয়রের বই বেশি গ্রহণযোগ্য। এমনটাই এখন বাংলার চিত্র। আমি বলছি না তামিল সিনেমা না দেখতে, আমি বলছি না শেক্সপীয়রের বই না পড়তে। কিন্তু বাংলাটাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে কেন?
সত্যি বলতে এটা আমার আপনার একার কারণে নয়, এটা আমাদের গোটা সমাজ ব্যবস্থার কারণে। আমরা অন্য সংস্কৃতি আমার দেশে প্রবেশ করতে দিয়েছি। অথচ আমার দেশের সংস্কৃতি অন্য কোথাও প্রবেশ করাতে পারি না। আমরা আমাদের টিভি চ্যানেল গুলো আমাদের দেশের চ্যানেল হাতে গুনে যা পাবো তার দিগুণ পাব বিদেশি চ্যনেল। যার কারণে ছোট ছোট ছেলেরা এখন বিদেশি চ্যানেল এবং ওই ভাষাতেই আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। আমি আর কারো কথা বলবো না। আমার ঘরেই আমার ছোট ভাই প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আলাদিন এবং মোটো-পাতলু নামক দুটি অনুষ্ঠান দেখে। দুটোই হিন্দি ভাষার। তাকে যখন বাংলা মোটো-পাতলু বাংলাটা দেখতে বলি সে আগ্রহ দেখায় না। তার রুচি এখন হিন্দিতে চলে গেছে। আমরা যারা ৯০ এর দশকে জন্ম নিয়েছি তখন বিদেশি চ্যানেল তো দূরের কথা, বিটিভি ছাড়া আর কিছুই দেখতাম না। বেশিরভাগ ঘরেই টিভি থাকলেও সেটা বিটিভিতে সীমাবদ্ধ থাকতো। ছোটবেলায় শুক্রুবার আসলেই বসে থাকতাম বাংলা সিনেমা দেখার জন্য। খেলতে যেতাম না। অথচ এখন আমার ছোট ভাইদের বাংলা সিনেমাতো দূরের কথা বাংলা চ্যানেল দিতেও দেখা যায় না। এই যে বাংলার প্রতি অনিহা এবং অবহেলা। এমন হতে থাকলে আগামী প্রজন্ম এই ভাষাকে নিয়ে গর্ব অহংকার করতে ভুলে যাবে নিশ্চিত।
এভাবে আমরা সমস্ত ক্ষেত্রে আমরা এখন বাংলাকে পেছনে রাখছি। আসলে এটা আমাদের গোঁড়া থেকে সমস্যা। আমরা বাইরে থেকে যতই বলাবলি করি, বাংলা দিয়ে ভালো কোনো চাকরি, ভালো কোনো অবস্থান করতে পারে না এখনকার যুবকরা। যাদের কথার মাঝখানে মাঝখানে ইংরেজি থাকে নিয়মিত, যারা ইংরেজিতে দক্ষ তাদেরকেই সমাজে গ্রহণ করে ভালোভাবে। তাই সমস্যা আমাদের গোঁড়ায়। আর কিছু সমস্যা আমাদের মানসিকতার। আমাদের পারিবারিক শিক্ষারও আছে। সন্তানকে যেটার উপর উৎসাহি করবে সন্তানতো সেদিকেই যাবে। তবে দিন শেষে নিজের ভাষার প্রতি সম্মানটুকু যেন থাকে সেটাও আমাদের সকলের খেয়াল রাখা উচিৎ।
তাই আসুন, আমরা আমাদের ভাষাকে সম্মান করি। আমরা আমাদের ভাষাকে সম্মান করলে, এসব আপনা-আপনি ঠিক হয়ে যবে। তাই আমাদের প্রয়োজন বাংলাকে প্রাধান্য দিয়ে সবকিছু করা। বাংলার সাথে যেন অন্যকোন ভাষা মিশ্রিত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে বাংলা আমাদের গর্ব, বাংলা আমাদের অহংকার।
লেখক : কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই