বইমেলা, বইয়ের মূল্য ও শখের বই পড়া
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৮:৩৬
প্রাণের বইমেলা চলছে। প্রচুর লোকের সমাগম হচ্ছে। সমাগম বলতে বইয়ের পাঠক, ক্রেতা, বিক্রেতা, প্রকাশক সবাই আসছে। তবে বই কেনার চেয়ে অনেকের সাথে দেখা করা, গল্প করা, আড্ডা দেওয়া, প্রিয়জনের সাথে সময় কাটানো, চা-কফি খাওয়া এসবের মানুষও কম নয়। হয়তো বেশিই হবে! সেই সাথে প্রতিদিন প্রচুর সংখ্যক নতুন বই আসছে মেলায়। গণমাধ্যমের সংবাদে দেখলাম, কবিতার বই সবচেয়ে বেশি আসছে। তুলনামূলক কম আসছে গল্প,প্রবন্ধের বই। এটাই হওয়ার কথা। কারণ আমার জানা মতে, একজন সাহিত্য সম্পাদককে প্রতিদিন যে সংখ্যক কবিতা বাছাই করতে হয়, তার তুলনায় গল্প বা প্রবন্ধের সংখ্যা থাকে হাতে গোণা। অর্থাৎ কবিতার চর্চা হচ্ছে অনেক বেশি। কবির সংখ্যা বেশি। আসলে কবিতা লেখা কি একটু বেশিই সহজ? নাকি সময় কম লাগে বলে বেশি? এর কোনটা উত্তর হবে? তা আসুক।
তাও তো সাহিত্য চর্চা হচ্ছে এটাই যথেষ্ট। যত বেশি সাহিত্য চর্চা হবে তত বেশি সুস্থ সংস্কৃতি গড়ে উঠবে। এবার আসছি এবারের বইমেলার বইয়ের দাম নিয়ে। কারণ বই কিনতে টাকা লাগে। দেশে সবকিছুর দাম বেড়েছে। কাগজের দাম গত কয়েক মাসেই উচ্চমূল্য ছুঁয়েছে। সেই প্রভাব পরেছে বইমেলায়ও। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি বই কিনতে যে হিসেব করেই কিনতে হবে সেকথা বলাই বাহুল্য। কারণ বই তো আর পেটের ক্ষুধা নিবারণ করতে যথেষ্ট নয়। মনের ক্ষুধা তখনই যথেষ্ট হয় যখন পেটের ক্ষুধা পূর্ণ থাকে। এই দুয়ের মধ্যে পেটের ক্ষুধাই সর্বাগ্রে। শখ করে বই কেনার মতো সময় হয়তো এখন নয়। তবে বছরের এই একটা সময় এত বিপুল সংখ্যক বই দেখার সুযোগ বই পড়–য়াদের ভাগ্যে খুব একটা জোটে না। ফলে অনেকেই এখানে আসেন, বই কিনেন। তবে বই কিনে সকলে পড়েন কি না সে কথার নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। কারণ ক্রেতা মাত্রই যেমন ভোক্তা নয় সেভাবেই বইয়ের ক্রেতা মানেই পাঠক নয়। হয়তো সেই বইটাই আবার পুরোনো হলে কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে, এবং তার পাঠক হচ্ছেন ভিন্ন একজন মানুষ। যাই হোক, এবার বই প্রকাশে প্রকাশকদের সত্যি প্রচন্ড বেগ পেতে হয়েছে। কারণ যে হারে কাগজের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে, সেভাবে কিন্তু বইয়ের মূল্য বৃদ্ধি করা যায়নি। সেটি করলে তা হতো কেবল প্রদর্শন মেলা। ক্রেতা থাকবে হাতে গোণা।
বেশি দামী বই কিনতে শখ থাকলেও সাধ্য অনেকের থাকে না। ফলে শখের বই যারা পড়েন তারা বই কিনতে একটু হিমশিম খেতেই হচ্ছে। অথচ এই সময় বই বিক্রিতেই প্রকাশক, বইয়ের প্রকাশের সাথে জড়িত কতশত মানুষের জীবিকা জড়িত থাকে। লেখক, প্রকাশক, প্রকাশনা শিল্পের কর্মী, স্টলে কর্মরত বিক্রয়কর্মী আরও বহু মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয় এ সময়। আর কাগজ শিল্পের বেশি দরকার হয় বছরের এই সময়। কাগজ শিল্পের কথায় মনে পরে গেলো, এ বছর কাগজের অবস্থা ত্রাহি ত্রাহি। কাগজ সংকটের অবস্থা এমন যে প্রকাশকরা রীতিমতো প্রমাদ গুণছেন। কয়েকগুণ বেশি দাম দিয়ে কাগজ কিনতে হয়েছে। অথচ বইয়ের দাম যদি সে অনুপাতে বৃদ্ধি পায় তাহলে ক্রেতার আগ্রহ হারাবে, সেই চিন্তায় বইয়ের দাম সীমিতা বাড়ানো হয়েছে। এই সীমিতই বহু ক্রেতার জন্য চাপ হয়েছে। কারণ দাম তো কেবল বইয়ের বৃদ্ধি পায় নি। দাম বৃদ্ধি পেয়েছে বেঁচে থাকার সকল উপকরণের। কিন্তু আয় তো সে তুলনায় বাড়েনি। ফলে যে চাপে চলতে হচ্ছে সেই চাপের ভেতর একটি অতিরিক্ত খরচ করার মানসিকতা নেহায়েত একজন বিমুগ্ধ পাঠক ছাড়া কারও থাকার কথা নয়। সেই যে বিখ্যাত উক্তি, বই পড়ে কেউ দেউলিয়া হয় না’ এই উক্তির এখনও সত্য হলেও আগে জঠরের চাহিদা নিবৃত্তি এটাও তো সত্য কথা। আর বইয়ের পাঠকের তো আর কোনো শ্রেণি নেই।
নিন্মবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত সব শ্রেণিতেই বইয়ের পাঠক আছেন। একটা সুবিধা এখন আছে, প্রত্যন্ত এলাকায় বসেও ইচ্ছেমতো বই অনলাইনে অর্ডার দিয়ে ঘরে বসে পাওয়া যায়। আগে তো তা ছিল না। স্বশরীরে হাজির হয়ে বই কিনতে হতো। এখনও ইচ্ছে করলেই সেটাও করা যায়। কিন্তু এই যাওয়া আাসার খরচও তো নেহায়েত কম নয়। মোট কথা প্রশ্নটা খরচের। সেটা ভাবতেই হবে। কারণ আর্থিক পরিস্থিতিতে ক্রেতার পকেটও ভারী নয়। ফলে তারা আছেন উভয় সংকটে। আর লেখকদের সংকটের কথা তো বলার দরকার নাই। বিক্রির পরে তো লভ্যাংশের প্রশ্ন আসবে! তবে বইমেলা হচ্ছে সেটাই অনেক। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিপুল আয়োজনে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। বাঙালির প্রাণের উৎসব অমর একুশে বইমেলা সবার মাঝে এক অন্যরকম অনুভূতি আনে। করোনার পর থেকে প্রকাশনা শিল্পের অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। তারপরও প্রচুর নতুন বই প্রকাশিত হচ্ছে। এর অর্থ এই যে, বইয়ের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে। বইমেলার সাথে জড়িত প্রকাশক, ছাপাখানার কর্মী এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সকলেই তাকিয়ে থাকে বইমেলার দিকে। কারণ এটাও একটা শিল্প এবং এখানেও রুটি-রুজির বিষয় জড়িত। গত বছরের বইমেলায় ৩ হাজার ৪১৬টি নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে। ৩১ দিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত বইমেলায় প্রায় ৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। বইমেলায় লেখকরাও অপেক্ষায় থাকে। সাহিত্য হলো দেশের মননশীলতার প্রাণ। আর সাহিত্যচর্চার এবং বিকাশের অন্যতম কেন্দ্র হলো বইমেলা। লেখক ও পাঠকের মিলনমেলায় পরিণত হবে বইমেলা। বইপ্রেমীরা সারা বছর অপেক্ষা করে থাকে ফেব্রুয়ারি মাসের জন্য। নতুন বই নতুন লেখক কবির মিলনস্থল এই বইমেলা। পুরাতন পাঠকদের সাথে যোগ হয় নতুন প্রজন্মের বই পড়য়া পাঠকরা। এই পরিবেশ দেশের সাহিত্য সংস্কৃতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে, অনুপ্রেরণা যোগায়। তবে শখ করে বই কেনা ও পড়ায় এখন কিছুটা লাগাম ক্রেতাদের টানতেই হচ্ছে। কারণ শখের ওপরেও রয়েছে জীবনের বাস্তবতা!
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এজেডএস