সমাজে শিষ্টাচার ফিরবে কবে?
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২০:৪২
আচার-আচরণে শিষ্ট তথা শালীন ও সুন্দর হওয়াই শিষ্টাচার। এক কথায়, সুন্দর আচরণ ও ব্যবহারই হল শিষ্টাচার। সে আচরণ হতে হবে- কথাবার্তায়, কাজকর্মে, চলনে-বলনে, রীতিনীতিতে; সর্বোপরি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। যাকে বলে আদব-কায়দা মেনে চলা বা ভদ্র ব্যবহার ও সৌজন্যবোধ দেখানো; তাই মূলত শিষ্টাচার। সত্যিকারের মানুষের পরিচয় তার শালীন, সংযত ও বিনয়ী ব্যবহারে।
আমাদের বর্তমান সমাজ-সভ্যতায় মানুষের প্রতি মানুষের বিনয়, শ্রদ্ধা-স্নেহও সম্মানবোধ প্রায় উঠে গেছে। মানুষ ক্রমশঃ ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র মানসিকাতায় আরোহন করছে। জীবনের প্রায় সবকিছুতে নিজস্ব চিন্তা, আদর্শ ও দর্শনের অনুকরণে ডুবছে। অপরের মত, অন্যের চিন্তা-দর্শন একেবারেই সহ্য করতে পারছে না। যার ফলে সামাজিক বিভাজন সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষে মানুষে সমাজিক ঐক্য গড়ে উঠছে না। নানা মতাদর্শিক কারণে বিভেদ দানা বাঁধছে। শিষ্ট আচরণ এবং স্বাধীন ব্যক্তি ও সামাজিক সত্তাকে অগ্রাহ্য করে নিজে যেটা ভালো মনে করছি সেটা প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় স্বৈরাচারী হয়ে উঠছি।
বর্তমানে সমাজে কর্মের চেয়ে অকর্ম আর ধর্মের চেয়ে অধর্ম চর্চা হচ্ছে বেশি। এজন্যই বোধহয় কবি ইকবাল বলেছেন, ‘কর্মেই গড়ে মানুষের জীবনসত্তা, কর্মেই বণ্টিত হয় জান্নাত-জাহান্নামের ফায়সালা।’ পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ যদি শিষ্ট হতো, তার নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব-কর্তব্য সততার সাথে যথাযথভাবে পালন করে তবে খুব অল্প সময়ে সমাজ বদলে যাবে। প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্য, মানবিকতা ও সামাজিক সুবিচার। আমরা জানি, দায়িত্ব হচ্ছে কোন যথোপযুক্ত ব্যক্তি বা সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত নীতিমালা বা বিধি-নিষেধ, যেটা করতে মানুষ বাধ্য। সোজা কথায়, দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে যা করতেই হবে তাই দায়িত্ব। না করলে জবাবদিহি করতে হবে। অন্যদিকে, কর্তব্য হচ্ছে-যেটা মানুষের করা উচিত কিন্তু না করলে সমস্যা হতে পারে বা নাও হতে পারে। সাধারণত আগ্রহ ও আন্তরিকতা সহকারে দায়িত্ব সম্পাদন করাই কর্তব্যপরায়ণতা। অর্থাৎ, কর্তব্য ঐচ্ছিক আর দায়িত্ব আবশ্যিক বিষয়।
সমাজ এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, মানুষ অসৎ কাজে বাধা প্রদানের সৎ সাহস হারিয়ে ফেলছে। চোখের সামনে অপরাধ সংঘটিত হতে দেখেও প্রতিবাদ করে না। নিরবতা পালন করে। এভাবে অসৎ মানুষের ঘৃণ্যকর্ম বিস্তৃত হচ্ছে। মানুষ যে সভ্য জীব। ব্যক্তি জীবনের পাশাপাশি তারও যে সামাজিক কিছু দায়-দায়িত্ব রয়েছে তা বেমালুম ভুলতে বসেছি আমরা।
আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের পরিধি বিস্তৃত। মানুষ একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করবে। সে খেয়ালখুশি অনুযায়ী চলতে পারে না। সমাজের সবার সুবিধার্থে ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগ করে কর্তব্যনিষ্ঠ হতে হয়। সমাজের অর্থ-বিত্তশালী ব্যক্তিও কাজকর্ম ছাড়া অলসভাবে জীবন অতিবাহিত করতে পছন্দ করে না। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবনে সব মানুষের প্রতি পারস্পারিক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে আমাদের। তাই আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী মানুষকে দায়িত্বশীল ও কর্তব্যপরায়ণ হতে হবে।
আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বায়োজ্যেষ্ঠ ও বয়ঃকনিষ্ঠ সবার প্রতি পারস্পারিক দায়িত্ববোধ রয়েছে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে সব সময় পিতা-মাতার আদেশ-নিষেধ মান্য করা এবং তাদের সঙ্গে সৌজন্যময় আচরণ করা মানুষের একান্ত কর্তব্য। এছাড়াও সন্তান-স্ত্রী-পরিজনের প্রতি বিশেষ কর্তব্য রয়েছে। পিতা-মাতার প্রতি অবহেলা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। শুধু তাই নয়, সহকর্মী, বন্ধুবান্ধব ও সহপাঠীদের সঙ্গে কোনো রকম অপ্রীতিকর কর্মকান্ড ও দ্বন্দ্ব-কলহ করা যাবে না। সর্বদা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে হবে। তাদের সাথে কোমল আচরণ করতে হবে, এমনকি তাদের উপাস্যদের নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করা যাবে না। শিক্ষার্থী বন্ধুদের বই, খাতা, কলম, পেনসিল না থাকলে এগুলো দিয়ে তাকে সাহায্য করা কর্তব্য। পিতা-মাতা যেমন সন্তানের লালন-পালন করেন, তেমনি শিক্ষকগণও ছাত্র-ছাত্রীদের প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে তোলেন, তাই শিক্ষকদের যথাযথ শ্রদ্ধা করা, তাদের আদেশ-নিষেধ মেনে চলা উচিত। এগুলোই শিষ্টাচার। আমরা কতোটুকু এসব শিষ্ট আচরণ করতে পারছি?
সমাজ, দেশ ও জাতির উন্নয়ন এবং অগ্রগতি প্রত্যেক মানুষের নিজ নিজ দায়িত্ব কর্তব্যপরায়ণতার ওপর নির্ভরশীল। এখন শ্রদ্ধাবোধ বিলুপ্ত প্রায়। মূল্যবোধের অভাবে ঘটেছে সামাজিক অবক্ষয়। তাই সমাজ তথা দেশ আজ হাজারো সমস্যায় জর্জরিত। দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, লুটপাট, ছিনতাই, হত্যা, গুম, সন্ত্রাস, অন্যায়-অবিচার, হিংসা, অহংকার এতো অধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে যে এ দেশের জনগণ দিগি¦দিক ছুটছে একটু শান্তির আশায়। মানুষে মানুষে বিদ্বেষ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রত্যেককে-ই নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্ক সমন্ধে আরও সজাগ হতে হবে। জবাবদিহিতার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে।
আদর্শবান লোকেরাই একটি আদর্শ সমাজ গড়ে তুলতে পারে। এখন কবি সাহিত্যিক শিক্ষক সাংবাদিক সমাজকর্মী থেকে শুরু করে এনজিও কমী পেশাজীবী! কারোর মাঝেই সার্বজনীন আদর্শ খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রায় সবাই এখন চাটুকারিতা ও দালালিতে মগ্ন। মনে রাখতে হবে, শিষ্টাচার বা সৌজন্যেবোধ হলো মানুষ মানব চরিত্রের অলঙ্কার।
চমৎকার আচার-আচরণে, বিনম্র ব্যবহারে, সৌজন্যবোধে, ভদ্রতায় উত্তম মানুষের প্রকৃত পরিচয় নিহিত। শিষ্টাচার সামাজিক পরিবেশ শান্তিময় করে, জীবনকে করে সুন্দর। জাতীয় জীবনে সুনাম ও সমৃদ্ধি আনয়ন করে। মনীষী এডিসনের ভাষায়, ‘শিষ্টাচার উপরওয়ালাকে অমায়িক সমভাবাপন্ন, সমপর্যায়ের লোকদের প্রীতিকর আর অধঃস্তনদের মেনে নিতে বাধ্য করে। তাই ব্যবহারটাই মানুষের মার্জিত এবং শোভন হওয়া উচিৎ অথচ নৈতিক অবক্ষয়ের ক্রান্তিলগ্নে পরস্পর পরস্পরের প্রতি যে ব্যবহার আমাদের সমাজে পরিলক্ষিত হচ্ছে তা কখনো আমাদের জন্যে কল্যাণময় হতে পারে না।
আমাদের দেশে এক রাজনীতিক অপর বিরোধী রাজনীতিককে সহ্য করতে পারে না। এক হুজুর অপর হুজুরকে, এক কবি অপর কবিকে, এক সাংবাদিক অপর সাংবাদিককে এভাবে একই পেশার ও মতের মানুষ অপর পেশা ও মতের মানুষকে সহ্য করতে পারছে না। তো যা হবার তাই হচ্ছে, সামাজিক ঐক্য বিনষ্ট হচ্ছে। যার ফলে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধন হচ্ছে না।
আমরা কী দেখছি? জনগণের অর্থে পরিচালিত সংসদে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়কালে রাজনীতিবিদদের রূঢ়, অশোভন ব্যবহার টেলিভিশনের পর্দায় অনেকবার লক্ষ্য করেছি। মিছিলের মধ্যেও অমার্জিত, অশ্লীল বাক্য আমরা অনেক সময় শ্রবণ করেছি। অনেক সময় এমনও দেখা যায় নিজ দলের ভেতর অন্তর্দ্বন্দ্ব। আর যাই হোক, সুন্দর শিষ্ট ভালো ব্যবহার আমরা আমাদের প্রজন্মকে শেখাতে ব্যর্থ হচ্ছি। সেটা পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্র এবং রাজনীতিতেও।
সমাজ জীবনে মনীষী কিমারের একটি মূল্যবান বাণী আমাদের সবসময় স্মরণ রাখা উচিৎ। তিনি বলেছেন, ‘সংসারের প্রত্যেকের সাথে ভালো ব্যবহার করো কারণ কখন কার সাহায্য প্রয়োজন হয়ে পড়বে বলা যায় না।’ মানুষের সাথে ব্যবহার সম্পর্কে সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন ডা. লুৎফর রহমান বলেছেন, ‘মানুষের সঙ্গে নিষ্ঠুর ব্যবহার করে যে খোদার সঙ্গে প্রেম করতে চায় তার বুদ্ধি কম।’
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক : ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, যশোর
সারাবাংলা/এজেডএস/এসবিডিই