ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২১:০৮
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সাথে জড়িত এক অনবদ্য নাম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার অগ্রগামী নেতৃত্বে বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছিল তিনি বঙ্গবন্ধু। ভাষা আন্দোলন থেকে ধারাবাহিক বিভিন্ন আন্দোলনের থেকে সবশেষ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ কোথাও তার অবদানের কমতি ছিল না কখনোই।
১৯৪৭ এ দেশভাগের পর যখন পশ্চিম পাকিস্তানিরা উর্দু ভাষা রাষ্ট্রভাষা করার মাধ্যমে বাঙালিদের মুখ চেপে ধরতে চেয়েছিলেন তখন থেকেই অন্যান্যদের সাথে এ ভাষা আন্দোলনের প্রথম থেকেই সরব ভূমিকায় ছিলেন বঙ্গবন্ধু।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি জাতির পিতার নেতৃত্বে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। ভাষা আন্দোলনসহ বাংলাদেশের সকল ইতিহাসে এই সংগঠনটির ভূমিকা ছিল অনবদ্য। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ছাত্রলীগের ১০ দফা দাবির মধ্যে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার ও সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের নিয়োগ এবং বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষার দাবি ছিল অন্যতম দাবি।
‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনেও মূল ভূমিকায় ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সংবিধান সভায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। কিন্তু কেবল উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করতে চায় মুসলিম লীগ। বঙ্গবন্ধু এতে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার বিরাট ষড়যন্ত্র মনে করেন। (সূত্র: কানাই চক্রবর্তী, বাসস, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২)।
এ বিষয়ে জাতির জনক নিজেই তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘আমরা দেখলাম, বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমুদ্দুন মজলিস এর প্রতিবাদ করল এবং দাবি করল, বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। আমরা সভা করে প্রতিবাদ শুরু করলাম। এই সময় পূর্ব পাকিস্তন মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস যুক্তভাবে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে একটা ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করল।’
বঙ্গবন্ধু তার নিজ লেখায় বলেছেন, ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ গঠনের মাধ্যমে আমাদের আন্দোলন শুরু হয়। সেদিনই সকাল ৯ ঘটিকার সময় আমি গ্রেপ্তার হই। আমার সহকর্মীদেরও গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর ধাপে ধাপে আন্দোলন চলতে থাকে।
শুধু যে জাতির পিতাই নিজের গ্রন্থে বলেছেন তা নয়। দেশের অন্যান্য অনেক লেখক ও বুদ্ধিজীবিগণ তাদের লেখায় জাতির পিতার ভাষা আন্দোলনের অবদানের কথা উল্লেখ করেছেন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সারাদেশে সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। যা ছিল এদেশের প্রথম সফল হরতাল। এবং এই হরতালে শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে তিনি সেসময় গ্রেপ্তার হন।
ভাষাসৈনিক অলি আহাদ তার ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার নিমিত্তে শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ হতে ১০ মার্চ ঢাকায় আসেন।’ বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ও মোনায়েম সরকার সম্পাদিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জীবন ও রাজনীতি’ শীর্ষক গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘স্বাধীন পাকিস্তানের রাজনীতিতে এটিই তাঁর প্রথম গ্রেফতার।’
ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় এক সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে পূর্ববাংলা আইন পরিষদ ভবন অভিমুখে এক মিছিল বের হয় এবং সে মিছিলে সভাপতিত্ব করেন সদ্য কারামুক্ত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।
মিছিল ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের সময় বেশ কিছুটা বাড়াবাড়ি হয়েছে বলে বঙ্গবন্ধুর বর্ণনা থেকে পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, ‘এমএলএ-দের বিরুদ্ধে মোটামুটিভাবে বিক্ষোভ হয়। তাদের গালাগালি ও অনেকক্ষেত্রে মারধর করা হয়। মোয়াজ্জেম ডাক্তার নামে বাগেরহাটের এক এমএলএ-কে ধরে নিয়ে মুসলিম হলে ছাত্ররা আটক করেছি। সেখানে গিয়ে আমি তাঁকে ছাড়াই। শওকত সেদিন সন্ধ্যা বেলায় বেশ আঘাত পায় পুলিশের হাতে।” (সূত্র : ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ- কতিপয় দলিল, ২য় খণ্ড, কৃত- বদরুদ্দীন উমর : ঢাকা, বাংলা একাডেমি, ১৯৮৫ : পৃ. ৩২৫)।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মূল পর্বের পুরো সময়টাতেই জেলে ছিলেন বাংলাদেশ সৃষ্টির কারিগর ও সৃষ্টির পেছনের অনবদ্য নাম শেখ মুজিবুর রহমান। তৎকালীন সময়ে মাঠপর্যায়ে আন্দোলন করতে না পারলেও তিনি জেলে বসে সার্বিক খোজ-খবর রেখেছিলেন এবং প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনাও দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে ভাষা সৈনিক গাজীউল হক তার স্মৃতি কথায় (আমার দেখা আমার লেখা, পৃষ্ঠা-৪০) লিখেছেন, ‘১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে গ্রেপ্তার হওয়ার পর জনাব শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন জেলে আটক ছিলেন। ফলে স্বাভাবিক কারণেই ’৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে জেলে থেকেই তিনি আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিতেন।’
ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সময়েও একুশের প্রথম বার্ষিকী উদযাপনেও ছিল জাতির জনকের অপরিসীম অবদান। সেদিন সে বার্ষিকীর পুরো আয়োজন জুড়ে তিনি ভূমিকা পালন করেছিলেন। আরমানিটোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি সেদিন একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং অবিলম্বে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলনের চেতনায় গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। তৎকালীন সময়ে তিনি সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবে বাংলা ভাষার উন্নয়নেও অগ্রণী ভুমিকায় ছিলেন।
বাংলা ভাষায় দেশের প্রথম সংবিধান লিখিত হয়েছিল ১৯৭২ সালে যা ছিল এদেশের প্রথম সংবিধান। যেখানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয় এবং এটি লেখা হয়েছিল জাতির জনকের উদ্যোগেই।
বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য ধারাবাহিক যে আন্দোলন হয়েছিল তার শুরু ছিল এই ভাষা আন্দোলন। এই আন্দোলনের সূত্র ধরেই ধাপে ধাপে বাঙালিদের স্বকীয়তার মাধ্যমে বাংলাদেশের সৃষ্টি। যা পরতে পরতে নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা আন্দোলনে জাতির জনকের ভূমিকা বাংলাদেশের ইতিহাসে যেমন আজীবন লেখা থাকবে তেমনি তা আজীবন শ্রদ্ধাভরে স্মরণীয় হবে বাঙালির প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
লেখক: শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী
সারাবাংলা/এজেডএস