বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৩:২৫
মানুষের মনের ভাব, আনন্দ-বেদনা, ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা সবকিছু স্বদেশী ভাষা তথা মাতৃভাষাতেই যথার্থভাবে প্রকাশিত হয়। একটি জাতির সামগ্রিক উন্নয়নে সর্বস্তরে সে জাতির মাতৃভাষার প্রচলন অপরিহার্য।
বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এটি একটি প্রাচীনতম ও ঐশ্বর্যমন্ডিত ভাষা। বহু বাধা-বিঘ্ন আর চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ক্রমশ এ ভাষা বিকশিত হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বহুবিধ অপচেষ্টা ও ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হলেও বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের ভালোবাসা ও আন্তরিকতায় বিশ্বজুড়ে বাংলা পেয়েছে অত্যন্ত সম্মানজনক আসন। মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত ৫২’র ভাষা আন্দোলন। ভাষার জন্য আত্মদানের এমন বিরল দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই।
কবি রামনিধিগুপ্ত বলেছেন-
“নানান দেশের নানা ভাষা।
বিনে স্বদেশী ভাষা পূরে কি আশা”
সমগ্র বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষা এখন সমাদৃত। এ ভাষার মর্যাদা আজ পৃথিবীজুড়ে প্রতিষ্ঠিত। জাতিংসঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কোর ঘোষণা অনুযায়ী ২১ ফেব্রুয়ারি তথা শহিদ দিবস “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে’র মর্যাদায় অভিষিক্ত। বাংলা ভাষা ও ভাষা শহিদের সম্মানে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর সংস্থাটি এ ঘোষণা দেয়।
পৃথিবীজুড়ে সমাদৃত ও সম্মানিত হলেও অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় খোদ বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে বাংলা ভাষা যেন অবহেলিত। অযত্ন অনাদরে পড়ে আছে দুঃখিনী বাংলা। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন ও ব্যবহারে যে স্বপ্ন নিয়ে রক্ত দিয়েছিলেন বাংলার দামাল ছেলেরা, তাঁদের সে স্বপ্ন যেন আজ ক্রমশ ফ্যাকাশে হতে শুরু করেছে। ব্যাক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, আইন-আদালত, গণমাধ্যমসহ সর্বত্রই উপেক্ষিত বাংলা। শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষত উচ্চ শিক্ষায় বাংলা ব্যবহার নেই বললেই চলে। অথচ ভাষাগত দিক থেকে বাংলা যথেষ্ট সমৃদ্ধশালী। তথাপি বাংলা যেন নিজভূমে পরবাসী।
কবি মাইকেল মুধুসূদন দত্তের ভাষায়-
“হে বঙ্গ, ভান্ডারে তব বিবিধ রতন;-
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি।
সর্বস্তরে বাংলা চালু শুধু আবেগের বিষয় নয়, দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির সঙ্গেও এটি সম্পৃক্ত। গণতান্ত্রিক রীতিপদ্ধতি ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে অফিস-আদালত ও জনতার ভাষার মধ্যে সাযুজ্য থাকা জরুরি। বিচার প্রার্থী সাধারণ মানুষ আদালতের ভাষা বুঝতে না পেরে অতিরিক্ত খরচ ও হয়রানির স্বীকার হয়, যা ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। ঠিক একই রকমভাবে, বিদেশি ভাষায় বর্ণিত জ্ঞান কিংবা রচিত গ্রন্থ যতই মূল্যবান ও তথ্য সম্বলিত হোক না কেন তা নিতান্তই অর্থহীন, যদি তা মাতৃভাষায় অনূদিত হয়ে শিক্ষার্থীর মস্তিষ্কে না পৌছায়। অর্থাৎ উপলব্ধির জন্য শেষ পর্যন্ত মাতৃভাষার সাহায্য নিতেই হয়। শুদ্ধ স্বদেশি সাংস্কৃতিক চর্চা ও উন্নয়ন, একটি আত্মনির্ভরশীল ভাষাগোষ্ঠী হিসেবে বিশ্বের বুকে শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার অতিব জরুরি। সর্বোপরি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য স্বল্প ব্যবহৃত জগাখিচুড়ি বাংলা ভাষা নয়, একটি সমৃদ্ধ ও উন্নত ভাষা রেখে যেতে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর আন্দোলনকে বাস্তবায়ন করতে হবে এখনই।
১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, আমি ঘোষণা করছি আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা পায় বাংলা। সংবিধানের ৩য় অনুচ্ছেদে লেখা হয়, “প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা” সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দিলেও সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার খুব একটা লক্ষ্য করা যায় না। ফলে ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ “বাংলা ভাষা প্রচলন আইন-১৯৮৭’ প্রণয়ন করা হয়। ওই আইনের ৩ (১) ধারায় বলা হয়েছে ‘এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস-আদালত, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সাথে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখিত হইবে। এই ধারা মোতাবেক কোন কর্মস্থলে যদি কোন ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় আবেদন বা আপীল করেন তাহা হইলে উহা বেআইনি ও অকার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে।’ এই আইনটিও ব্যর্থ হলে ১৯৯৮ সালের শেষদিকে ‘বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ’ গঠন করা হয়। এর কর্মপরিধির মধ্যে অন্যতম ছিল বৃটিশ আমল থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও আদালতের প্রযোজ্য ইংরেজিতে প্রণীত আইন বাংলা ভাষায় রূপান্তর। এ কার্যক্রমটি কিছুদিন জোরেশারে চললেও এক সময় তা গতি হারিয়ে ফেলে। আজ এর অস্তিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে।
ব্যক্তি পর্যায়ে থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে এ ভাষা ব্যবহারযোগ্য। ধ্বনিতাত্ত্বিক দৈন্য কিংবা প্রয়োগিক কোনো সমস্যাও এ ভাষার নেই। কতিপয় সমস্যা লক্ষ্য করা যায়, যা সমাধানযোগ্য যেমন-
বাংলা পরিভাষাগত জটিলতা।
মানসম্পন্ন অনুবাদ শব্দ তৈরি ও ব্যবহার অদক্ষতা।
সরকারি কাজ-কর্মে সাধুভাষার ব্যবহার।
আইন-আদালত সংক্রান্ত, বৈজ্ঞানিক, ও চিকিৎসাবিষয়ক শব্দাবলীর অনুবাদে জটিলতা।
উচ্চ শিক্ষায় মানসম্পন্ন বইয়ের অভাব।
সাম্রাজ্যবাদী বিদেশি ভাষার আগ্রাসী থাবা।
অবাধ আকাশ সংস্কৃতি।
বাংলা ব্যবহারে হীনমন্যতা।
সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে সমস্যা ও তা থেকে উত্তরণের জন্য ভাষাসৈনিকসহ দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীগণ দিকনির্দেশনামূলক সুপারিশ ও মতামত প্রদান করেছেন। নিম্নে কতিপয় সুপারিশ ও মতামত তুলে ধরা হল। বাংলাদেশের সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন না হবার পেছনে রাজনৈতিক উদাসীনতা এবং সরকারি উদ্যোগহীনতাকেই দায়ী মনে কনেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। স্কুল-মাদ্রাসায় ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাব্যবস্থার এই বিভাজনও তাঁর মতে সমভাবে দায়ী। এ থেকে উত্তরণের জন্য তিনি বলেন- “সরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নিতে হবে। মাতৃভাষায় শিক্ষার প্রচলন করতে হবে। একই দেশে তিন ধরণের শিক্ষা পদ্ধতি নয়, ধনী-দরিদ্র সবার জন্য একধরণের শিক্ষা চালু করতে হবে। পাশাপাশি বাংলা ভাষায় প্রচুর সাহিত্য লেখা ও গবেষণা করতে হবে যাতে ভাষা আরো সমৃদ্ধ হয়।
সব ক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহারে সবচেয়ে বড় বাধা হীনমন্যতা। এমন কিছু নেই যা বাংলায় প্রকাশ করা যায় না। তারপরও দীর্ঘ চেষ্টার পর সব ক্ষেত্রে বাংলার প্রচলন করা যায়নি। এমন মন্তব্য বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের। আহমদ রফিকের মতে, সর্বক্ষেত্রে বাংলা প্রচলন না হওয়ার পেছনে শ্রেণিস্বার্থ দায়ী। ভাষা সৈনিক সুফিয়া আহমেদ মনের করেন, বাংলা একাডেমি বা এ ধরণের প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিক যতটা কাজ করা উচিত ততটা করছে না।
ভাষা শহিদদের রক্তের মর্যাদা রক্ষা ও বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন অপরিহার্য। এজন্য খুব বেশি কিছু করতে হবে না। শুধু প্রয়োজন ভাষার প্রতি একটু ভালোবাসা ও আন্তরিকতা কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো শুধু ফিরে আসতে হবে-
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃভাষা রূপ খনি, পূর্ণ মণিজালে।
লেখক: শিক্ষার্থী
সারাবাংলা/এসবিডিই