Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন: ৭১ বছরেও নিশ্চিত হয়নি

ইমরান ইমন
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৬:২২

বাংলা আমাদের প্রাণের ভাষা, মাতৃভাষা। ১৯৫২ সালে ভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত ও সফিউররা। তাদের এ মহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি মাতৃভাষা বাংলা। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনই পরবর্তীতে সকল স্বাধীকার আন্দোলনের বীজ রোপিত করেছিল। ভাষা আন্দোলনই ছিল ঔপনিবেশিক দাসত্ব ও শাসন-শোষণ-নিপিড়নের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম প্রতিরোধ এবং জাতীয় চেতনার প্রথম উন্মেষ। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই অর্জিত হয়েছে আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের।

বাংলা শুধু এখন বাংলাদেশের ভাষা নয়, বাংলা এখন একটি আন্তর্জাতিক ভাষা। বিশ্ব ইতিহাসে ভাষার জন্য রক্ত দেয়ার প্রথম দৃষ্টান্ত আমাদের মাতৃভাষা বাংলার। বিশ্বের বুকে বাংলা এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সৃষ্টিকারী ভাষা হিসেবে পরিচিত। আর এই পরিচয় দেয়ার প্রথম অবদানটুকু হলো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। ১৯১৩ সালে তার অমর কাব্য ‘গীতাঞ্জলি’ তাকে এনে দেয় ‘নোবেল পুরস্কার’ আর এর মাধ্যমে বিশ্ববাসী জানতে পারে বাংলা ভাষার কথা, শুরু হয় বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া।

১৯৭১ সালে দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পর বাংলা ভাষাকে বিশ্বায়নের পূর্ণরূপ দেয়ার জন্য জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তার এই উদ্যোগের প্রথম বাস্তবায়ন হয় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে। জাতিসংঘের কার্যক্রম পরিচালিত হয় পাঁচটি ভাষায়। সব দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী তথা জাতিসংঙ্গের নিযুক্ত প্রতিনিধিরা উক্ত পাঁচটি ভাষার যেকোনো একটি ভাষায় ভাষণ দেন। একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ২৩ মার্চ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে বাংলায় ভাষণ‌ দেওয়ার ফলে বিশ্ববাসী জানতে পারে বাংলা ভাষার কথা।

১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো কর্তৃক বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ফলে বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষার মর্যাদা ও গুরুত্ব বহুগুণে বেড়ে যায়। ২০০০ সাল থেকে ইউনেস্কো এর সদস্য রাষ্ট্রগুলো আমাদের ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে দিবসটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে থাকে। ভাষা হিসেবে বাংলা এবং ‌বাঙালিদের জন্য এটা গৌরবের বিষয়।

বর্তমানে বিশ্বের ৩০টি দেশের ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু রয়েছে বাংলা বিভাগ, সেখানে প্রতি বছর হাজার হাজার অবাঙালি বাংলা ভাষাশিক্ষা ও গবেষণার কাজ করছে। এছাড়া চীনা ভাষায় রবীন্দ্র রচনাবলির ৩৩ খণ্ডের অনুবাদ এবং লালনের গান ও দর্শন ইংরেজি ও জাপানি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে বহির্বিশ্বে ভারত ও বাংলাদেশের পর ব্রিটেন ও আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি চর্চা হয়ে থাকে। এর বাইরে চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জার্মানি, পোল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বাংলা ভাষার সংস্কৃতি চর্চা হচ্ছে। আমেরিকায় কমপক্ষে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় ও এশীয় গবেষণা কেন্দ্রে বাংলা ভাষার চর্চা হচ্ছে। এর মধ্যে‌ নিউইর্য়ক, শিকাগো, ফ্লোরিডা, ক্যালিফোর্নিয়া, ভার্জিনিয়া উল্লেখযোগ্য। বিশ্বের ছয়টি দেশের রাষ্ট্রীয় বেতারে বাংলা ভাষার আলাদা চ্যানেল রয়েছে। আরও ১০টি দেশের রেডিওতে বাংলা ভাষার আলাদা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হচ্ছে। ব্রিটেনে ছয়টি ও আমেরিকায় ১০টি বাংলাদেশি মালিকানাধীন ও বাংলা ভাষার টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে। বিট্রেনে ১২টি বাংলা সাপ্তাহিক প্রত্রিকা বের হয়। ‘বেতার বাংলা’ নামে সেখানে একটি বাংলা রেডিও স্টেশন রয়েছে।

বাঙালি এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। তাই বাংলা ভাষার পরিধিও প্রসারিত হয়েছে। বাংলা ভাষায় এখন বিশ্বে প্রায় ৩০ কোটি লোক কথা বলে। ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাভাষীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৩১ কোটি ৬০ লাখ। প্রচলিত ভাষার মধ্যে মাতৃভাষার বিবেচনায় বিশ্বে বাংলার স্থান পঞ্চম। এ বিচারে বিশ্বের প্রধান ভাষাগুলো হলো- মান্দারিন (চীনা), ইংরেজি, হিন্দি, স্প্যানিশ, রুশ, আরবি, বাংলা, পর্তুগিজ, মালয়-ইন্দোনেশিয়ান ও ফরাসি। বিশ্বের সেরা ১০-১১টি ভাষার মধ্যে বাংলা অন্যতম। বাংলা এখন বিশ্বের তিনটি দেশের দাফতরিক ভাষা—বাংলাদেশ, ভারত ও সিয়েরালিয়ন।

বহির্বিশ্বে বাংলা ভাষার এতো কদর থাকলেও দেশে মাতৃভাষা হিসেবে বাংলার গুরুত্ব কতটুকু রয়েছে—সে প্রশ্ন স্বভাবতই সামনে চলে আসে। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি অর্জনের ৭১ বছর অতিবাহিত হলেও সর্বস্তরে এখনো বাংলা ভাষার প্রচলন নিশ্চিত হয়নি।‌ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, উচ্চ আদালত, প্রশাসন, ব্যাংক-বীমাসহ সব জায়গায়ই ইংরেজির একচ্ছত্র দাপট। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে সুনির্দিষ্ট আইন ও হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকার পরও তা তোয়াক্কা করছেন না কেউই। এখনো আদালতের রায় লেখা হয় ইংরেজিতে, চিকিৎসকরা ব্যবস্থাপত্রও লিখেন ইংরেজিতে। রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা, হাসপাতাল, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম থেকে শুরু করে সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার-ফেস্টুন, বিজ্ঞাপনে ইংরেজির ছড়াছড়ি। অথচ এসব ক্ষেত্রে বাংলায় সাইনবোর্ড লেখা বাধ্যতামূলক করে হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। ২০১৪ সালের ফেরুয়ারিতে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি হয়।

বাংলা‌ ভাষা প্রচলন আইন হয় ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ। একই বছরের ১২ এপ্রিল সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন যে, ভবিষ্যতে সকল নতুন আইন, অধ্যাদেশ, বিধি ইত্যাদি অবশ্যই বাংলায় প্রণয়ন করিতে হইবে।’ ১৯৭৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সর্বস্তরে বাংলাভাষা নিশ্চিত করতে মন্ত্রিসভা ৯টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ওই বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ১০ সচিবের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হয়। এর কয়েক মাস পর ৩ মে বঙ্গভবনের আদেশে বলা হয়, সব নোট, সারসংক্ষেপ বা প্রস্তাবটি বাংলায় উপস্থাপনা করা না হলে রাষ্ট্রপতি তা গ্রহণ করবেন না। ৪ মে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ-সংক্রান্ত আদেশটি সবাইকে অবহিত করে।

১৯৮৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের আদেশে বলা হয়, ‘রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা বারবার সকল স্তরে বাংলা প্রচলনের আদেশ দিলেও আংশিক কার্যকরী হয়েছে, কোথাও হয়নি।’ এতে জনসাধারণের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হচ্ছে। সরকার অনভিপ্রেত সমালোচনার মুখে পড়ছে। এই ক্ষোভ ও সমালোচনার মধ্যেই ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এক আদেশে দেশের সব সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বর প্লেট, সরকারি দফতরের নামফলক এবং গণমাধ্যমে ইংরেজি বিজ্ঞাপন ও মিশ্র ভাষার ব্যবহার বন্ধ করতে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন সরকারকে। আদালতের ওই আদেশের ৩ মাস পর ২০১৪ সালের ১৪ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডগুলোকে আদেশটি কার্যকর করতে বলে। কিন্তু তা না হওয়ায় ২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট আদালত কড়া ভাষায় বলেন, বাংলা ব্যবহারে দৃশ্যত কোনো অগ্রগতি নেই। পরে ২০১৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এক চিঠির মাধ্যমে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বর প্লেটে বাংলাভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করার অনুরোধ জানায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর লেখা ওই চিঠিতে বলা হয়, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার ইংরেজির স্থলে বাংলায় প্রতিস্থাপিত হয়েছে বলে দেখা যায় না। এটা বাংলাভাষা প্রচলন আইন, হাইকোর্টের রুল ও আদেশের পরিপন্থী বলে মনে করেন আইনবিদগণ।

এরপর সরকার একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে। এতে বলা হয়, যেসব প্রতিষ্ঠানের (দূতাবাস, বিদেশি সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্র ব্যতীত) নামফলক, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার ইত্যাদি এখনো বাংলায় লেখা হয়নি, তা নিজ উদ্যোগে অপসারণ করে আগামী ৭ দিনের মধ্যে বাংলায় লিখে প্রতিস্থাপন করতে হবে। না হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু আজো তা বাস্তবায়ন হয়নি। এর পেছনে ‌বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারের উদাসীনতার প্রশ্ন না উঠে পারে না।

বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, সে সাথে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ভাষা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অতিক্রম করা দেশের মধ্যে যার রাষ্ট্রভাষা বাংলা—সে ভাষার এমন অবমূল্যায়ন কোনভাবেই কাম্য নয়।‌ বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে এবং সর্বস্তরে বাংলার প্রচলনে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া এখন সময়ের দাবি। বাংলা‌ ভাষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের জন্য প্রশাসনিক উদ্যোগের পাশাপাশি এর বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেয়াটা জরুরি। বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করবে—এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্রিয় হতে হবে। বিশেষ করে ‌সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রনালয়, বাংলা একাডেমি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভাষা নিয়ে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি এদের কাজের তদারকি‌ এবং কাজের জবাবদিহিতার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

ইমরান ইমন মুক্তমত সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন: ৭১ বছরেও নিশ্চিত হয়নি


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর