তাচ্ছ্বিল্যের শৈবালে বিশাল অর্থনীতির হাতছানি
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৬:৪০
সমুদ্র কেবলই দেখা বা উপভোগের বিষয় নয়। শুধু পানিপথে যোগাযোগের মাধ্যমও নয়। পর্যটক হয়ে সাগর পাড়ে গিয়ে চিত্তরঞ্জন পর্যন্তই ভাবলে মস্ত ভুল হবে। পানি, বালি থেকে শুরু করে সমুদ্রের ময়লার পরতে পরতে পর্যন্ত লুকিয়ে আছে অর্থ যোগের উপাদান। উচ্ছিস্টের মতো সাগর বা নদীর গভীরে পড়ে থাকা শৈবাল নামের মামুলি বস্তুটির মাধ্যমেও বাংলাদেশ কী পরিমাণ অর্থের দিশা পেতে পারে, অনেকেরই তা ভাবনায় অকুলান। কিন্তু, কাজে না লাগিয়ে ফেলে রাখলে সম্পদ নয়। একে উত্তোলন করে বা কুড়িয়ে অর্থ হাতে আনাটা হচ্ছে বিষয়। এ জন্য চাই প্রথমত পরিকল্পণা, দ্বিতীয়ত প্রক্রিয়া।
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বেশ কয়েকটি উচ্চশিক্ষালয়ে এ বিষয়ক অধ্যয়ন চলছে। শিক্ষা-প্রশিক্ষণ-গবেষণা মিলিয়ে এ বিষয়ক শিক্ষার্থীদের দক্ষ ও আগ্রহী করে তুলছেন শিক্ষকরা। তাদের দেয়া শিক্ষা ও প্রেরণায় ওশানোগ্রাফি নামের নতুন বিষয়টিতে ঝুঁকছে বিজ্ঞান বিভাগের কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল করা শিক্ষার্থীরা। সমুদ্র-মহাসমুদ্রসহ বহুমাত্রিক বিষয়াদিতে পরিপূর্ণ সাবজেক্ট ওশানোগ্রাফিতে পড়াশোনায় আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। এরইমধ্যে সমুদ্রের উচ্ছ্বিষ্ট বা নগণ্য শৈবাল নিয়েই এই শিক্ষার্থীদের অধ্যয়ন ও গবেষণা অন্যান্য বিষয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য রীতিমত ঈর্ষার।
শৈবালকে সম্রদ্রবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় সি-উইড। এটি উদ্ভিদ প্রজাতির। কিন্তু, ডালপালা, ফুল-মূল কিছু না থাকায় একে সমুদ্রের নষ্ট আবর্জনার অংশ বিশেষ ভাবতে অভ্যস্ত সাধারণ অনেকে। আর ভাবুক-চিন্তুকদের কাছে শৈবাল গল্প-কবিতা বা গানে ব্যবহারের শব্দ। সমুদ্রের এ শৈবাল উদ্ভিদটি আপনাআপনিই সাগরের তলদেশে সালোক-সংশ্লেষণ করে। পরগাছার মতো মিশে থাকে উপকূলীয় সামুদ্রিক এলাকার পাথর, বালি, কাদা, খোলস বা অন্যান্য শক্ত কিছুর সঙ্গে। তথ্য গবেষণায় দেখা যায়, ওশানের সম্পদ নিয়ে গবেষণায় অগ্রগামী জাপান উচ্ছ্বিষ্ট না ভেবে সামুদ্রিক শৈবালকে যত্নআত্তি করতে থাকে সেই ১৬৪০ সাল থেকে। দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ-পরীক্ষণ শেষে সম্ভাবনা আঁচ করে চাষে হাত দেয় ১৯৪০ সালে। ১৯৭০ সাল নাগাদ শৈবালের বহুমুখী ব্যবহার আবিস্কার করে অনেকটা একতরফা বাণিজ্যও শুরু করে জাপান। চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডে মোট চাহিদার ৮০ ভাগের যোগান দিতে থাকে দেশটি। হালনাগাদ হিসাবে জাপানের জিডিপির ২১ শতাংশ আসে সামুদ্রিক শৈবাল ও শৈবাল দিয়ে উৎপাদিত সামগ্রী থেকে। জাপানের দেখাদেখি চীনও এখন বিশ্বের অন্যতম শৈবাল সংগ্রাহক ও উৎপাদনকারী দেশ। তারা নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে রফতানিও করে। চীনের ১৪-১৫ শতাংশ জিডিপি শৈবালের ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে শৈবালে জাপানের একচেটিয়া বাজারে ভাগ বসিয়েছে চীন ও ইন্দোনেশিয়া। দক্ষিণ কোরিয়া-মালয়েশিয়াও শৈবালের ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে ‘ভি’ চিহ্ন দেখাচ্ছে।
শৈবাল চাষের অপার-অবাধ সম্ভাবনা বাংলাদেশেও বিদ্যমান। দেশের ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত ও ২৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার উপকূলাঞ্চল শৈবাল চাষের জন্য কেবল উপযুক্ত নয়; তা স্রষ্টার দান, প্রকৃতির এক আশীর্বাদ। বিশাল এসব অঞ্চলের বালি, পাথর, শিলা ও কর্দমাক্ত ভিজা মাটি যেন এক সোনার থাল। আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা জয়ের পর এ থালটি এখন কানায়-কানায় ভরিয়ে দেয়ার অপেক্ষা। বাংলাদেশের উপকূলীয় এবং মোহনা অঞ্চলগুলোতে লাল, বাদামি ও সবুজ মিলিয়ে প্রায় ১৭৭ প্রজাতির শৈবাল দিয়ে কতো কিছুই না হতে পারে এবং হচ্ছেও। তবে, দেশে নয়, বিদেশে। কক্সবাজার থেকে প্রতিবেশি মিয়ানমার হয়ে আমাদের শৈবাল কিভাবে চীনসহ দেশে-দেশে চলে যাচ্ছে সেই খবরও থাকছে না। চলে যাওয়া ওইসব শৈবাল দিয়ে কী হয়, তা আমাদের অনেকের ধারনারও বাইরে।
নানা তথ্য-সাবুদ বলছে, বাদামি এবং সবুজ শৈবাল খাদ্যযোগ্য। লাল শৈবাল ব্যবহার হয় হাইড্রোকলয়েড উৎপাদনে। ২০১২ সালের এক গবেষণা মতে, বিশ্বে সামুদ্রিক শৈবালের ৪০% সরাসরি মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর পরোক্ষভাবে প্রক্রিয়াজাত খাবার ৪০%। বাকি ২০% যায় শিল্প খাতে। এতে প্রোটিন, ভিটামিন, লৌহ, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, বিটা ক্যারোটিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, সালফার, কপার, জিংক, কোবাল্ট, আয়োডিনের ব্যাপক সমাহার। শৈবালের ক্যারোটিন উপাদান মানবদেহে ক্যানসারের ঝুঁকি পর্যন্ত কমায়। এইডস প্রতিরোধেও সক্ষম। ডায়রিয়া এবং টিউমার রুখে দেয়। রোগজীবাণু থেকে রক্ষা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোসহ শৈবালের নানা গুন বুঝে এর গবেষণা এগোচ্ছে বিশ্বময়। অল্প পরিসরে নিজস্ব আঙিনায় আমরাও এ অধ্যয়ণ ও গবেষণার অংশীজন।
আমাদের কৃষি মন্ত্রণালয়ে শৈবাল সংক্রান্ত কিছু উদ্যোগ রয়েছে। অ্যাকাডেমিকভাবে ১৭৭ বলা হলেও বাংলাদেশে ২২০ প্রজাতির সি-উইড চিহ্নিত করার কথা জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের জানা বা আপ টু ডেট থাকার সুযোগ তুলনামূলক কম। এ সংক্রান্ত প্রচার, বুলেটিন বা প্রকাশনা নেই বললেই চলে। গণমাধ্যমেও এ সংক্রান্ত খবরের নিউজ ভ্যালু কম। দেশের শেষ প্রান্ত সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রায় এক যুগ আগে পরীক্ষামূলকভাবে দুই প্রজাতির শৈবাল চাষ বিষয়ক সংবাদের আপডেট জানা থাকলে ভালো হতো। নিজস্ব পর্যায়ের তথ্য তালাশ ও যোগাযোগে জানা যায়, সরকারের উৎসাহ-প্রণোদনা থাকলেও সেখানে এখনও পেশাদারিত্বের সঙ্গে শৈবাল চাষ হচ্ছে না। স্থানীয়রা বছরে মাস পাঁচেক ( নভেম্বর-জানুয়ারি, এপ্রিল-মে) নিজস্ব পদ্ধতিতে সমুদ্র থেকে শৈবাল সংগ্রহ করে। তারা একে বলে ‘হেজেল’। কিন্তু, হেজেল চাষের মোক্ষম সময় নভেম্বর থেকে এপ্রিল। এ সময়টা বাংলাদেশে শীতের ভাব বিরাজ করে, বৃষ্টি থাকে কম, সাগরের পানির লবণাক্ততা বেশি। যা শৈবাল চাষের জন্য যথোপযুক্ত। স্থানীয়রা এখনো ভালোভাবে জানে না তাদের টোকানো হেজেলে আসলে কী হয়? তাদের হেজেল নামের উদ্ভিদকণাগুলো কোথায় যায়? তাই পুরোটাই লাভ মনে করে যা পায় তাতেই হেজেল বেচে দেয় তারা। প্রতিবেশী মিয়ানমারের কিছু লোক তাদের কাছ থেকে শৈবালগুলো পানির চেয়েও কম দরে কিনে নেয়। তারা জানে না, সেগুলো যে মিয়ানমার থেকে উচ্চ দরের আইটেম হয়ে চলে যাচ্ছে চীন, কোরিয়া, জাপানসহ কয়েকটি দেশে।
চীন ও জাপানে খাদ্যাভ্যাসে শৈবাল রাখায় তাদের ক্যানসারের ঝুঁকি কমছে। আরো কয়েকটি দেশে ডেইরি, ওষুধ, টেক্সটাইল, কাগজ শিল্প এবং জেল জাতীয় খাবারে কাঁচামাল হিসেবে ব্যাপক ব্যবহৃত হয় সি-উইড। হাল গবেষণায় গাড়ি-বিদ্যুত, এমন কি বিমানের জ্বালানি হিসেবে শৈবালের কয়েকটি প্রজাতি থেকে বায়োফুয়েল, বায়োইথানল, বায়োহাইড্রোকার্বন, বায়োহাইড্রোজেন প্রাপ্তি নিয়ে ভাবা হচ্ছে। এসবের উচ্ছিষ্ট অংশ থেকে হতে পারে বায়োগ্যাস ও জৈবসার। মার্কিন গবেষকরা আগামীতে বৈশ্বিক জ্বালানির ৮০ শতাংশ সামুদ্রিক শৈবাল থেকে পাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। তাহলে আমরা কেন পিছিয়ে থাকবো? আমাদের অধ্যবশায়- আগ্রহ, সুযোগ্য শিক্ষকদের প্রেরণা বিফলে যেতে পারে না। কয়েকটি অভিধানে শৈবাল বা সি-উইডকে ‘সামুদ্রিক আগাছা’ অনুবাদ আমাদের কষ্ট দেয়। সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিসে অবশ্য একে ‘জলজ সম্পদ’ বলা হচ্ছে। উপরোক্ত অনুবাদ যথার্থ মনে হয় না এ বিষয়ে ব্যাপক আগ্রহ-উদ্দীপনায় শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষা প্রদানে নিয়োজিতদের কাছে। ‘সামুদ্রিক আগাছা’ বা ‘জলজ সম্পদ’ এর চেয়ে ‘সামুদ্রিক সম্পদ’ নামকরণ করলে তারা যথার্থ ভাববেন। সম্মান বোধও করবেন।
লেখক: শিক্ষার্থী, ওশানোগ্রাফি; বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হল, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এজেডএস