ফজলুর রহমান ফান্টুর অভাব পূরণের নয়
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৭:৫১
জন্ম-মৃত্যু নিয়েই জীব। জগতের কোন জীবই অমরণ নয়, কারও অভাব কেউ কোন দিনই পূরণ করতে পারে না। কঠিন সত্যটা জানার ও মানার পরও কিছু সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের মৃত্যু নামক সত্যটাকে পেছনে ফেলে অভাবকেই ফুটিয়ে তোলে। কিছু মৃত্যু যেন অপ্রত্যাশিত, অনাকাংখিত, বেদনাদায়ক ও অপূরণীয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান ফান্টুর মৃত্যুটা তেমনি।
আজ থেকে এক মাস আগেও যে অনর্গল কথা বলত, যার কথার মধ্যে কোন জড়তা ছিল না, যার কথাগুলো ছিলো সাজানো-গুছানো আজ সে মরহুম। আরও এক মাস আগের কথা ভাবলে তার মৃত্যুর পূর্বের চেহারার সাথে যেন কোনভাবেই মেনে নেওয়ার মত ছিল না। কিন্তু এটাই সত্য, এটাই বাস্তবতা। নশ্বরদেহ আমাদের না। আমরা শুধু দেহ বহনকারী মাত্র।
জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান ফান্টু একাধারে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতি পাঠাগারের সভাপতি, ঈশ্বরদী সাহিত্য-সংস্কৃতি পরিষদের সহ-সভাপতি, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক সহকারি কমান্ডার ও সাপ্তাহিক চেতনায় ঈশ্বরদীর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক,ঈশ্বরদী প্রেসক্লাবের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ছিল তার সাবলীর যাত্রা। বয়সটা যেন কোন ভাবেই তাকে হার মানাতে পারে নি। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার বয়সের কমতি ছিল না। কিন্তু সদা হাসোজ্জ্বল ও মিশুক এই মানুষটি তার কর্মে যেমন সকল কর্মকান্ডে দায়িত্বের পরিচয় দিয়েছেন তেমনি কথায় মন জয়ও করেছেন।
১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি জন্ম এই মানুষটি এ বছরের ১৯ জানুয়ারী ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে ৭১ বছর বয়সে শহরের থানা পাড়ার পোস্ট অফিস মোড়ে নিজ বাড়িতে অসুস্থ অবস্থায় মারা যান। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, ১ ছেলে ও ১ মেয়ে রেখে যান। বৃহস্পতিবার দুপুরে ঈশ্বরদী কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জানাযা শেষে ঈশ্বরদীর কেন্দ্রীয় করবস্থানের মুক্তিযোদ্ধা কর্নারে তার মরদেহ দাফন করা হয়। তার কফিনে শ্রদ্ধা জানান ঈশ্বরদীর বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা। তাঁর মৃত্যুতে ঈশ্বরদীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অংঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। জানাযা নামাজেও অংশ নেন হাজারো মানুষ। সকলের চোখে-মুখে ছিল শোকের ছায়া। অনেকে যেন অবাকই হয়েছেন প্রাণচঞ্চল মানুষটি কিভাবে চোখের উপর মৃত্যুর কোলে ঢোলে পরল। সবার মধ্যেই আক্ষেপ ছিল মানুষটির আর সময় বেঁচে থাকার প্রয়োজন ছিল। সমৃদ্ধ ইতিহাসের প্রয়োজনে তার অভাব পূরণীয় নয়।
ঈশ্বরদী নাগরিক কমিটিকে কৃতজ্ঞতা জানাই কিছুটা হলেও স্মৃতিচারণ করে অবদানকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। ঈশ্বরদী নাগরিক কমিটির মানবিক এই উদ্যোগগুলো বরাবরই প্রশংসার দাবি রাখে। শ্রদ্ধার আড়ালে তারা ঐতিহ্যকে লালিত করছে। যা তরুন প্রজন্মের জন্য প্রয়োজন হয়ে দাড়িয়েছে। আমি নিজেও জানতাম না ঈশ্বরদীর এতো ইতিহাস ও সংগ্রাম।
আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের দেখছি। তাদের সেই ভয়াবহ দিন ও জীবনবাজির গল্প তাদের মুখ থেকে শুনছি। কিন্তু আজ থেকে কয়েক দশক পরে মুক্তিযোদ্ধা কারা তাদের ছবিতে দেখাতে হবে কোন জাদুঘরে গিয়ে বা ছবিতে। বলতে হবে এই ছবির মানুষটি মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের পরের প্রজন্ম তাদের মুখ থেকে গল্প শুনতে পারবে না। অথচ তাদের কারণেই আজ আমরা স্বাধীন। সেই সাথে সঠিক ইতিহাসের বিকৃতও ঘটবে মুখে মুখে, কানে কানে।
সাধারণত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রেই বেশিরভাগ স্মৃতিচারণ বা জীবনীকে তুলে ধরার উদ্যোগটা বেশি দেখা যায়। কিন্তু ফজলুর রহমান ফান্টুকে নিয়ে বিভিন্ন সংগঠনের শ্রদ্ধা ও স্মরণ তার কর্মময় জীবনীকেই যেন দৃষ্টিপাত করছে। একজন দক্ষ সংগঠকের পরিচয় তুলে ধরছে। আজও তার কথা মনে হলে স্মৃতির আড়ালে বিস্মৃতি হয়ে যায়, মনে হয় তিনি বেঁচে আছেন। আজও আমার মোবাইলে তার নম্বরটা দেখি আর ভাবি সবই আছে কিন্তু কাকা আর নেই। আমাকে পরিষ্কার স্বরে কল করলেই বলত গোপাল কাকা বলো যা আমাকে আজও আবেগপ্রবণ করে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান ফান্টু আর হবে না। তবে তার চেতনা, তার কর্মকান্ড কাউকে যদি কিছুটা অনুপ্রাণিত করে সেটাই হবে সকলের সার্থকতা। জগতে ভাল কাজ করতে হলে কাউকে না কাউকে ভালর স্থানটা দখল করতে হবে। তাছাড়া মন্দের রাজত্বে হারিয়ে যাবে প্রিয় মানুষগুলোর পদচারণা। ফজলুর রহমান ফান্টু অমিলন হয়ে থাক মনের কোঠরে, শ্রদ্ধা জানায় স্মৃতির গভীরে। সেই সাথে কীর্তিময় এই মানুষটির নামে কোন কিছুর নামকরণ করা যায় কি না ভাবার অনুরোধ রাখতে চাই নীতি-নির্ধারকদের। নামকরণ শুধু তার স্মৃতিই বহন করবে না, বহন করবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতীক।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামলেখক
সারাবাংলা/এজেডএস