সবুজ শ্যামল অপরূপ বৈচিত্র্যের আধার মোদের বাংলাদেশ। এ দেশের মাঠে-ঘাটে ছড়িয়ে আছে অপরূপ সৌন্দর্য। চোখ মেলে তাকালেই হৃদয় জুড়িয়ে যায়। চির সবুজের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে জলরাশি। জলে ভেসে যায় মাছবোঝাই নৌকা। মাছে ভাতে বাঙালি অর্থাৎ নদীমাতৃক আমাদের দেশ। নদীকেন্দ্রিক গড়ে ওঠা ব্যবসা কেন্দ্রে ব্যস্ত সময় কাটে মেহনতী মানুষের।
আবার শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন দিনে সরিষার হলুদ মাঠ আর খেজুরের রস প্রকৃতির অনন্য উপহার। এই মোদের অপরূপ বৈচিত্র্যের আধারের দেশটা যত দিন যাচ্ছে ততই যেন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। শুনে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছেন যে অপরূপ সৌন্দর্যের দেশটা কিভাবে ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে?
দেশের সৌন্দর্য তখনি থাকে যখন দেশের সাধারণ জনগণ সুখ আর শান্তিতে থাকে। কিন্তু বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় সুখ ও শান্তি যেন সোনার হরিণ। সেই সোনার হরিণ কোনো ভাবে দেখা মেলে না। জেঁকে বসেছে অর্থনৈতিক বৈষম্য। ফলে মানুষের উদ্বিগ্নতা ঊর্ধ্বমুখি। এ দেশের এক শ্রেণির মানুষ পরিবেশ ধ্বংসের আয়োজন করে। নদী দখল, মাঠ দখল এবং দেশের আনাচে কানাচে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে অবৈধ ইটের ভাটা। বাধা দেওয়ার কেউ নেই। নিরবতায় পরিবেশ দূষণ করে যাচ্ছে।
তবে আমাদের দেশের বড় হতাশার কথা হুহু করে বাড়ছে বেকারত্বের সংখ্যা। শিক্ষা গেছে ব্যবসায়ীদের হাতে। বাজার গেছে সিন্ডিকেটের হাতে। চিকিৎসা গেছে পুঁজিবাদীদের হাতে। চলছে রাজনীতির নামে অপরাজনীতি। ভিন্ন মতকে দমন আর বেড়েছে টাকা পাচারকারী ও লুটপাটের সংখ্যা। প্রকাশ্যে দুর্নীতি চলে দিনরাত্রি। তেমনি ভাবে পাহাড় থেকে সমতলে নারী শিশু নির্যাতন চলে সমান তালে।
‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’ এই স্লোগানের প্লাকার্ড যেন বুকে বেঁধে যানবাহনে যাতায়াত করা সময় এসেছে। কারণ সড়কের অব্যবস্থাপনায় মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। এর শেষ কোথায়? মানুষ স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি কবে পাবে? এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর রাষ্ট্রযন্ত্র কবে দিতে পারবে। দেশের সচেতন মানুষ জানতে চায়।
দেশের প্রতিটির হৃদয়বিদারক ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই নতুন করে শুরু হয় হৃদয়বিদারক ঘটনা। সড়কে প্রতিটি মৃত্যু যেন রহস্যময়। ফলে তার কারণ অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলায় মালিপাড়া নামক সড়কে ট্রাক-সিএনজি’র মুখোমুখি সংঘর্ষে সিএনজি’র চালকসহ ঝরে গেছে তাজা পাঁচটি প্রাণ।
নিহত পরিবারের স্বজনদের আহাজারির মধ্যে ক্ষেতলাল উপজেলার আকাশ যেন ভারী হয়ে গেছে। বিষাদময় এ উপজেলার মানুষ সড়কে এই মৃত্যুর ক্ষোভ প্রকাশ করছে। সড়ক দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বের হয়ে আসে অব্যবস্থাপনার মহাচিত্র। প্রাণহানির ঘটনায় ট্রাক নাকি অটোরিকশাচালকের দোষ ছিল? অটোরিকশাচালক আমজাদ আগের দিন রাতে ক্ষেতলাল থানা পুলিশের সঙ্গে ডিউটিতে ছিলেন।
পুলিশের ডিউটি শেষ করে দুর্ঘটনার দিন সোমবার সকালে অটোরিকশায় একটু ঘুমান তিনি। তিনি সকাল ১০টার পর জয়পুরহাট বাস টার্মিনাল থেকে পাঁচ যাত্রী নিয়ে ক্ষেতলালের উদ্দেশে রওনা দেন। ট্রাকচালকের লাইসেন্স নেই সেলিম উদ্দিনের তবুও তিনি টানা ৬ দিন ধরে ট্রাক চালাচ্ছিলেন যা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এমন তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
ফলে যার কারণে ক্ষেতলালের মালিপাড়া সড়কে ঝরে গেছে পাঁচটি তাজা প্রাণ। তাদের মধ্যে এক ছিল কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী শাহারিয়ার নাফিজ। তার প্রাণটি ঝরে গেল অকালে। পিতামাতার কত স্বপ্ন ছিল ছেলেকে ডাক্তার বানাবেন। সেই স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে এর দায় কার? চারিদিকে শুধু সড়কে মৃত্যু। এ মৃত্যুতে বাংলার আকাশ কেমন যেন মলিন হয়ে যাচ্ছে। দেশজুড়ে হতাশার আওয়াজ ভেসে আসছে। প্রতিটি অনাঙ্ক্ষিত ঘটনায় এক শ্রেণির মানুষ ভাগ্যে উপর দায় চাপাতে আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু সড়কে মানুষের মৃত্যু গুলো আদৌও কি কপালত্বের বিষয় আছে?
পত্রিকার পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যায় গত বছর দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৬,৮২৯টি তার মধ্যে নিহত হয়েছেন ৭,৭১৩ জন এবং আহত হয়েছেন ১২,৬১৫ জন। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে নতুন বছরে গত জানুয়ারি মাসে দেশে ৫৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৫৮৫ জন নিহত ও ৮৯৯ জন আহত হয়েছেন। একই সময় রেলপথে ৪৪টি দুর্ঘটনায় ৪৫ জন নিহত ও ৭৮ জন আহত হয়েছেন। আর নৌ-পথে ১৩টি দুর্ঘটনায় ১১ জন নিহত, একজন আহত এবং ছয়জন নিখোঁজ হয়েছেন। সিবমিলে জানুয়ারি মাসে সড়ক, রেল ও নৌ-পথে মোট ৬৫০টি দুর্ঘটনায় ৬৪২ জন নিহত এবং ৯৭৮ জন আহত হয়েছে। এসব দুর্ঘটনার মধ্যে এই মাসে ২১৪টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২০৫ জন নিহত, ১১৪ জন আহত হয়েছে।পত্রিকার পরিসংখ্যানের হিসেব শেষ করতে না করতেই সড়কে মানুষের মৃত্যু দেখতে হচ্ছে।
সড়ক দুর্ঘটনায় আহত নিহতের ঘটনাকে রাষ্ট্র কীভাবে ব্যাখ্যা করবে? তারা কি নিছকই দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে, না কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার কারণে? বিশেষ করে অনিরাপদ সড়কে শিক্ষার্থীর জীবন চলে যাচ্ছে। চলতি বছর জানুয়ারিতে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৪৬ জন শিক্ষার্থী। গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৮৮৫ জন।
তখন স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে। রাষ্ট্রের শিক্ষার্থীদের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি কি ভঙ্গ করেছে? ২০১৮ সালে রাজধানীতে এক বেপরোয়া বাসের চাপায় ২ কলেজ শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় দেশব্যাপী বিক্ষোভ প্রতিবাদের চাপে পুরনো আইন সংশোধন করে অপরাধের দণ্ডের মাত্রা বাড়ানোসহ কিছু কঠোরতা আরোপ করা হয়। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুযায়ী, গাড়ির লাইসেন্স না থাকলে সর্বোচ্চ ৬ মাস কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। ভুয়া লাইসেন্সের জন্য শাস্তি আরো বেশি। সর্বোচ্চ ২ বছর কারাদণ্ড ও ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে নতুন আইনে। ফিটনেসবিহীন গাড়ির জন্য সর্বোচ্চ ৬ মাস কারাদণ্ড ও ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। একইভাবে বিভিন্ন ধারায় ট্রাফিক আইন অমান্যের জন্য বাড়ানো হয়েছে শাস্তি ও জরিমানা।
শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে যে সড়ক পরিবহন আইনটি তারা করেছিল, সেটি বাস্তবায়ন না করে ফাইলবন্দী করে রাখার অর্থ কী? আর সড়কে গাড়ির চালক নিরাপদে নেই বলেই জানুয়ারিতে সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন চালক ১৫৩ জন, একই সময়ে আহত চালকের সংখ্যা ২০৬।
সড়কের অব্যবস্থপনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে? শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে বারবার আন্দোলনে আসে। রাষ্ট্র, সরকারকে জানান দিচ্ছে সড়কের অব্যবস্থাপনার যাঁতাকলে সাধারণ মানুষ পৃষ্ট। কবে নিরাপদ সড়ক পাবে বাংলাদেশের মানুষ? সড়কের মৃত্যুর মিছিল কি চলমান থাকবে? আন্দোলনকারীদের ভাষা কি সরকার বুঝতে পারে না? নিরাপদ সড়কের দাবিতে আমরা কিশোর বিদ্রোহ দেখেছি।
সরকারেও বলছে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের দাবি গুলো যৌক্তিক। কিন্তু তারপরও কেন দাবি গুলো মেনে নেওয়া না হচ্ছে। তার জন্য শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়ে সড়কের অব্যবস্থাপনার জন্য সমাবেশের মাধ্যমে লাল কার্ড প্রদর্শন করেছিল। তবুও যেন রাষ্ট্রের সুবুদ্ধির উদয় হয় না। মানুষ যখন ঘর থেকে বাইরে যায় তখন তার জীবন নিয়ে প্রচুর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে। মনে হয় মৃত্যুর সনদ পত্র বুঝি পকেটে নিয়ে চলতে হয়। সড়ক দুর্ঘটনায় সাধারণ মানুুষের বেশি মৃত্যু হয়। সড়কে নিরাপত্তা তো নেই।
সাধারণ নিম্ন আয়ের মানুষ অর্থনৈতিক সংকটে তিন বেলা পুষ্টিমান খাবার না পেয়ে অপুষ্টিতে ভুগছে। আবার এর মধ্যে যদি মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে সড়কে চলাচল করতে হয় তাহলে ভাবুন সাধারণ মানুষ চারিদিক দিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় আছে? সাধারণ মানুষের মুক্তি কোথায়? যুক্তিতে মুক্তি না কি লড়াই সংগ্রামে মুক্তি তা নিয়ে ভেবে দেখতে হবে। লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস বলে দেয় সংগ্রামের মাধ্যমে মুক্তি পথ খুঁজতে হবে কিন্তু সেই মুক্তির সংগ্রামে সাধারণ মানুষ কতটুকু আগ্রহী? গণতান্ত্রিক আন্দোলন করার পরিস্থিতি ও পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন আছে।
মোট কথা সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো কোনো কঠিন কাজ নয়। সড়কে প্রতিযোগিতা রোধ এবং শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে সড়ক আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। তাই যত্রতত্র যাত্রী ওঠা-নামা বন্ধে যাত্রীছাউনির ব্যবস্থা করতে হবে। চালকদের বেপরোয়া প্রতিযোগিতার মনোভাব ও গতি রুখতে সচেতনতা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। লাইসেন্স ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির চলাচল নিষিদ্ধ করতে হবে।
নতুন করে যেন লাইসেন্সবিহীন ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল করতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। ত্রুটিপূর্ণ সড়ক দ্রুত সংস্কার এবং দুর্ঘটনাপ্রবণ মোড় চিহ্নিত করে দিতে হবে। সড়কে পুলিশ ও মোবাইল কোর্টকে সততার সঙ্গে বেশি সক্রিয় থাকতে হবে। আধুনিক, মানসম্পন্ন ও নিরাপদ সড়ক পরিবহন যে কোনো দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকেও গতিশীল করে। পরিবহন খাত এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
আঞ্চলিক যোগাযোগ ছাড়াও আন্তর্জাতিক অনেক বিষয় এখন পরিবহনে যুক্ত। তাই সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং এজন্য সময়ের ধারাবাহিকতায় সড়ক পরিবহন আইনে যে বিষয়গুলো সংযোজিত হয়েছে, তা কঠোর ভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। তাই আসুন সড়ক আইন মেনে চলি, নিরাপদে গন্তব্যে ফিরি। আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, সময়ের সমষ্টি হলো জীবন। সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না। তাই সড়কে কোনো প্রাণ যাতে না ঝরে এবং কোনো কান্না শুনতে না হয় তার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ একান্ত প্রয়োজন।
লেখক: কলামিস্ট